
আগামী অক্টোবর মাসের প্রথমার্ধ্বে এই মামলার সব সাক্ষীর জবানবন্দি এবং যুক্তিতর্ক শেষ করতে পারবো। এর মাধ্যমে মামলাটির বিচার কার্যক্রম শেষ হবে। অতঃপর মামলাটি রায়ের জন্য প্রস্তুত হবে। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এসব মামলার জাজমেন্ট দেয়ার জন্য সাধারণত ১৫ দিন থেকে ৩ মাসের সময় নেয়া হয়। অতঃপর মামলার জাজমেন্ট দেয়া হয়। তবে এ ব্যাপারটি সম্পূর্ণ ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার। এভাবেই মানবজমিনকে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা মামলার বিচার কার্যক্রমের অগ্রগতি সম্পর্কে জানাচ্ছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম।
তিনি বলেন, এই মামলার সাধারণ সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। এরপর মামলার জব্দ তালিকার সাক্ষী ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার সাক্ষ্য গ্রহণের পরেই প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে মামলাটির বিচারিক কার্যক্রম শেষ হবে। পরে আসামি পক্ষের আইনজীবী চাইলে তাদের সাক্ষী উপস্থাপন করতে পারবেন। অথবা মামলাটি যুক্তিতর্কের দিকে এগুবে। অতঃপর মামলাটি রায়ের জন্য পরিপূর্ণ প্রস্তুত হবে। তবে, মামলার আসামি শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান কামাল পলাতক থাকায় তাদের পক্ষে কোনো সাক্ষী উপস্থাপন করা হবে না বলে মানবজমিনকে জানিয়েছেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আসামি পক্ষের আইনজীবী আমির হোসেন। তিনি বলেন, যেহেতু তার আসামি দুজনই পলাতক আছেন, সেহেতু তাদের পক্ষে আর সাক্ষী দেয়ার সুযোগ নাই।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গত ১লা জুন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন। পরে, ১০ই জুলাই আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিয়ে বিচার শুরুর আদেশ দেন বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। এই মামলায় বাকি আসামিরা হলোÑ সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। তবে চৌধুরী মামুন দোষ স্বীকার করে মামলার অ্যাপ্রুভার (রাজসাক্ষী) হয়েছেন। তিনি ইতিমধ্যে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষীর জবানবন্দি দিয়েছেন।
এই মামলায় শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মোট পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়। জুলাই-আগস্টে ১৪০০ মানুষকে হত্যা এবং ২৫ হাজার মানুষ আহত করাসহ, হত্যা, হত্যাচেষ্টা, ষড়যন্ত্র, সহায়তা, প্ররোচনা, উস্কানি, সম্পৃক্ততার পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে। এই পাঁচ অভিযোগে সুনির্দিষ্টভাবে মোট ১৩ জনকে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। আসামিদের জ্ঞাতসারে এসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। এই মামলায় এখন পর্যন্ত ৫৩ জন সাক্ষী তাদের জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দি শেষে তাদের জেরা করেন, আসামি পক্ষের রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। এ পর্যায়ে সাক্ষ্যর জবানবন্দি দিচ্ছেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. আলমগীর। আজ তিনি দ্বিতীয় দিনের মতো সাক্ষ্যের জবানবন্দি দিবেন।
পরিপূর্ণ সত্য প্রকাশ করেছে চৌধুরী মামুন: পুলিশের সাবেক আইজি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন এই মামলায় রাজসাক্ষী দিয়েছেন। তার সাক্ষীর ব্যাপারে প্রসিকিউশন সন্তুষ্ট বলে মন্তব্য করেন মিস্টার মিজানুল ইসলাম। তিনি বলেন, চৌধুরী মামুন সম্পূর্ণ সত্য প্রকাশ করেছেন বলে আমরা মনে করি। এখন ট্রাইব্যুনাল তার জবানবন্দি পর্যালোচনা করে তাকে খালাস দিবে কিনা সেই সিদ্ধান্ত নিবেন।
ওবায়দুল কাদের সহ ভিআইপিদের বিরুদ্ধে খুব শিগগিরই আলাদা প্রতিবেদন দাখিল হবে: জুলাই অভ্যুত্থানের সময় সংগঠিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও মাহবুব-উল আলম হানিফ, সালমান এফ রহমানসহ ৪৫ আসামির বিরুদ্ধে তদন্ত জোরালো হচ্ছে। এদের মধ্যে তৎকালীন সরকারের মন্ত্রী-এমপি, বিচারপতি ও সরকারি কর্মকর্তা রয়েছেন। এসব আসামির বিরুদ্ধে জুলাই আন্দোলনে মানবতাবিরোধী অপরাধের হুকুমদাতা, অর্থদাতা ও পরিকল্পনাকারী হিসেবে অভিযোগ তদন্ত হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী মনোয়ার হোসাইন তামিম, তৎকালীন সরকারের এসব ভিআইপি রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে পৃথক (ব্যক্তিগত দায়) তদন্ত চলছে। তবে যার সঙ্গে যার অপরাধের মিল রয়েছে। এদেরটা একসঙ্গে রেখে বাকি আসামিদের বিরুদ্ধে আলাদা তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের বিরুদ্ধে আলাদা প্রতিবেদন দাখিল হবে। প্রতিটি মামলায় দু’তিনজন করে আসামি হবে।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার শাসনামলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো দ্বারা গুম, খুন ও জুলাই-আগস্টে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে এখন পর্যন্ত ৫০০টিরও বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে। এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে ট্রাইব্যুনালে ৩১টি বিবিধ মামলা দায়ের হয়েছে। এরমধ্যে গুমের অভিযোগে ৫টি মামলার তদন্ত চলমান। বাকি ২৬টি মামলা জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে চলা হত্যাকাণ্ড ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দায়ের করা। এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে ৬টি মামলার ফরমাল চার্জ দাখিল করা হয়েছে। এসব মামলায় মোট আসামি ২৪৬ জন। গ্রেপ্তার রয়েছে ৮১ জন। এদের মধ্যে ৮ জনকে একাধিক মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। কারাগারে মৃত্যুবরণ করেছেন ১ জন।
অধিকাংশ মামলাই যাচ্ছে পরবর্তী সরকারের উপর: জুলাই আন্দোলনের ঘটনায় ৬টি মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার কার্যক্রম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চলমান রয়েছে। তদন্ত সংস্থায় জনবল সংকটসহ নানা প্রতিবন্ধকতার ফলে, গুম, খুনসহ বিগত সরকারের আমলে সংঘটিত বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগে দায়ের করা অন্যান্য মামলার প্রতিবেদন দিতে সময় লাগছে।
তৎকালীন সরকারের সাবেক মন্ত্রী আনিসুল হক, তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, রাশেদ খান মেনন, সাবেক মন্ত্রী আমির হোসেন আমু, মো. আব্দুর রাজ্জাক, কামরুল ইসলাম, মুহাম্মদ ফারুক খান, দীপু মনি, গোলাম দস্তগীর গাজী, সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, কামাল আহমেদ মজুমদার, সাবেক এমপি সোলায়মান মোহাম্মদ সেলিম, সাবেক সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম ও অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক সহ ১৬ জন গ্রেপ্তার থাকা ভিআইপি আসামিদের বিরুদ্ধে করা মামলার তদন্তকাজ চলমান রয়েছে। গত ২৫শে সেপ্টেম্বর সাবেক মন্ত্রী ও জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুর বিরুদ্ধে ৮টি অভিযোগে দায়ের করা তদন্ত প্রতিবেদন আমলে নিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল-২। বাকি আসামিদের বিরুদ্ধে এখনো তদন্ত প্রতিবেদন দায়ের করতে পারেনি প্রসিকিউশন।
আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন পরবর্তী সরকারের উপর এসব মামলার বিচারের দায়ভার যাচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম বলেন, এসব মামলার তদন্ত প্রতিবেদন খুব দ্রুতই সম্পন্ন হবে এমনটি মনে করার সুযোগ নাই। তবে আগামী ১৫ই অক্টোবরের মধ্যে বেশ কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী ও রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে করা মামলার তদন্ত সম্পন্ন হবে এবং ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হবে।
অধিকাংশ মামলার দায়ভার কোন সরকারের আমলে যাবে, তা নিয়ে প্রসিকিউশন কোনো বক্তব্য দিবে না। তবে, প্রসিকিউশন তাদের কাজ করে যাচ্ছে, আইন তার স্বাভাবিক গতিতে চলবে। সময় নির্ধারণ করে দেয়া প্রসিকিউশনের দায়িত্ব না। আমরা চেষ্টা করবো মামলার তদন্ত শেষ হলে, দ্রুত প্রতিবেদনটি আদালতের হাতে তুলে দিতে।
আসামিপক্ষের আইনজীবীকে হুমকি: এই মামলায় রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন মানবজমিনকে বলেন, বেশ কিছুদিন যাবৎ তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন ভাবে হুমকি-ধমকি পাচ্ছেন। তিনি বলেন, অপ্রত্যাশিত এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে আমি হাতিরঝিল থানায় মৌখিক অভিযোগ করলে, থানা স্টাফ আমার বাসায় এসে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়ে গেছেন।
তিনি বলেন, এই মামলায় সাক্ষীদের জেরা করার সময় তিনি ট্রাইব্যুনালকে নানা সাজেশন দিয়েছেন। এসবই হচ্ছে ন্যায়বিচারের স্বার্থে। মামলার প্রয়োজনেই এসব সাজেশন দিতে হয় এবং ভালোভাবেই সাক্ষীদের জেরা সম্পন্ন করেছেন।
তিনি বলেন, এই আইনটি হচ্ছে আসামিদের ন্যায়বিচার পাওয়ার আইন। যদি দশটি বিষয়ের মধ্যে দু’-একটি বিষয়ও আসামিদের পক্ষে যায়। এসব বিষয়গুলো খুব জোরালো ও যুক্তিযুক্ত, তাহলে ট্রাইব্যুনাল চাইলে আসামিদের খালাস দিতে পারে। তিনি ট্রাইব্যুনালের কাছে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করেন।