Image description

ঢাকাস্থ তুরস্ক দূতাবাস ভিসার প্রসেসিং সেন্টারের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। মাস শেষে এই টাকার পরিমান কোটি ছাড়িয়ে যাবে। অভিযোগ রয়েছে, দূতাবাস নির্ধারিত ভিসা প্রসেসিং সেন্টারের মাধ্যমে এই টাকার সিংহভাগ পান ঢাকাস্থ তুরস্ক দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত এবং ভিসা কনসুলার।

এ কারণে ট্যুরিস্ট ভিসাসহ সব ধরণের ভিসার প্রদানের ক্ষমতা এককভাবে ভিসা প্রসেসিং সেন্টারকে দিয়েছে দূতাবাস। ভুক্তভোগিরা জানান, জনপ্রতি ২৫ হাজার টাকা ভিসা ফি জমা দিয়ে একজন ভিসাপ্রার্থী যতই জেনুইন হোন না কেন, তার ভিসা প্রাপ্তির গ্যারান্টি দিতে পারে একমাত্র ভিসা প্রসেসিংয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানটি। তারাই দালালদের মাধ্যমে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। সরেজমিনে ঢাকাস্থ তুরস্ক দূতাবাস অফিসে গিয়ে দেখা গেছে, প্রতিদিন সকাল থেকে কয়েকশ’ ভিসাপ্রার্থী সেখানে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই তুরস্কের ভিসা নিয়ে ইউরোপের কোনো দেশে যেতে চায়। একজন ভিসাপ্রার্থী বলেন, একবার ভিসার আবেদন করে ব্যর্থ হয়ে এখানে এসেছি। এখানে কেউ কোনো কথা বলে না। গেটে দাঁড়ানো সিকিউরিটিকে বললাম। তিনি বললেন, এখানে তদবির করলে উল্টো রেজাল্ট হয়। ওই সিকিউরিটি আমাকে একজন দালালকে দেখিয়ে বললেন, ওনার সাথে কথা বলেন। সেই দালালের কাছে গেলে তিনি আমার কাছে ভিসার জন্য এক লাখ টাকা দাবি করলেন। কিন্তু তাকে কেমনে বিশ্বাস করি? আরেকজন ভুক্তভোগি জানালেন, তিনিও আবেদন করার পর ভিসা পাননি। এজন্য একজন দালাল খুঁজতে দূতাবাসে এসেছেন।

তুরস্ক দূতাবাসের ভিসা প্রসেসিং করে থাকে ‘রেইরেড ইন্টারন্যাশনাল’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। বনানীতে এই প্রতিষ্ঠানের অফিস। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ট্রাভেল এজেন্সীর মালিক বলেন, এই প্রতিষ্ঠানটি ভিসা সংক্রান্ত সব কাগজপত্র যাচাই করে ভিসার নিশ্চয়তা দিয়ে দূতাবাসে পাঠায়। এই প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে একটা দালাল সিন্ডিকেট আছে। ওই সিন্ডিকেট চাইলে যে কাউকে ভিসার নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে। প্রতিটা ভিসা প্রসেসিং করার জন্য এই প্রতিষ্ঠানটি ১২-১৩ হাজার টাকা পেয়ে থাকে। এরাই খেয়ালখুশি মতো ভিসা দিয়ে থাকে। এমনকি এরা কাগজপত্র যাচাই না করেই বেশিরভাগ ভিসা বিনা কারণে বাতিল করে দেয়। কিন্তু দালালের মাধ্যমে যোগাযোগ করলে এরা ভিসা সহজেই দিয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে তাদেরকে অতিরিক্ত ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। অন্যথায় এরা বেশিরভাগ ভিসা বাতিল করে দেয়। যাতে দ্বিতিয়বার আবেদন করতে বাধ্য হয়।

জানা গেছে, তুরস্কের ভিসার জন্য জনপ্রতি ২৫ হাজার টাকা করে দিতে হয়। একবার ভিসা বাতিল হলে এর পুরো টাকাই পেয়ে যায় দূতাবাস কর্তৃপক্ষ। প্রতিদিন শত শত ভিসা বাতিল করা হয় যাতে দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত এবং ভিসা কনসুলার লাখ লাখ টাকা আয় করতে পারেন। এই অবৈধ আয়ের পরিমান এতটাই বেশি যে, ওই টাকায় তুরস্ক সরকার সার্কভূক্ত সব দূতাবাস চালাতে পারে। যেহেতু জবাবদিহিতা নেই সেহেতু তারা অনায়াসে সেই টাকা লোপাট করার সুযোগ পায়।

অভিযোগ রয়েছে, তুরস্ক দূতাবাস বাংলাদেশের ইসলামী ঘারানার একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলকে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে। ভিসার জন্য ওই রাজনৈতিক দলের বিশেষ কোটাও আছে। তারা আবেদন করে দলীয় প্যাডে একটি প্রমাণপত্র দূতাবাসের কর্মকর্তার কাছে পাঠালেই ভিসা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা মেলে।

এদিকে, চলতি বছরের ১১ জুন মাসে ভুয়া ভিসা নিয়ে ভ্রমণের অভিযোগে তুরস্কের বিমানবন্দর থেকে ৩০ বাংলাদেশি ফেরত পাঠিয়েছে তুর্কি কর্তৃপক্ষ। ওই দিন সকালে ঢাকা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ছেড়ে যাওয়া তার্কিশ এয়ারলাইন্সের টিকে-৭১৩ ফ্লাইটের যাত্রী ছিলেন ওই ৩০ জন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফেরত পাঠানো ওই ৩০ বাংলাদেশির মধ্যে কারোই আগে বিদেশ সফরের অভিজ্ঞতা নেই; এমনকি তাদের মধ্যে অনেকেই ফ্লাইটে ওঠার জন্যই জীবনে প্রথমবার ঢাকায় এসেছিলেন। তাদের মধ্যে কেউ দিনমজুর, কেউ দোকানদার, কেউ গার্মেন্টস কর্মী। ইমিগ্রেশনে তারা বলেছিলেন, পাঁচ দিনের জন্য তুরস্ক যাচ্ছেন।

প্রত্যাবর্তীদের ভাষ্য অনুযায়ী, তারা তুরস্কে যাওয়ার জন্য ভ্রমণ ভিসা দেখালেও আসল লক্ষ্য ছিল মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া হয়ে লিবিয়া, সেখান থেকে ইউরোপে পৌঁছানো। এ যাত্রায় প্রত্যেকে দালালদের হাতে ৮ থেকে ১৮ লাখ টাকা দিয়েছেন। তারা জানান, ভ্রমণের আগে ঢাকার পল্টনে এক হোটেলে ট্রেনিংয়ের মতো করে তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়-মিশর ও লিবিয়ার ভিসা ‘লুকিয়ে’ রাখতে হবে এবং ইমিগ্রেশনে শুধু তুরস্ক ট্যুর বলেই দাবি করতে হবে। ১১ জুন ভোররাতে যাত্রার দিন হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনের দায়িত্বে ছিল ‘সি’ শিফট। যাত্রীদের একজন জানান, একজন অফিসার একসঙ্গে ৩০ জনের পাসপোর্ট ও বোর্ডিং পাস নিয়ে যান। এরপর সবাইকে ইমিগ্রেশন সিল দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

ওই সব যাত্রীদের পাসপোর্টে ছিল ‘বি-১ ক্যাটাগরির’ ভিসা, যা কেবল শেনজেন, ইউকে বা ইউএস ভিসা/রেসিডেন্সিধারীদের জন্য অনুমোদিত। অথচ ফিরিয়ে দেওয়া ৩০ জনের কেউই এই যোগ্যতা রাখতেন না। তাছাড়া, তাদের হাতে ছিল মিশরের বোর্ডিং পাস, যা তারা পেয়েছেন ঢাকায় থাকা দালালদের কাছ থেকে। তুরস্কে পৌঁছে ইমিগ্রেশন না করে বিমানবন্দরে ঘোরাফেরা করার সময় পুলিশ তাদের সন্দেহ করে। এক পর্যায়ে জেরা করে ভুয়া ভিসার তথ্য পায়, এবং পরে সবাইকে আটক করা হয়। ২৪ ঘণ্টা আটক রেখে তাদের ফেরত পাঠানো হয়। ওই ঘটনার দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, এই যাত্রীরা মূলত বিভিন্ন অঞ্চলের এবং আলাদা দালালের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ছিলেন। তাই চক্রের মূল হোতাদের খুঁজে পাওয়া কঠিন হচ্ছে। তবে এটা নিশ্চিত যে, এই ভিসা প্রদানের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ভিসা প্রসেসিং সেন্টার তথা দূতাবাসের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জড়িত। এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য তুরস্ক দূতাবাসের মুখপাত্র শাহেদের মোবাইলে কল করার পরেও তিনি কোনো সাড়া দেননি। ভিসা সেন্টারের ওয়েব সাইটে দেয়া নম্বরে কল করলেও কেউ ফোন ধরেনি।