
ফেসবুকে ধর্ম নিয়ে অবমাননাকর উক্তি করা যুবক মহসিনকে গ্রেফতারের পর গত বুধবার রাতে কুমিল্লার হোমনা উপজেলার আসাদপুর গ্রামের পরিবেশ শান্ত থাকলেও পরের দিন বৃহস্পতিবার সকাল থেকে পরিবেশ উত্তপ্ত হওয়ার লক্ষণ শুরু হয়।
গত বুধবার রাতে ফেসবুকের কয়েকটি আইডি থেকে ধর্ম অবমাননার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার সকালে আসাদপুর হাজী সিরাজ উল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে কথিত সমাবেশের ডাক দেওয়া হয়। উপজেলা প্রশাসন বিষয়টি জানতে পেরে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে স্কুল মাঠে ও মাজার সংলগ্ন এলাকায় পুলিশ, সেনাবাহিনী এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করে সতর্ক অবস্থানে থাকেন।
কথিত প্রতিবাদ সমাবেশের নামে বিভিন্ন এলাকা থেকে সাধারণ লোকজনকে জড়ো করে হ্যান্ডমাইকে ঘোষণা দিয়ে নানাভাবে উত্তেজিত করে তোলা, পরে মব সৃষ্টি করে স্কুল মাঠ থেকে অনতিদূরে চারটি মাজার ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ এবং মাজার সংলগ্ন তিনটি বাড়িতে হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটায় ত্বরিকতবিরোধী মাজার বিদ্বেষীরা। জনমনে প্রশ্ন, হোমনার এই ঘটনার মধ্যদিয়ে মব সংস্কৃতির পুনরাবৃত্তি ঘটানো হোতারা কারা? গত বুধবার রাতে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে কথিত প্রতিবাদ সমাবেশের গুজব ছড়ানো চক্রটি কারা?
এদিকে এ ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত বা ভুক্তভোগীদের কেউ মামলা করতে এগিয়ে না আসায় হোমনা পুলিশের পক্ষ থেকে একজন সাব ইন্সপেক্টর বাদী হয়ে অজ্ঞাত পরিচয়ের দুই হাজারের বেশি লোককে আসামি করে মামলা করেছেন। এই মামলার গ্রেফতার আতঙ্কে বাড়িঘরের পুরুষদের অনেকেই গত শুক্রবার থেকে ঘরছাড়া। এখনও থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে আসাদপুর গ্রামে। হামলার শিকার মাজার সংশ্লিষ্ট লোকজন নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে এখনও আতঙ্কিত।
স্থানীয়রা বলছেন, একটি চক্র আসাদপুর স্কুল মাঠে নবী (সা.) অবমাননার প্রতিবাদে সমাবেশ হবে বলে বিভিন্নভাবে প্রচার চালায় এবং বৃহস্পতিবার সকাল অন্তত ৯-১০টা পর্যন্ত আসাদপুর ছাড়াও আশপাশের গ্রাম থেকে লোকজন জড়ো করে পূর্বপরিকল্পিতভাবে মাজারগুলোতে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটায়। স্থানীয় সচেতন মহলেরও প্রশ্ন, চক্রটি কারা?
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, ‘কুমিল্লা পশ্চিমের সভাপতি মাওলানা তাজুল ইসলাম জানান, গত বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে সাড়ে ৮টার দিকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার ফোন পেয়ে আসাদপুর স্কুল মাঠে গিয়ে দেখি বিভিন্ন স্থান থেকে মিছিল নিয়ে লোকজন স্কুল মাঠে আসছে। জামায়াতের আমিরসহ আমরা আরো অনেকে লোকজনকে অনুরোধ করেছি, মাজারে, বাড়িঘরে যাতে কেউ কোনোকরম হামলা না করে। তিনি বলেন, পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে ¯ু‹ল মাঠে আসা লোকজনকে শান্ত থাকার অনুরোধ করেছি, কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নিবেন না। কিন্তু একটা সময় কিছু লোক হ্যান্ডমাইকে ঘোষণা দিয়ে যেখানে মাজার রয়েছে সেখানে দৌঁড়ে যায়। আমরা চেষ্টা করেছি কেউ যাতে কোনোকিছুর ক্ষতি না করে। কিন্তু উত্তেজিত লোকজনকে থামানো যায় নি।’
এক প্রশ্নের জবাবে ইসলামী আন্দোলনের এই নেতা বলেন, ‘আসাদপুর গ্রামের বাইরের বেশি লোকজনই ঘটনার দিন সকালে জড়ো হয়েছিল। এতো লোক কাদের ডাকে এলো বুঝতে পারছি না। তবে অনেকেই বলেছেন, তারা প্রতিবাদ সমাবেশ হবে এমন কথা লোকমুখে শুনে শুনে স্কুল মাঠে এসেছেন।’ এই নেতা বলেন, ‘কারা বিভিন্ন কৌশলে প্রতিবাদ সমাবেশের নামে সাধারণ মানুষকে উত্তেজিত করে কিংবা ঘোষণা দিয়ে মব ভায়োলেন্স সৃষ্টির এই ঘৃন্যতম ঘটনাটি ঘটিয়েছে তাদের চিহ্নিত করাই এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধান কাজ। কারণ আমরা মনে করি এই চক্রটি দেশকে অস্থিতিশীল রাখতে সারা দেশেই এমন কর্মকা- করছে।’ হোমনা উপজেলা জামায়াতের আমির মাওলানা সাঈদুল হক বলেন, আমরা চাই এই ন্যাক্কারজক ঘটনার হোতাদের পরিচয় জনসম্মুখে আসুক। দোষীরা গ্রেফতার হোক এবং নিরপরাধ কোনো লোক যেন হয়রানির শিকার না হয়।
গতকাল শনিবার দুপুরে হোমনা থানার ওসি মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘যারা সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে ঘটনাটি ঘটিয়েছে তাদের ভিডিও ফুটেজ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে এসেছে, পুলিশের বিশেষ টিম এ নিয়ে কাজ করছে। এরই মধ্যে মূলহোতাদের চিহ্নিত করা হয়েছে।’ ওসি আরো বলেন, ‘মামলার আসামিরা অজ্ঞাত নামীয় হলেও হামলায় জড়িতদের শনাক্তের কাজ করছে পুলিশ। তথ্য প্রমাণে নিশ্চিত অপরাধীদেরই পুলিশ ধরবে, এক্ষেত্রে কোনো নিরপরাধ লোক হয়রানির শিকার হবেন না। পুলিশ ঢালাওভাবে কাউকে গ্রেফতার করবে না। মূল অপরাধীদের কেবল গ্রেফতার করা হবে। আমরা প্রত্যাশা করছি, অপরাধীদের চিহ্নিত ও গ্রেফতারের ক্ষেত্রে সবাই সহযোগিতা করবেন।’
প্রসঙ্গত, গত বুধবার বেলা ১১টার দিকে ‘বেমজা মহসিন’ নামের একটি আইডি থেকে আসাদপুর গ্রামের আলেক শাহের ছেলে মহসিন মহানবী হযরত মুহাম্মদকে (সা.) কটূক্তি করে একটি পোস্ট দেয়। এতে এলাকাবাসীর ক্ষোভের মুখে পুলিশ মহসিনকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে আসে। ওই দিন সন্ধ্যায় বাংলাদেশ ইসলামী যুব সেনা হোমনা উপজেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক মো. শরীফুল ইসলাম আলেক শাহের ছেলে মহসিনের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে হোমনা থানায় মামলা করেন। পরেরদিন বৃহস্পতিবার সকালে কথিত প্রতিবাদ সমাবেশের নামে আসাদপুর হাইস্কুল মাঠে বিভিন্ন এলাকা থেকে কৌশলে লোকজন জড়ো করে তাদের উত্তেজিত করা হয় এবং হ্যান্ডমাইকে ঘোষণা দিয়ে মব সৃষ্টির মাধ্যমে চারটি মাজার ও কয়েকটি বাড়িতে ভাঙচুর, হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে। হামলার শিকার মাজারগুলো হচ্ছে- কফিল উদ্দিন শাহর মাজার, আবদু শাহর মাজার, কালাই শাহের মাজার এবং হাওয়ালি শাহর মাজার।
বিভাগ : জাতীয়