
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনসহ বিভিন্ন কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ঋণগ্রহীতা ব্যবসায়ীদের জন্য একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে দেশের অর্থনীতিতে ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি হওয়ার পর। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এক বছর আগে এ সিদ্ধান্ত নিলে অর্থনীতির এ ভয়াবহ ক্ষতি হতো না। গত এক বছরে শিল্পোদ্যোক্তারা ব্যবসা করার সুযোগ পেলে অর্থনীতি ভালো থাকত, সরকার ও দেশের মানুষ ভালো থাকত। ঋণ পুনঃতফসিলে বাংলাদেশ ব্যাংক গঠিত কমিটি ১ হাজার ২৫০টির বেশি আবেদন গ্রহণ করে। কমিটি প্রায় ৩০০ আবেদনকারীকে সুবিধা দিয়ে বাকিগুলো ঝুলিয়ে রেখেছে মাসের পর মাস। অবশেষে আবেদনগুলো নিষ্পত্তির সিদ্ধান্ত স্ব স্ব ব্যাংকের ওপর ছেড়ে দিয়েছে শর্ত সাপেক্ষে। বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঋণ পুনঃতফসিলে বাংলাদেশ ব্যাংক এ সিদ্ধান্ত এক বছর আগে নিলে ব্যবসাবাণিজ্য চাঙা থাকত। অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে বেকারত্ব বাড়ত না। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, কার স্বার্থে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যবসায়ীদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করল? ৩০০ আবেদন নিষ্পত্তি করে অন্য আবেদনগুলো কেন ফেলে রাখা হয়েছে?
এ বিষয়ে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রাহমান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমি মনে করি ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য ব্যাংকগুলোকেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ দেওয়া উচিত। ঋণ পুনঃতফসিল ব্যাংকই দেখবে এটাই নিয়ম সারা বিশ্বে। ব্যাংকের সব কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বেশ কয়েকটি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে। এটা খুবই ভালো। কিন্তু দিন শেষে গ্রাহকের সমস্যাটা আসলে ব্যাংকই বুঝবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তো বুঝবে না। কাগজে-কলমে অনেক কিছু দেখানো যায়। জামানতবিহীন ঋণও নেওয়া যায়। তার মানে এই না, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বুঝতে পারবে কে প্রকৃত ব্যবসায়ী আর কে ব্যবসা করে না। আমি কেমন গ্রাহক এটা আমার ব্যাংক ভালো জানবে। ব্যাংক কোন ঋণ পুনঃতফসিল করবে আর কোনটা করবে না, এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভালো বুঝবে না। বিষয়টা এমন হয়েছে যে, ব্যাংকের লাইসেন্স দেবে কিন্তু ব্যাংকিং করতে দেবে না।
ইস্টল্যান্ড ইন্স্যুরেন্স পিএলসির এই ভাইস-চেয়ারম্যান বলেন, ঋণ পুনঃতফসিলের ক্ষমতা ব্যাংকের ওপর ছেড়ে দিলে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের আস্থা বাড়বে। ব্যবসায়ীরা এখন অনেকেই অনেক ধরনের চাপের মধ্যে আছে। পরিস্থিতির কারণে অনেকের ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা খারাপ। ফলে তারা ব্যবসা পরিচালনা করতে পারছে না। বাজারে ধস নেমেছে। বিভিন্ন কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্যবসায়ীরা। বিগত সরকারের আমলে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে এখন ১৬-১৭ শতাংশ সুদে পরিশোধ করতে হচ্ছে। এটা বড় ধরনের ক্ষতি ব্যবসায়ীদের জন্য। ঋণ পুনঃতফসিলের নতুন নীতিমালার ফলে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি উদ্যোক্তা যারা আছে তাদের একটা আস্থা তৈরি হবে। পুনঃতফসিলের সুযোগ পেলে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর নজরদারি রাখতে হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমই) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রতিদিনকে বলেন, ঋণ পুনঃতফসিলে নতুন নীতিমালা জারি করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে সাধুবাদ জানাই। এটা অনেক ব্যবসায়ীকে ঋণ খেলাপির তকমা থেকে মুক্তি পেতে সহায়তা করবে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক কমিটি গঠন না করে ঋণ পুনঃতফসিলের পুরো ক্ষমতা ব্যাংকের ওপর ছেড়ে দিলে ভালো হতো। পরিশোধের শর্ত ও মেয়াদ গ্রাহক-ব্যাংকার সম্পর্কের ভিত্তিতে নির্ধারণের সুযোগ দেওয়া উচিত।
তিনি আরও বলেন, ঋণ পরিশোধের সময়সীমা এখনো ১০ বছর রাখা হয়েছে। যদি সেটা না করে তাহলে কমপক্ষে ১৫ বছর সময় দিলে ভালো হতো। কারণ এই ১০ বছরেও অনেক ব্যবসায়ী ঋণ পরিশোধ করে ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন না। আমাদের দাবির পরও আর একটা বিধান রয়ে গেছে, সেটা হলো পরপর তিনটি কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে ঋণখেলাপি হয়ে যাবে। অন্তত এক বছর ঋণখেলাপি করার সময় আগের মতো ছয় মাস করা হলে ব্যবসায়ীরা কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবে। ঋণ পুনঃতফসিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কমিটির উচিত ছিল সবাইকে সুযোগ দেওয়া।
বেসরকারি ব্যাংক ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশের অনেক ভালো ব্যবসায়ীই বর্তমানে ভুগছেন। তাঁদের অনেকেই ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছেন। কেউ নির্বাচন কবে হবে তা দেখছেন, কেউ পালিয়ে আছেন, আবার কেউ আছেন কারাগারে। অথচ এঁরা দেশের জিডিপি ও কর্মসংস্থানে বড় ভূমিকা রাখতে সক্ষম। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের ব্যবসায় ফেরাতে বা গতি বাড়াতে বিশেষ সুবিধা প্রয়োজন ছিল। এই সুবিধা পেলে তাঁরা আবার ব্যবসায় ফিরতে পারবেন। অনেক রাজনীতিবিদও এর আওতায় আসবেন। সামনে নির্বাচন, তাই সবাই ঋণ নিয়মিত করার চেষ্টা করবেন। তিনি আরও বলেন, স্বাভাবিক সময়ে এত ছাড়ে ঋণ পুনর্গঠন ব্যাংকের জন্য চাপের হলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে এ উদ্যোগকে তিনি যৌক্তিক মনে করছেন।
গত মঙ্গলবার একটি সার্কুলার জারি করে ক্ষতিগ্রস্ত ঋণগ্রহীতা ব্যবসায়ীদের ঋণ পুনঃতফসিল, পুনর্গঠন, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারজনিত ক্ষতি এবং এককালীন ঋণ পরিশোধে এক্সিট সুবিধা নেওয়ার সার্কুলার জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
গত বছরের আগস্টে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর গত এক বছরে সাভার, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীতে ৩৫৩টি কারখানা বন্ধ করা হয়েছে। তাতে ১ লাখ ১৯ হাজার ৮৪২ শ্রমিক বেকার হয়েছেন। তাদের অনেকে চাকরির জন্য ছুটতে ছুটতে শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে গ্রামে ফিরেছেন। বন্ধ কারখানার বেশির ভাগই তৈরি পোশাক, নিটওয়্যার ও টেক্সটাইল শিল্পের কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর, শিল্প পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। শিল্প মালিকরা বলছেন, ব্যাংকঋণ সুদে কড়াকড়ি, শ্রমিক অসন্তোষসহ বিভিন্ন কারণে দেশে শিল্পকারখানা বন্ধ হচ্ছেই। তাঁরা চরম সংকটের কারণেই কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন।