Image description

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ও আলোচিত অপরাধ। প্রায় এক দশক পেরিয়ে গেলেও এখনও পুরো অর্থ দেশে ফেরত আসেনি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আদালতের রায় ও ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের (আরসিবিসি) ৮১ মিলিয়ন (৮ কোটি ১০ লাখ) ডলার বাজেয়াপ্তের প্রক্রিয়া নতুন করে আশা জাগাচ্ছে। যদিও চুরি হওয়া রিজার্ভের আর্থিক পরিমাণ সীমিত, তবে মনস্তাত্ত্বিক ও কৌশলগত দিক থেকে এর তাৎপর্য বিশাল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “আমরা মনে করি, রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনে (আরসিবিসি) রাখা ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার বাজেয়াপ্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে পুরো অর্থ ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা আরও একধাপ এগিয়েছে।”

তিনি আরও বলেন, “আমাদের দেশ থেকে যাওয়া সম্পদ সে দেশে বাজেয়াপ্ত হওয়া মানেই এটি তাদের সম্পদ নয়। সেই অর্থ ফেরত আনার জন্য বাংলাদেশ সরকার এখন সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।”

আরিফ হোসেন খান জানান, গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর এ প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। বিশেষ করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), সিআইডি ও বিএফআইইউ’র কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছেন, যাতে শুধু রিজার্ভের টাকা নয়, বিভিন্ন দেশে পাচার হওয়া সব ধরনের অর্থ দ্রুত ফেরত আনা যায়।

বাজেয়াপ্তের নির্দেশনা

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রিজার্ভ চুরির মামলায় ফিলিপাইনের মাকাতি সিটির রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনে (আরসিবিসি) রাখা ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার বাজেয়াপ্ত করেছে দেশটির আদালত। রবিবার (২১ সেপ্টেম্বর) এ তথ্য নিশ্চিত করেছে সিআইডি। সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার জসীম উদ্দীন খান জানান, বাজেয়াপ্ত অর্থ দেশে ফেরত আনার প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।

উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে সুইফট কোড হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে প্রায় ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার হাতিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। এর মধ্যে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ফিলিপাইনে যায় এবং সেখান থেকে ক্যাসিনো চক্রের মাধ্যমে তা পাচার হয়ে যায়। বাকি ২ কোটি ডলার শ্রীলঙ্কায় গিয়েছিল, যা পরে ফেরত পাওয়া গেছে। তবে এখনও প্রায় ৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার ফেরত আসেনি।

দীর্ঘ আইনি লড়াই

এই টাকার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের বিভিন্ন সংস্থা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। নিউ ইয়র্কের ফেডারেল কোর্ট থেকে শুরু করে ফিলিপাইনের আদালত পর্যন্ত বহু মামলা-মোকদ্দমা হয়েছে।

২০২৩ সালে নিউ ইয়র্ক স্টেট কোর্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে রায় দিয়ে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে—‘‘আরসিবিসি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হ্যাকারদের সহায়তা করেছে। আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, যদি আরসিবিসি সহযোগিতা না করতো, তবে এই অর্থ চুরির কোনও সুযোগ থাকতো না।’’

এরই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে ফিলিপাইনের আদালত অর্থ বাজেয়াপ্তের নির্দেশ দিয়েছে। আদালত মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী সিআইডির আবেদনের ভিত্তিতে এই রায় দেয়।

টাকা ফেরত আসবে কবে?

যদিও বাজেয়াপ্তের নির্দেশ এসেছে, তারপরও টাকা ফেরত আসার প্রক্রিয়া জটিল হতে পারে। কারণ, অর্থ বাজেয়াপ্ত মানে এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে সরাসরি হস্তান্তর নয়। দেশ দুটির মধ্যে পারস্পরিক আইনি সহায়তা এবং আদালতের পরবর্তী সিদ্ধান্তে নির্ভর করছে ফেরতের গতি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “ফেডারেল কোর্টের অবজারভেশন আমাদের পক্ষে সহজ করেছে। তবে সমঝোতা হলে দ্রুত টাকা ফেরত পাওয়া সম্ভব। মামলা-মোকদ্দমায় গেলে সময় অনেক লাগতে পারে।”

তিনি আরও জানান, সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের বিভিন্ন দফতরের কর্মকর্তারা ফিলিপাইনে গিয়ে বৈঠক করেছেন। এমনকি ফিলিপাইনের বিচার বিভাগ বিনা খরচে মামলা পরিচালনার সুযোগও দিয়েছে।

সিআইডির আশা

রবিবার (২১ সেপ্টেম্বর) সংবাদ সম্মেলনে সিআইডি’র প্রতিনিধি দল জানিয়েছে, আরসিবিসি ব্যাংক তাদের আন্তর্জাতিক খ্যাতি ধরে রাখতে চাইলে শিগগিরই বাজেয়াপ্ত অর্থ বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবে। তবে কতদিনের মধ্যে ফেরত আসবে, সে বিষয়ে তারা সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানাতে পারেনি।

এখনও অমীমাংসিত প্রশ্ন

বাংলাদেশ ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ফিলিপাইনে মামলা করেছে। তবে অভিযুক্ত ব্যাংক আরসিবিসি রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছে। ফলে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি পেতে সময় লাগতে পারে।

এখন পর্যন্ত ফেরত আসেনি প্রায় ৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার। সেই অর্থের ভাগ্য নির্ভর করছে আইনি প্রক্রিয়া ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ওপর।

 সম্ভাবনা কতটুকু?

রিজার্ভ চুরির মামলায় ফিলিপাইনের আদালতের সর্বশেষ বাজেয়াপ্তের নির্দেশ বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য বড় সাফল্য। তবে আন্তর্জাতিক মানি লন্ডারিং আইন, আদালতের জটিলতা, আপিল প্রক্রিয়া এবং রাজনৈতিক-কূটনৈতিক সম্পর্কের কারণে ফেরত আসার গতি ধীর।

তবু আশা আছে— প্রথমত, নিউ ইয়র্ক ও ফিলিপাইনের আদালত দুটোই বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে রায় দিয়েছেন।

দ্বিতীয়ত, বাজেয়াপ্ত অর্থ এখন আইনিভাবে সুরক্ষিত।

তৃতীয়ত, ফিলিপাইন সরকার ইতিবাচক সহযোগিতা করছে এবং বিনা খরচে মামলা পরিচালনার সুযোগ দিয়েছে।

তবে আশঙ্কাও থেকে যাচ্ছে। মামলা-মোকদ্দমা দীর্ঘ হলে টাকা ফেরত আসতে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে। আবার সমঝোতার মাধ্যমে সমাধান হলে দ্রুতই ফেরত আসতে পারে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি শুধু একটি আর্থিক ক্ষতি নয়, বরং এটি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, ব্যাংকিং সিস্টেম ও আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির জন্যও এক বড় আঘাত। প্রায় ১০ বছর পর আজও টাকার একটি বড় অংশ উদ্ধার হয়নি। তবে সর্বশেষ বাজেয়াপ্ত নির্দেশ ও আদালতের পর্যবেক্ষণ আশা জাগাচ্ছে যে চুরি যাওয়া রিজার্ভ শিগগিরই দেশে ফেরত আসতে পারে।

পুরো অর্থ ফেরত এলে অর্থনীতিতে কতটুকু প্রভাব রাখবে

চুরি যাওয়া রিজার্ভ ফেরত আসা বাংলাদেশের জন্য শুধু অর্থনৈতিক স্বস্তি নয়, প্রতীকী বিজয়ও বয়ে আনবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর বহুমাত্রিক প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতিতে—

১. বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে স্বস্তি: বর্তমানে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ রয়েছে। যদি ৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার ফেরত আসে, তাহলে রিজার্ভে তাৎক্ষণিক স্বস্তি মিলবে। যদিও পরিমাণ তুলনামূলকভাবে সীমিত, তবে প্রতীকী দিক থেকে এটি বড় অর্জন।

২. আন্তর্জাতিক আস্থার পুনঃস্থাপন: রিজার্ভ চুরি ঘটনার পর আন্তর্জাতিক আর্থিক মহলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। চুরি হওয়া অর্থ ফেরত এলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এবং আইনি সক্ষমতা নিয়ে ইতিবাচক বার্তা যাবে। এতে ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সহজ হতে পারে।

৩. আইনি নজির স্থাপন: এই ঘটনা শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বব্যাপী ব্যাংক হ্যাকিং ও মানি লন্ডারিংয়ের বিরুদ্ধে একটি নজির তৈরি করবে। আদালতের রায় ও বাজেয়াপ্ত অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়া অন্যান্য দেশকেও সাহস জোগাবে।

৪. সরকারের রাজনৈতিক সাফল্য: চুরি হওয়া অর্থ ফেরত আনতে পারলে তা সরকারের জন্য বড় কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হবে। এতে জনগণের আস্থা বাড়বে এবং আন্তর্জাতিক পরিসরেও বাংলাদেশ ইতিবাচক আলোচনায় আসবে।

৫. অভ্যন্তরীণ সংস্কারের চাপ: বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অর্থ ফেরত আসার পরও মূল কাজ হবে ব্যাংকিং খাতের সাইবার নিরাপত্তা ও অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা জোরদার করা। না হলে ভবিষ্যতে এমন ঘটনার ঝুঁকি থেকে যাবে।