
বাংলাদেশি পর্বতারোহী ডা. বাবর আলী নতুন ইতিহাস গড়লেন। পৃথিবীর অষ্টম উচ্চতম পর্বত মানাসলু শৃঙ্গ জয় করলেন তিনি। কৃত্রিম অক্সিজেন ছাড়াই এটিই প্রথম কোনো বাংলাদেশির শৃঙ্গ জয়। এই পর্বত অভিযানে বাবরের সঙ্গে ছিলেন আরেক বাংলাদেশি পর্বতারোহী তানভীর আহমেদ।
আট হাজার মিটারের অধিক উচ্চতার পর্বত আছে পৃথিবীতে চৌদ্দটি। ওই উচ্চতায় অক্সিজেন থাকে ভূপৃষ্ঠের তুলনায় এক তৃতীয়াংশ। ফলে মানবদেহ সচল রাখতে পর্বতারোহীরা ব্যবহার করেন কৃত্রিম অক্সিজেন। আর বাংলাদেশের স্বনামধন্য পর্বতারোহী ডা. বাবর আলী ইতিহাস গড়লেন প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে কৃত্রিম অক্সিজেন ছাড়াই আটহাজারি শিখর আরোহণ করে।
তিনি গতকাল শুক্রবার ভোর ৪টা ৪৫ মিনিটে স্পর্শ করেছেন পৃথিবীর অষ্টম সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট মানাসলু (২৬,৭৮১ ফুট) চূড়া। এটি বাবরের ৪র্থ আটহাজারি শৃঙ্গে সফলতা। বাবর ছাড়াও শিখরে ছিলেন বাংলাদেশের আরেক পর্বতারোহী তানভীর আহমেদ।
তানভীর ভোর ৩টা ৪০ মিনিটে লক্ষ্যে পৌঁছান। এটি তানভীরের প্রথম আটহাজারি শিখর অভিযান ও প্রথম অভিযানেই এসেছে এই সাফল্য। গণমাধ্যমকে খবরটি নিশ্চিত করেছেন এই অভিযানের ব্যবস্থাপক ফরহান জামান। এই অভিযানের আউটফিটার স্নোয়ি হরাইজন ট্রেক্স এন্ড এক্সপিডিশনের সত্ত্বাধিকারী বোধা রাজ ভান্ডারির সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
‘মানাসলু অ্যাসেন্ট : ভার্টিক্যাল ডুয়ো’ শীর্ষক এই অভিযানের আয়োজক পর্বতারোহণ ক্লাব ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স। ক্লাবটির সভাপতি ও অভিযান ব্যবস্থাপক ফরহান জামান বলেন, ‘বিশ্বের অষ্টম শীর্ষ পর্বত মানাসলুতে একই দিনে দুইবার উড়ল আমাদের লাল-সবুজের পতাকা। নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ নিতে অভ্যস্ত বাবরের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল অতিরিক্ত অক্সিজেন ছাড়া আটহাজারি শিখর আরোহণের। উচ্চতার সাথে মানিয়ে নেওয়ার পর আমরা চূড়ান্তভাবে ঠিক করি যে এই মানাসলুই হবে কাক্সিক্ষত সেই চেষ্টার পর্বত। আজ প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে বাবর আলী কৃত্রিম অক্সিজেন সহায়তা ছাড়াই আরোহণ করেছে এই আটহাজারি শৃঙ্গ। আমাদের অপর পর্বতারোহী তানভীরের এটি প্রথম আটহাজারি অভিযান। ইতোপূর্বে আটহাজারি শিখরে সফল সব বাংলাদেশি পর্বতারোহীই পর্বতারোহণের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রাপ্ত। এ থেকে অনেকের ধারণা ছিল, অতি-উচ্চ পর্বতে সফলতা পেতে বিদেশে গিয়ে মাউন্টেনিয়ারিং কোর্সের বিকল্প নেই। এই ধরণের কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তানভীরের নেই। ওর সম্বল দেশে সীমিত সুবিধার মধ্যে অনুশীলন আর ইচ্ছাশক্তি। তাই মাউন্টেনিয়ারিং কোর্স সংক্রান্ত ওই ট্যাবু আমরা ওকে দিয়ে ভাঙতে চেয়েছি। দুজনের কঠোর পরিশ্রমের উপর আমরা আস্থা রেখেছি এবং দুজনেই আজ সফল হয়েছে। একজন করেছে অতিরিক্ত অক্সিজেন ছাড়া সামিট এবং অপরজন দেশে শিখেই হয়েছে সফল। বাবর আলীর এভারেস্ট-লোৎসে, অন্নপূর্ণা-১ সামিটের পর দেশে পর্বতারোহণ নতুন গতি পেয়েছে। ইতিহাসের নতুন অধ্যায়ের সূচনা করা এবারের অর্জন নিঃসন্দেহে একে আরও বেগবান করবে।’
তানভীর ও বাবর বাংলাদেশ থেকে নেপালে গিয়েছেন ৫ সেপ্টেম্বর। প্রস্তুতিমূলক কাজ শেষ করে ৭ সেপ্টেম্বর তারা কাঠমান্ডু থেকে গাড়িতে যান তিলচে গ্রামে। এরপর পাঁচ দিন হেঁটে তাঁরা পৌঁছে যান বেসক্যাম্পে। সেখানে দুইদিন বিশ্রাম তারা শুরু করেন উচ্চতার সাথে মানিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়া। প্রথম দফা ক্যাম্প-১ (৫৭০০ মিটার) এ এক রাত কাটিয়ে তারা নেমে আসেন। একদিন বিশ্রামের পর দ্বিতীয় দফা আরোহণে তানভীর ক্যাম্প-২ (৬৩০০ মিটার) এবং বাবর ক্যাম্প-৩ (৬৭০০ মিটার) এ রাত কাটিয়ে শেষ করেন উচ্চতার সাথে মানিয়ে নেয়ার পর্ব।
একদিন বেসক্যাম্পে বিশ্রামের পর আসে চূড়ান্ত চেষ্টার ক্ষণ। তানভীর ২২ সেপ্টেম্বর বেসক্যাম্প থেকে যাত্রারম্ভ করে উঠে আসেন ক্যাম্প-১ এবং পরদিন উঠে আসেন ক্যাম্প-২। এদিকে বাবর একদিন পর রওনা দিয়ে সরাসরি উঠে আসেন ক্যাম্প-২ এ। ২৪ সেপ্টেম্বর দুইজনেই ক্যাম্প-৩ তে রাত কাটিয়ে পরদিন দুপুর নাগাদ পৌঁছে যান ক্যাম্প-৪ এ (৭৪০০ মিটার)। বাকিবেলা বিশ্রাম করে রাত নামতেই শুরু হয় তাদের পরম আরাধ্য চূড়ার দিকে যাত্রা। আর ২৬ সেপ্টেম্বর ভোরেই তারা পৌঁছে যান পর্বত শীর্ষে। শিখরে এই দুইজনের সাথে গাইড হিসেবে ছিলেন বীরে তামাং এবং ফূর্বা অংডি শেরপা। তারা এখন চেষ্টা করবেন যত দ্রুত যতটা সম্ভব নিচে নেমে আসতে। নেটওয়ার্কের বাইরে থাকায় শিখরের ছবি পেতে কিছুটা সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন ক্লাব কর্তৃপক্ষ।
ফরহান জামান আরো বলেন, ‘তানভীর আরও অনেক পর্বতে যেতে চায়। আর বাবরও চায় ১৪টি আটহাজারি শৃঙ্গের সবকটিতেই চড়তে। সবেমাত্র ৪টি হলো, বাকি আছে আরও ১০টি। আশা করি পর্যাপ্ত পৃষ্ঠপোষকতা পেলে চলতে থাকবে পর্বত থেকে পর্বতে লাল-সবুজের পতাকা উড্ডয়ন উৎসব।’ উল্লেখ্য যে, এই দুঃসাহসিক অভিযানে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন সামুদা, ভিজুয়াল নিটওয়ারস, গিগাবাইট বাংলাদেশ, চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন, সিনোভেস্ট, সিয়েরা-রোমিও, আদিবা ফুটওয়্যার, ফোরএস অ্যাডভান্স টেকনোলজিস, জেনোভার্স, সোর্স এসোসিয়েটস, আইলেট ব্যাংকার্স, কাজী এগ্রো এবং ফ্রিয়েসভা।
বাবর আলী দেশের শীর্ষস্থানীয় পর্বতারোহণ ক্লাব ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স এর সাধারণ সম্পাদক এবং তানভীর আহমেদ এই ক্লাবের মাউন্টেনিয়ারিং বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বরত। তানভীর গতবছর অন্যতম টেকনিক্যাল চূড়া আমা দাবলাম সামিট করেন, প্রথম বাঙালি হিসেবে যেই পর্বত ২০২২ সালে সামিট করেছিলেন বাবর। ‘ভিএফ এশিয়া বাংলাদেশ’ এর এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত তানভীর কিশোরগঞ্জ সদরের খরমপট্টি নিবাসী এড. তারেক উদ্দিন আহমদ এবং শিরীন আহমেদ এর প্রথম সন্তান এবং নিজেই এক কন্যা সন্তানের পিতা। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি এর ২০০৬ ব্যাচের ছাত্র ছিলেন। আর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ৫১তম ব্যাচে ডাক্তারি পাশ করা ডা. বাবর আলী চট্টগ্রামের হাটহাজারি উপজেলার নজুমিয়া হাটের লেয়াকত আলী এবং লুৎফুন্নাহার বেগমের দ্বিতীয় সন্তান।