Image description
সরজমিন মুন্সীগঞ্জ

সিরাজদিখান-শ্রীনগর উপজেলা নিয়ে মুন্সীগঞ্জ-১ আসন। আসনটি বিএনপি’র দুর্গ বলে খ্যাত। এ আসনে পাঁচবার বিএনপি থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। ২০০৮ সালের পর অবশ্য পরিস্থিতি বদলে যায়। বিতর্কিত ভোটে চারবার এমপি হন আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের প্রার্থী। আসছে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেই- এটা প্রায় নিশ্চিত। এই অবস্থায় এই আসনে বিএনপি’র সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ হাজির হয়েছে। দলীয় কোন্দল আর ইসলামী দলগুলোর  সম্ভাব্য জোট ভোটের রাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলবে- এমনটাই বলাবলি হচ্ছে পুরো এলাকা জুড়ে। গত কয়েকদিন সরজমিন ঘুরে পাওয়া গেছে রাজনীতির নানা হালচিত্র।

রাজধানী ঢাকার পাশের জেলা মুন্সীগঞ্জ। ঢাকার প্রবেশপথ যাত্রাবাড়ী থেকে ৪০ মিনিটের দূরত্বে শ্রীনগর-সিরাজদিখান উপজেলা। প্রবাসী আয়ে তরতর করে বদলেছে এখানকার গ্রামের চিত্র। নির্জন ফসলি জমির মাঝেও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে পাকা ঘরবাড়ি। দুই উপজেলার প্রায় ১০টি গ্রামের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা হয়। তাদের একটাই কথা ভোট হোক। ভোট দেন না তারা বহুদিন। তারা একতরফা ভোটে সর্বশেষ সংসদ সদস্য মহিউদ্দীনের দেখাও পাননি এলাকায়। বিএনপি অধ্যুষিত এলাকা হলেও আওয়ামী লীগের দাপটে কোণঠাসা হয়ে ছিলেন তারা। 

সিরাজদিখান উপজেলায় কৃষির প্রভাবটা ব্যাপক। এই এলাকার চন্দনধুল, আবির পাড়া, ইছাপুর, রাইজদি এলাকা ঘুরে কথা হয় নানান বয়সী ও ভিন্ন পেশার মানুষের সঙ্গে। তারা বলছেন, ভোটের দিক দিয়ে বিএনপিই এগিয়ে। তবে নীরবে এগিয়ে যাচ্ছে ইসলামী ঘরানার দলগুলো। এসব দল একসঙ্গে কাজ করলে বিএনপি’র জন্য বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে। 
স্থানীয় মৃধাবাড়ি বাজারে এক আড্ডায় কথা বলছিলেন কয়েকজন। আলোচনায় ব্যাংক কর্মকর্তা সাইদুল মিয়া বলেন, আওয়ামী লীগ দেশটাকে শেষ করে দিয়েছে। মানুষ ব্যাংকেও টাকা রেখে শান্তি পায় নাই। আমরা দেখেছি সাধারণ মানুষকে এক লাখ টাকা ঋণ পেতে কতো কিছু করা লাগতো। আর আওয়ামী লীগের নেতারা এই নিয়মকানুন কিছুই মানে নাই। 
তিনি বলেন, এখন নির্বাচন হওয়াটা খুব জরুরি। প্রশাসন ঠিক না হলে দেশে শান্তি আসবে না। নির্বাচন না হওয়ায় এখন সবাই নেতা। পিআর সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পিআর আসলে হয়তো এমন লোক এমপি হবে যাকে আপনি চান না। 

আলোচনার মাঝেই নিরঞ্জন সাহা সবাইকে চা এনে দিলেন। আশরাফুল ইসলাম কাপড়ের দোকান চালান। তিনি বলেন, যেই আসুক নির্বাচন হওয়া দরকার। তারা বলেন, বিএনপি এই এলাকায় সবসময়ই ভালো অবস্থানে ছিল। ধানের শীষ মার্কার কদর আছে। কিন্তু গ্রুপিংয়ের কারণে নেতিবাচক হয়ে উঠেছে তাদের অবস্থান। অপরদিকে জনপ্রিয়তা  দেখা যাচ্ছে ইসলামী ঘরানার লোকদের মাঝে। একই বাজারে কথা হয় আরও অনেকের সঙ্গে।  কথা বলা ব্যক্তিদের ১৮ জন বলেছেন নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে চান না। ১৩ জন বলেছেন না আসাই ভালো। ৯ জন বলেছেন, নৌকা থাকলে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। এই ৪০ জনের মধ্যে নারী ১২ জন। কথা বলাদের ১৬ জন কলেজ  লেভেল পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। কথা বলা এই ৪০ জনের মধ্যে পিআর ও উচ্চকক্ষ নিয়ে স্বচ্ছ ধারণা আছে মাত্র ৬ জনের। আর নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতে হওয়া উচিত এটার পক্ষে কথা বলেন মাত্র দু’জন। তার মধ্যে একজন বলেছেন, জামায়াত যেহেতু পিআরের পক্ষে এ কারণে আমি পিআর চাই। এটা তার দলীয় মনোভাব। আরেকজন দোকানদার ইব্রাহীম মোল্লা বলেন, আমরা অনেকেই ভোট দেই কিন্তু প্রার্থী হেরে গেলে তার মূল্য থাকে না। ভোটের মূল্য সঠিক হওয়ার জন্য পিআর প্রয়োজন।

জামায়াতের স্থানীয় কর্মী  তরিকুল ইসলাম বলেন, রাজনৈতিক গুরুত্ব বৃদ্ধির জন্য জামায়াত এটা চেয়েছে। বার্গেনিং ইস্যু। তবে এটা হয়তো তারাও চান না। পলীগাঁও এলাকায় একটা বেঞ্চে বসে ছিলেন দুইজন। ষাটোর্ধ্ব দুই বন্ধু। তাদের পাঁচ সন্তান দেশের বাইরে। তারা বলেন, বিএনপি’র প্রভাব থাকলেও প্রত্যেক নেতার আছে আলাদা ভোটব্যাংক। দলীয় কোন্দলের মুখে পিছিয়ে যেতে পারেন। আনোয়ার আলী বলেন, গ্রামের আমজনতা যারা বিশেষ করে মহিলা ভোটাররা ইসলামী দলের দিকে ঝুঁকবে। ভোটে এগিয়ে যাবে।

ছনবাড়ি, শিলপাড়া এলাকায় কথা হয় বেশ কয়েকজন জেলের সঙ্গে। নদী ঘেরা এই এলাকায় মাঝির সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। অঝোর সাহার আক্ষেপ খালে আর আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। তিনি যৌবনে দেখা সময়ের কথা তুলে ধরে বলেন, সারা দিনে দুই তিন ঝাঁপি মাছ ধরতাম। একেক ঝাঁপিতে ৫/৬ কেজি করে মাছ উঠতো। এখন সারা দিনে ৩/৪ কেজির বেশি মাছ উঠে না। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সময় ভয়ে থাকতাম। আমার মাছ পর্যন্ত নেতারা বাকিতে নিয়া যাইতো। অনেকে টাকাও দিতো না। এখন ভয় হইছে অন্যরকম। পূজার সময়, কখন কোন হিন্দুপাড়ায় হামলা হয়। যদিও কোনো অপ্রীতিকর অবস্থায় পড়েননি বলে জানান তিনি। 

চন্দনধুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক রফিকুল ইসলাম বলেন, এখন স্কুলে সভাপতি কে হবে এটা নিয়ে কোনো প্রেশার নাই। যা আগে ছিল। স্কুলে কোনো সমস্যা নাই জানিয়ে তিনি বলেন, ৫ই আগস্টের পর একদল লোক শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনার ছবি নামানোর কথা বলেছিল, আমরা নামিয়ে ফেলছি।
এই এলাকার একজন মসজিদের মুয়াজ্জিম বিল্লাল হোসেন বলেন, আগে ধর্মের কথা বলতেও ভয় লাগতো। এখন দাওয়াতের কাজ বেশি করে করতে পারি। আগে কেউ কিছু বলে নাই কিন্তু একটা ভয় ছিল।
শ্রীনগর থেকে ঢাকার দূরত্ব খুব বেশি না। এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে চলাচল। যার কারণে এই এলাকায় মানুষের ব্যবসাকেন্দ্রিক যোগাযোগটা খুবই বেশি। ফলে এই এলাকায় রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব খুব একটা নেই। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা অনেকেই এলাকাতেই আছেন। শ্রীনগর যুবলীগের এক নেতা বলেন, আওয়ামী লীগ চলে যাওয়ার পর মাস খানেক পালিয়ে ছিলাম। এরপরই এলাকায় চলে আসছি। আমার চালের ব্যবসা। এখনো করে যাচ্ছি। আমি কারও সঙ্গে জুলুম করি নাই। এজন্য এখন এলাকায় টিকে থাকতে পারছি।

মুন্সীগঞ্জ-১ আসনে বিএনপি’র স্থানীয় ৩টি গ্রুপ সক্রিয়। তবে ভোটের অঙ্কে বিএনপি প্রার্থীই এগিয়ে থাকবেন বলে মনে করেন স্থানীয়রা। জামায়াতের প্রার্থী কাজ করছেন মাঠে। মাঠে নেই এনসিপি। বিএনপি’র কেন্দ্রীয় কমিটির স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক মীর সরফত আলী সপু, মুন্সীগঞ্জ জেলা বিএনপি’র আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও সিরাজদিখান উপজেলা বিএনপি’র সভাপতি শিল্পপতি শেখ মো. আব্দুল্লাহ, শ্রীনগর উপজেলা বিএনপি’র সাবেক সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ মমিন আলী দলীয় প্রার্থী হতে প্রচারণা চালাচ্ছেন।  

এই আসনে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে মুন্সীগঞ্জ জেলা জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি অধ্যাপক মাওলানা এ কে এম ফখরুদ্দীন রাজীকে। এই আসনে হেফাজত ইসলামের সহ-সভাপতি ও খতমে নবুওয়াত আন্দোলনের আমীর মধুপুরের পীর সাহেব আল্লামা আব্দুল হামিদ প্রার্থী হতে পারেন এমন আলোচনাও আছে। এই আসনে ইসলামী আন্দোলনেরও ভোট রয়েছে। অনেকেই মনে করছেন ইসলামী দলগুলো জোট হয়ে এই আসনে প্রার্থী দিলে বিএনপি’র প্রার্থীর জন্য তা চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে।