Image description
রাজধানীর মহাখালীতে অবস্থিত জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল | ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী
 
 

বরিশালের উজিরপুর উপজেলার সাতলা গ্রামের বাসিন্দা আমেনা বেগম (ছদ্মনাম)। পঞ্চাশোর্ধ্ব এ নারী দীর্ঘদিন ধরে শারীরিক নানা জটিলতায় ভুগছেন। স্থানীয় বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেও রোগ ধরা যায়নি। তবে কোনো কোনো চিকিৎসক ক্যান্সার বলে অনুমান করেন। তাই ঢাকায় এসে চিকিৎসা নিতে বলা হয়। কিন্তু পেশায় দিনমজুর স্বামী আবুল কালামের পক্ষে সে ব্যয় বহন করা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। পরে কিছু অর্থ জোগাড় করে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে (এনআইসিআরএইচ) আসেন। বহির্বিভাগে চিকিৎসক দেখালে আমেনাকে কিছু পরীক্ষা দেয়া হয়। সেগুলো নিয়েই এখন দুশ্চিন্তা। কারণ তার যে সমস্যা তা শনাক্তে যে যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করা হয়, সবগুলোই এ হাসপাতালের অচল। পরীক্ষাগুলো তাই করতে হবে বাইরের কোনো ডায়াগনস্টিকে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে বতর্মানে সিটিস্ক্যান, এমআরআই ও মেমোগ্রাফি—প্রধান এ তিন যন্ত্রের সবগুলোই অচল হয়ে পড়ে রয়েছে। এছাড়া হাসপাতালটিতে সব মিলিয়ে আটটি রেডিওথেরাপি যন্ত্র ছিল। এর মধ্যে চারটি বহুদিন ধরে অকেজো, আর দুটি যন্ত্র মেরামত-অযোগ্য। বর্তমানে মাত্র দুটি যন্ত্রে কোনোরকমে সেবা চলছে। এর মধ্যে অতিরিক্ত চাপের কারণে প্রায়ই একটি বিকল হয়ে পড়ে। এর ফলে কেবল আমেনা বেগমই নন, তার মতো স্বল্প আয়ের অনেক রোগীই বাড়তি খরচের চাপে পড়ছেন। স্বল্পমূল্যে সেবা পাওয়ার আশায় তারা হাসপাতালটিতে এলেও ফিরে যেতে হচ্ছে নিরাশ হয়ে। জনবল ঘাটতিসহ নানা সংকটও রয়েছে এনআইসিআরএইচে। সংশ্লিষ্টরা জানান, এসব যন্ত্র মেরামত কিংবা নতুন কেনার বিষয়ে বারবার প্রস্তাব দেয়া হলেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

স্বাস্থ্য খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে অসংক্রামক রোগে যত মৃত্যু হয়, তার মধ্যে অন্যতম ক্যান্সার। বিশ্বের অন্যান্য দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশেও ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু ক্যান্সার দ্রুত শনাক্ত করতে না পারলে চিকিৎসা জটিল হয়ে ওঠে এবং মৃত্যুঝুঁকি বাড়ে। কিন্তু এ দুই জায়গাতেই পিছিয়ে আছে জাতীয় ক্যান্সার হাসপাতাল। সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রটির এমআরআই, মেমোগ্রাফি ও সিটিস্ক্যান মেশিনের মতো গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র নষ্ট হয়ে পড়ে আছে দীর্ঘদিন। রেডিওথেরাপি মেশিনও মাত্র দুটি, যা রোগীর তুলনায় যথেষ্ট নয়। ফলে ক্যান্সার শনাক্তের পরীক্ষা-নিরীক্ষা অন্য জায়গা থেকে করাতে হয়। এতে দরিদ্র রোগীদের চিকিৎসা ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে বহু গুণে। জরুরি ভিত্তিতে তাই যন্ত্রগুলো চালু করা বা নতুন যন্ত্র স্থাপন করা অত্যন্ত জরুরি।

 

জানতে চাইলে হাসপাতালটির সহকারী পরিচালক ডা. আবু হেনা মোস্তফা জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ক্যান্সার শনাক্তের জন্য যে মূল যন্ত্রপাতিগুলো দরকার সেগুলোই নষ্ট। যেমন সিটিস্ক্যান, এমআরআই, মেমোগ্রাফি মেশিন। এছাড়া থেরাপি মেশিন পর্যাপ্ত পরিমাণে নেই। ওষুধেরও স্বল্পতা রয়েছে। এদিকে কিছু ডোনেশন আমরা পেয়ে থাকি, যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। এখানে যারা চিকিৎসা নিতে আসেন তাদের বেশির ভাগই নিম্নবিত্ত পরিবারের। রোগীর সঙ্গে যারা আসেন, তারা হাসপাতালের ভেতরেই থাকেন। তাদের জন্যও সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা থাকা জরুরি। অপরদিকে জনবল সংকটও রয়েছে। ৫০০ শয্যা অনুমোদিত থাকলেও মাত্র ৩০০ শয্যার লোকবল নিয়ে আমরা রোগীর চাপ সামলাচ্ছি। শুধু শয্যা বাড়ালেই হবে না, সেই অনুপাতে চিকিৎসক-নার্সের সংখ্যা বাড়ানোও জরুরি।’

 

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ থেকে পাওয়া তথ্যানুসারে, চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত মোট ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছিল ৯ হাজার ৯৫৮ জন। একই সময়ে বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেয় ২ লাখ ১ হাজার ৬০৬ জন এবং জরুরি বিভাগে ৭ হাজার ৬১৩ রোগী। প্রতি বছর বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেয়া রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। গত বছর হাসপাতালটিতে বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেয়া রোগী ছিল ২ লাখ ৭১ হাজার ৬৪০ জন। ভর্তি রোগী ছিল ১৪ হাজার ৬ এবং জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ১২ হাজার ৬৫ জন। ২০২৩ সালে বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেয়া মোট রোগীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ২৩ হাজার ১৭১ জন, ভর্তি রোগী ১৬ হাজার ৫৬ এবং জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নেয়া রোগীর সংখ্যা ছিল ১০ হাজার ৪১৮ জন।

রোগীদের পরিপূর্ণ চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে শয্যা সংখ্যা, যন্ত্রপাতি ও জনবল বাড়ানো জরুরি বলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ডা. মো. জাহাঙ্গীর কবীর। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘এ হাসপাতালে প্রতিদিন যে পরিমাণ রোগী আসেন, তাদের সবাইকে চিকিৎসা দেয়ার জন্য শয্যা সংখ্যা বাড়ানো দরকার। আমাদের শয্যা সবসময় পরিপূর্ণ থাকে। শয্যার অভাবে অনেক রোগীকে আমরা ফেরতও পাঠিয়ে দিই। পাশাপাশি আরো চিকিৎসক ও নার্সও নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন। তবে জনবলের সমস্যা সমাধান করতে আরো সময়ের প্রয়োজন। নষ্ট যন্ত্রপাতিগুলোও মেরামত ও আরো নতুন যন্ত্র জরুরি। আমাদের সাতটি রেডিওথেরাপি মেশিনের প্রয়োজন। আছে মাত্র দুটি। এটি যাতে পাঁচটিতে উন্নীত করা যায় সেই চেষ্টা চলমান রয়েছে।’

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দেয়া তথ্যানুসারে, জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অনুমোদিত ৩০০ শয্যার জন্য পদের সংখ্যা রয়েছে ১ হাজার ১৮৮টি। এর বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন ৯৩৬ জন। শূন্য পদ রয়েছে ২৫২টি। চিকিৎসকের পদ (১ম-৯ম গ্রেড) আছে ২৪৮টি, এর বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন ২০৪ জন। দ্বিতীয় শ্রেণীর (১০ম গ্রেড) ৬০৭টি পদ রয়েছে, তবে কর্মরত আছেন ৫৫৫ জন। তৃতীয় শ্রেণীর (১১-১৮তম গ্রেড) ১৪৯টি পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন ৮৮ জন। আর চতুর্থ শ্রেণীর (১৯-২০তম) ১৮৪টি পদের বিপরীতে কর্মরত জনবল ৮৯ জন।

দেশে প্রতি বছর কী পরিমাণ ক্যান্সারের রোগী শনাক্ত হচ্ছে তার সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই বলে জানিয়েছেন চিকিৎসা গবেষকরা। তবে ২০২৪ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের গবেষকদের করা জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যান্সার রেজিস্ট্রি থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতি এক লাখে ১১৪ জন ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। গবেষণাটিকে ভিত্তি হিসেবে বিবেচনায় নিলেও দেশের মোট জনসংখ্যা ১৭ কোটি ৩০ লাখের মধ্যে ক্যান্সার রোগী আছে ১ লাখ ৯৭ হাজার ২০০ জন। অপরদিকে বৈশ্বিক ক্যান্সার গবেষণা জার্নাল ল্যানসেট অনকোলজির ২০২৪ সালের ডিসেম্বর সংস্করণে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, দেশে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১৫ লাখ। ২০৪০ সালের মধ্যে তা ২১ লাখ ছাড়িয়ে যাবে। আর এখন পর্যন্ত এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা কম-বেশি ১০ লাখের কাছাকাছি। ২০৪০ সালের মধ্যে তা ১৪ লাখে উন্নীত হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার কাজ মন্ত্রণালয় করে থাকে। আমরা (অধিদপ্তর) মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন করে থাকি। আমাদের দেশে যে পরিমাণ ক্যান্সার রোগী রয়েছেন, সে অনুযায়ী আসলে চিকিৎসাসেবা ব্যবস্থা অপ্রতুল। তবে ঢাকার বাইরে অন্য বিভাগগুলোয়ও যেন ক্যান্সার রোগীরা চিকিৎসা পান সেজন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। বিভাগীয় পর্যায়ে সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোয় আলাদা বিভাগ আছে। পাশাপাশি প্রতিটি বিভাগীয় শহরে কিডনি, হার্ট ও ক্যান্সার নিয়ে আলাদা একটি করে হাসপাতালের নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে। আশা করি, ২০২৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে সেগুলো চালু হয়ে যাবে।’