
সুনামগঞ্জ শহরের উকিলপাড়ায় বসবাস করতেন হবিগঞ্জের নবীপুর গ্রামের প্রণয় দাসের স্ত্রী আঁখি চৌধুরী ও তার মেয়ে প্রথমা চৌধুরী। এই পরিবারের এখন আর কেউ জীবিত নেই। সবাই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। এক সময় চারজনের সংসার ছিল তাদের। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা কেড়ে নিয়েছে একজনের পর একজনকে। দুই বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান এই পরিবারের কর্তা প্রণয় দাশ। সেই আঘাত সামলে উঠতে না উঠতেই শুক্রবার সকালে আবারও সড়ক দুর্ঘটনা নিভে গেল পরিবারের বাকি আলো। একই দুর্ঘটনায় নিহত হন প্রণয়ের স্ত্রী আবাদিত কেশবা (৪০) ও একমাত্র কন্যা ৮ম শ্রেণির ছাত্রী প্রথমা চৌধুরী (১৩)। প্রথমা শহরের সতীশ চন্দ্র বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন। এইদিকে তাদের সঙ্গে প্রাণ হারান সিএনজি চালক সজল ঘোষ (৫০)। আজমিরিগঞ্জের জলসুখা গ্রামের সজল সিএনজি দিয়েই সুনামগঞ্জ শহর থেকে হবিগঞ্জ যাচ্ছিলেন তারা। সজল ঘোষও পরিবার নিয়ে সুনামগঞ্জ শহরের নবীনগরে বসবাস করেন। উভয় পরিবার ইসকন অনুসারী ও পূর্বপরিচিত। সজলের মৃত্যুতে তার পরিবারেও নেমে এসেছে শোকের ছায়া।
পরিবারের উপার্জনশীল একমাত্র ব্যাক্তি ছিলেন তিনি। নিহত সজলের স্ত্রী, ১ ছেলে ও ১ মেয়ে রেখে গেছেন। পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গতকাল শুক্রবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে শান্তিগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম পাগলা ইউনিয়নের বাঘেরকোনা গ্রামের পুরান বাড়ির সামনে সিলেট-সুনামগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কে এ ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। সিলেট থেকে সুনামগঞ্জমুখী দ্রুতগতির একটি ট্রাক-সিলেটমুখী সিএনজিকে সরাসরি ধাক্কা দিলে সিএনজিটি দুমড়েমুচড়ে ঘটনাস্থলেই কেশবা ও চালক নিহত হন। গুরুতর অবস্থায় প্রথমাকে হাসপাতালে নেয়া হলে তারও মৃত্যু হয়। শান্তিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ইকবাল হাসান বলেন, হাসপাতালে আনার আগেই তিনজনই মারা যান। আমরা শুধু মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছি। স্থানীয় বাসিন্দা শাহীন মিয়া জানান, ঘুম থেকে বিকট শব্দে চমকে উঠি। দৌঁড়ে গিয়ে দেখি ট্রাকটি পানিতে পড়ে আছে আর সিএনজি পিষে গেছে। রাস্তায় মরদহগুলো পড়েছিল। নিহতদের আত্মীয় গোবিন্দ কুমার দাশ কণ্ঠ ভারী করে বলেন, দুই বছর আগে প্রণয় দাশকে হারিয়েছিলাম।
আজ তার স্ত্রী আর মেয়ে চলে গেল। পরিবারের আর কেউ নেই। দুর্ঘটনার পর ক্ষুব্ধ জনতা ঘাতক ট্রাকের চালক পারভেজ আহমদকে (৩০) আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেন। তিনি সিলেটের বাদামবাগিছার বাসিন্দা ও দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়া ইউনিয়নের মৃত জালাল উদ্দিনের ছেলে। উকিলপাড়ার শুভ নামে একজন বলেন, গতকাল যে বাড়িতে ছিল হাসি আনন্দে ভরা, আজ সেখানে কেবল শোকের মাতম। সবাই বলছেন, একটি পরিবার একের পর এক দুর্ঘটনা এভাবে শেষ হয়ে গেল। শিক্ষক বাকী বিল্লা আখঞ্জি বলেন, শুক্রবার রাত ১১টার দিকে প্রথমা মেসেজ দিয়ে জানিয়েছিল স্যার সকালে হবিগঞ্জ গ্রামের বাড়িতে যাবো। কয়েকদিন প্রাইভেটে আসতে পারবো না। তিনি বলেন, প্রথমার আর হবিগঞ্জ যাওয়া হলোনা। সে চলে গেছে বহুদূরে। তার বাবা নেই। তার মা বলতো স্যার আপনিই প্রথমার অভিভাবক। আপনার কাছেই তার দায়িত্ব দিলাম। সুনামগঞ্জ জজ কোর্টের আইনজীবী ফরহাদ উদ্দিন ফারুক বলেন, সুনামগঞ্জ-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়ক এখন মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। রাস্তাটি সংকীর্ণ ও আঁকাবাঁকা। পাশাপাশি ফিটনেসবিহীন যানবাহনও চলাচল করছে। এখনই পদক্ষেপ না নিলে আরও অনেক পরিবার নিঃশেষ হয়ে যাবে। শান্তিগঞ্জ থানার ওসি আবদুল আহাদ বলেন, ঘাতক ট্রাকচালককে আটক করা হয়েছে। ট্রাক ও সিএনজি জব্দ করা হয়েছে। আইনি প্রক্রিয়া চলমান।