Image description

মনোনয়ন লড়াইয়ে জেরবার নোয়াখালী জেলা। প্রতিটি আসনেই গ্রুপিং আর লড়াই। মনোনয়ন পেতে সম্ভাব্য প্রার্থীরা কেন্দ্র থেকে গ্রাম পর্যন্ত ছুটছেন। তবে বিএনপি’র সাবেক সংসদ সদস্যরা অনেকটাই নির্ভার। ছয়টি আসন নিয়ে নোয়াখালী জেলা। বিএনপি’র দুর্গ হিসেবে সারা দেশে পরিচিত নোয়াখালী। কিন্তু গত ষোল বছরে আওয়ামী লীগ নির্বাচনের নামে দখল করে রেখেছিল নোয়াখালীকে। এ সময়ে আওয়ামী লীগের শাসন আর শোষণে বিএনপি হয়ে পড়ে কোণঠাসা। মামলা, হামলা আর নির্যাতনে অধিকাংশ নেতাই ছিলেন আত্মগোপনে। কিছু নেতা অবশ্য আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে এলাকায় ছিলেন। গত বছর ৫ই আগস্টের পর হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন নেতাকর্মীরা। এলাকায় প্রবেশ করেন। কিন্তু এ প্রবেশ তাদের সুখ দিতে পারেনি। কোনো কোনো নেতা আওয়ামী লীগের রেখে যাওয়া চাঁদার স্পটগুলো দখলে নেয়। কেউবা নতুন করে চাঁদার স্পট তৈরি করে। পাশাপাশি আগামী নির্বাচন নিয়ে জড়িয়ে পড়ে গ্রুপিংয়ে। প্রতিটি আসনেই সম্ভাব্য প্রার্থীদের অনুসারী তৈরি হয়।

তারা মিছিল, মিটিংয়ের পাশাপাশি অন্য পক্ষের সঙ্গে সংঘাত, সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষ তাদের প্রতি ক্ষুব্ধ। কিন্তু প্রকাশ্যে কেউ কিছু বলতেও পারছে না। 
চাটখিল ও সোনাইমুড়ী উপজেলা নিয়ে গঠিত নোয়াখালী-১ আসন। এ আসনের সাবেক এমপি ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন। এলাকার বিএনপি’র বড় অংশ তার পক্ষে মাঠে রয়েছে। তবে এ আসনে তাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে মনোনয়ন লড়াইয়ে মাঠে নেমেছেন  বিএনপি’র জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মামুনুর রশীদ মামুন, সাবেক এমপি ও জেলা বিএনপি’র আহ্বায়ক কমিটির সদস্য এডভোকেট সালাহ উদ্দিন কামরান, বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মনির হোসেন কাজল। আসন জুড়ে বিভিন্ন জায়গায় সম্ভাব্য প্রার্থীদের পোস্টার, বিলবোর্ড মানুষের দৃষ্টি কাড়ছে। এলাকার রফিক উদ্দিন নামের একজন বিএনপি সমর্থক বলেছেন,  এসব পোস্টার একপক্ষ দিনে লাগিয়ে গেলে রাতে সেসব ছিঁড়ে ফেলার ঘটনাও ঘটছে। এ নিয়ে সংঘাত, সংঘর্ষ হয়েছে নির্বাচনী এলাকার বিভিন্ন জায়গায়। সম্ভাব্য প্রার্থীদের নিয়ে কোন্দলে জড়িয়ে পড়েছে নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। চাটখিল উপজেলার এক ইউনিয়নের পদধারী নেতা বলেন, ভাই নাম প্রকাশ করবেন না। আমার বক্তব্য রেকর্ড করে নিয়ে যান। নোয়াখালীতে গত ষোল বছর আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের দেয়া মামলার আসামিরা আশ্রয় পেয়েছে ব্যারিস্টার খোকনের কাছে। তিনি বিনা পয়সায় আমাদের মামলা লড়েছেন। অথচ আমি বুঝি না ওইসব নেতাদের কেউ কেউ এখন অন্য সম্ভাব্য প্রার্থীর হয়ে স্লোগান দিচ্ছে। তবে মনোনয়ন চাইবার অধিকার সবার আছে। দল কাকে মনোনয়ন দেয় সেটা এখন দেখার বিষয়। 

নোয়াখালী-২ আসনটি গঠিত সেনবাগ উপজেলা ও সোনাইমুড়ী উপজেলার একাংশ নিয়ে। এ আসনের সাবেক এমপি জয়নুল আবদিন ফারুক। ষোল বছরে তার সরকারবিরোধী লড়াই সংগ্রাম গোটা দেশবাসী জানেন। সেনবাগের জহির নামে এক বিএনপি কর্মী বলেন, জয়নুল আবদিন ফারুক আন্দোলন করতে গিয়ে সংসদ ভবনের সামনে পুলিশের হাতে মার খান। তার ওপর বর্বর হামলা চালায় পুলিশ কর্মকর্তা হারুন। পরে যিনি ডিবি’র প্রধান হন।  এ মারের পুরস্কার হিসেবে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা হারুনকে একের পর এক প্রমোশন দিয়ে শেষ পর্যন্ত ডিবি প্রধান বানান। ফারুক এবারো এই আসন থেকে মনোনয়ন চাইবেন। আমরা আশা করি তিনি এ আসনে মনোনয়ন পাবেন। এরইমধ্যে এ আসনে মনোনয়ন লড়াইয়ে মাঠে পুরোদমে কাজ করছেন বিএনপি’র জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য কাজী মফিজুর রহমান, সৌদি আরব বিএনপি’র দক্ষিণাঞ্চলের যুগ্ম আহ্বায়ক ও জেলা বিএনপি’র আহ্বায়ক কমিটির সদস্য আব্দুল মান্নান। একাধিক সম্ভাব্য প্রার্থী থাকায় স্থানীয় পর্যায়ের নেতারাও বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। তারা প্রায়ই ছোটখাটো বিষয় নিয়ে সংঘাতে লিপ্ত হচ্ছেন। এ আসনের ভোটাররা আতঙ্কে রয়েছে যেকোনো সময় বড় ধরনের সংঘর্ষের।

গত ৮ই সেপ্টেম্বর সেনবাগ উপজেলা ও পৌর বিএনপি’র আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করে জেলা বিএনপি। সদ্য ঘোষিত কমিটিতে আবদুল মান্নানের অনুসারীরা বেশি পদ পেয়েছেন। তবে তুলনামূলক কম পদ পাওয়ায় কাজী মফিজুর রহমানের অনুসারীরা এ কমিটি প্রত্যাখ্যান করে কর্মসূচি পালন করে আসছে। ওদিকে জয়নুল আবদিন ফারুকের অনুসারীদের মধ্যেও পদ নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে। পদবঞ্চিতরা কমিটি প্রত্যাখ্যান করেছেন। ৯ই সেপ্টেম্বরই ওই কমিটি বাতিলের দাবিতে সেনবাগে দফায় দফায় বিক্ষোভ সমাবেশ করেন দলটির নেতাকর্মীরা। সেদিন বিকালে বিক্ষোভ করেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকের অনুসারী একাংশ। পরদিন দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য আলহাজ কাজী মফিজুর রহমানের অনুসারীরা বিক্ষোভ করেন। 
বেগমগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত নোয়াখালী-৩ আসন। এ আসনের সাবেক এমপি বরকত উল্লাহ বুলু। মাঠে রয়েছেন পারটেক্স গ্রুপের সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক এমপি মরহুম হাসেমের ছেলে শওকত আজিজ রাসেল, জেলা যুবদলের সভাপতি মঞ্জুরুল আজিম সুমন, জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ডা. কাজী মাজহারুল ইসলাম দোলন। মনোনয়নপ্রত্যাশীদের ঘিরে এ আসনে অভ্যন্তরীণ কোন্দল তুঙ্গে। চার সম্ভাব্য প্রার্থী এবং তাদের নেতাকর্মীদের মধ্যে চলছে রেষারেষি এবং হামলা-মামলা। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে একাধিক বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল নেতা হামলার শিকার হয়েছেন। মনোনয়ন নিয়ে কোন্দলে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেয়া বেগমগঞ্জ উপজেলা ছাত্রদলের সদস্য সচিব দাউদ-উর-রহমান বহিষ্কার পর্যন্ত হয়। এ ছাড়া দুই দফায় ছাত্রদল নেতা ফারহানের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয় এবং হত্যার হুমকি দেয়া হয়। এ ছাড়াও দলীয় কোন্দলে হামলার শিকার হন চৌমুহনী পৌরসভার পরিবহন ব্যবসায়ী রাব্বানী। জেলা ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক শাকের আহমেদ সবুজকে কুপিয়ে আহত করা হয়। উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক আবুল কালাম আজাদকে ফেসবুকে প্রভাবশালী এক নেতার বিরুদ্ধে দেয়া অন্যের স্ট্যাটাস শেয়ার করায় বহিষ্কার করা হয়। উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে দলীয় কোন্দল-দ্বন্দ্ব চরমে। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভেদ ততই বাড়ছে।  

নোয়াখালী সদর ও সুবর্ণচর উপজেলা নিয়ে গঠিত নোয়াখালী-৪ আসন। এ আসনের সাবেক এমপি বিএনপি’র কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান। এবার তিনিও মনোনয়ন যুদ্ধে পড়েছেন। তার বিপরীতে মনোনয়ন পেতে মাঠে রয়েছেন বর্তমান জেলা বিএনপি’র সদস্য সচিব হারুনুর রশিদ আজাদ, বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের মানবাধিকারবিষয়ক উপদেষ্টা, মিডিয়া সেল ও দলের বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির সদস্য এবং দেশমাতা ফাউন্ডেশনের প্রধান সমন্বয়ক ব্যারিস্টার আবু সালেহ মো. সায়েম, এডভোকেট এবিএম জাকারিয়া এবং কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন নাসির। এ নির্বাচনী এলাকায় দ্বন্দ্ব এখন প্রকট।  এ অবস্থায় তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। এতে রসদ জোগায় কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন নাসির। এখানে আলাদাভাবে দলীয় ও জাতীয় কর্মসূচি পালন করেছেন সম্ভাব্য প্রার্থীর অনুসারীরা। এই দ্বন্দ্বের বলি হয়ে বহিষ্কার হন সুবর্ণচর উপজেলা যুবদলের সভাপতি বেলাল হোসেন সুমন ও উপজেলা বিএনপি’র সদস্য জামাল উদ্দিন গাজী। 

কোম্পানীগঞ্জ ও কবিরহাট উপজেলা নিয়ে গঠিত নোয়াখালী-৫ আসন। এ আসনের সাবেক এমপি ছিলেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। তার মৃত্যুর পর শূন্য আসনে একাধিক প্রার্থী মাঠে। তাদের দ্বন্দ্বে কোম্পানীগঞ্জ এখন অগ্নিগর্ভ। ইতিমধ্যে এ দ্বন্দ্বের বলি হন উপজেলা বিএনপি’র যুগ্ম আহ্বায়ক, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল মতিন তোতা। তাকে প্রতিপক্ষ কুপিয়ে হত্যা করে। শুধু তোতা নয় দু’টি খুনের ঘটনা ঘটে সম্ভাব্য প্রার্থীদের দ্বন্দ্বের জেরে। তোতা বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নেতা মনোনয়ন প্রত্যাশী বজলুল করীম চৌধুরী আবেদের অনুসারী ছিলেন। বিভক্ত নেতাকর্মীরা তাদের স্ব স্ব প্রার্থীর পক্ষে-বিপক্ষে মিটিং-মিছিল, সভা-সমাবেশ করে যাচ্ছেন।  বিভিন্ন ঘটনায় এক পক্ষ আরেক পক্ষের বিরুদ্ধে করেছেন মামলাও। এ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী দীর্ঘ হলেও চার জন রয়েছেন আলোচনায়। এরমধ্যে রয়েছেন মওদুদ পত্নী হাসনা মওদুদ, সাবেক ছাত্রদল নেতা, বর্তমানে বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নেতা বজলুল করীম চৌধুরী আবেদ, এক সময়ের জামায়াত থেকে বিএনপিতে যোগ দেয়া মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম এবং গোলাম হায়দার বিএসসি। 

দ্বীপ উপজেলা হাতিয়া হলো নোয়াখালী-৬ আসন। এ আসনেও বিএনপি’র একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সরব উপস্থিতি কোন্দল বাড়িয়ে তুলছে। এ আসনের সাবেক এমপি প্রকৌশলী মোহাম্মদ ফজলুল আজিম মনোনয়ন চাইবেন। এ ছাড়া মনোনয়ন দৌড়ে রয়েছেন বিএনপি’র কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান শামীম, হাতিয়া উপজেলা বিএনপি’র সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী তানভীর উদ্দিন রাজীব। দলীয় মনোনয়ন ঘিরে সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাড়ছে প্রতিনিয়ত। মনোনয়ন দ্বন্দ্বে দুই মাস আগে জুলাইয়ে তমরুদ্দি ও জাহাজমারা ইউনিয়নে বিএনপি’র দু’গ্রুপের মধ্যে একাধিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে উভয় পক্ষের অন্তত ৬০ জন আহত হন। স্থানীয় বিএনপি’র একাধিক নেতাকর্মী বলেছেন, মনোনয়নপ্রত্যাশীরা একে অপরের ছায়া দেখতে পারেন না। এ দ্বন্দ্বের প্রভাব আগামী নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর ওপর পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। 
সার্বিক বিষয়ে নোয়াখালী জেলা বিএনপি’র আহ্বায়ক মাহবুব আলমগীর আলো বলেন, ঠিক বলেছেন মনোনয়ন নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছে সবক’টি আসনে। ইতিমধ্যে আমরা সবাইকে নিয়ে বসেছি। আর বুঝতেই তো পারেন এত বড় একটি দল। এখানে একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী থাকা স্বাভাবিক। বিভিন্ন জায়গায় এ নিয়ে মারামারি হচ্ছে। তবে আমি বলতে চাই মনোনয়ন কনফার্ম হয়ে গেলে এসব থাকবে না। আর মনোনয়ন পাওয়ার আগে সম্ভাব্য প্রার্থীর অনুসারীরা মারামারি করে নিজেদের শক্তিমত্তা দেখাতে চায়। আমরা কিন্তু বসে নেই। সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমাদের প্রিয় নেতা তারেক রহমান সরাসরি নজর রাখছেন। না হলে আরও অনেক কিছু হতে পারতো। শেষ কথা বলি, আগামী নির্বাচনে অবশ্যই আমরা সবক’টি  আসনে জয়ী হবো। জনগণ আমাদের সঙ্গে রয়েছেন।