Image description

মাত্র এক বছরের ব্যবধানে যুক্তরাষ্ট্রের পোশাকবাজারে বাংলাদেশ নাটকীয় পরিবর্তন দেখিয়েছে। ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের অধীন অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলের (অটেক্সা) সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ৪৯৮ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি করেছে। গত বছরের একই সময়ে বাংলাদেশ ৪৫৭ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি করেছিল। যদিও ২০২৩ সালের একই সময়ে এই আয় ছিল প্রায় ৫১০ কোটি ডলার।

অটেক্সার তথ্য অনুযায়ী, গত বছর (২০২৪) জানুয়ারি-জুলাই সময়ে এই বাজারে দেশের রফতানি কমেছিল ১০ শতাংশের বেশি। অথচ চলতি বছর (২০২৫) একই সময়ে রফতানি বেড়েছে ২১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। শুধু রফতানির অঙ্কই নয়, পরিমাণ ও গড় দাম—সব দিক থেকেই বাংলাদেশ দৃঢ় অবস্থান দেখিয়েছে। ফলে চীনের বাজার সংকোচনের সুযোগ কাজে লাগিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান সরবরাহকারী দেশে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বড় ধরনের ধসের পর ২০২৫ সালে বাংলাদেশের রফতানি প্রবৃদ্ধি এক ধরনের কমব্যাক স্টোরি। মাত্র এক বছরে ১০ শতাংশ পতন থেকে ২১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি—এই উত্থান প্রমাণ করছে যে সঠিক কৌশল, উৎপাদন দক্ষতা এবং বাজার-সুবিধা কাজে লাগালে বাংলাদেশ বিশ্ব পোশাক বাণিজ্যের অন্যতম চালিকাশক্তি হয়ে উঠতে পারে।

এক বছর আগের চিত্র: বড় ধস

২০২৪ সালের জানুয়ারি-জুলাই সময়ে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রফতানি করেছিল প্রায় ৪৫৭ কোটি ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ কম। ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের অধীন অটেক্সার পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সেই সময় শুধু বাংলাদেশই নয়—চীন, ভিয়েতনাম, ভারত ও ইন্দোনেশিয়াসহ শীর্ষ দেশগুলোর রফতানিও কমেছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় পতন হয়েছিল বাংলাদেশের। ফলে উদ্যোক্তারা শঙ্কায় পড়েছিলেন—যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে দেশের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ছে কিনা।

অটেক্সার তথ্য অনুযায়ী, ‘গত সাত মাস সময়ে যুক্তরাষ্ট্র সারা দুনিয়া থেকে মোট ৪৫ দশমিক ৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পোশাক আমদানি করেছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪ দশমিক ৯৬ শতাংশ বেশি। তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সাফল্যের খবর আসে বাংলাদেশ থেকে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রফতানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ২১ দশমিক ৬৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, যা এ খাতে সবার নজর কেড়েছে।’

এবারের চিত্র: রফতানিতে শক্তিশালী প্রত্যাবর্তন

২০২৫ সালের জানুয়ারি-জুলাই সময়ে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রফতানি করেছে প্রায় ৪ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, প্রবৃদ্ধি ২১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। সংখ্যার বিচারে ২০ দশমিক ৩৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। একইসঙ্গে প্রতিটি পোশাকের গড় দামও বেড়েছে ১ দশমিক ১১ শতাংশ। অর্থাৎ শুধু পরিমাণ নয়, দামে প্রতিযোগিতা ধরে রেখেও বাংলাদেশ বাজারে শীর্ষ অবস্থান ধরে রেখেছে।

প্রতিযোগী দেশগুলোর চিত্র

বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনামও ভালো করেছে। দেশটির রফতানি বেড়েছে ১৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ, আর সংখ্যার হিসাবে বেড়েছে ১৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ। প্রতি ইউনিট পোশাকের দামও ২ দশমিক ১৮ শতাংশ বেড়েছে।

অপরদিকে চীন বড় ধাক্কা খেয়েছে। দেশটির পোশাক রফতানি হ্রাস পেয়েছে ২১ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ, সংখ্যার হিসাবে কমেছে ১৫ দশমিক ৯২ শতাংশ। ইউনিট মূল্যও নেমে গেছে ৬ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য উত্তেজনা এবং বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে পরিবর্তন এর পেছনে অন্যতম কারণ।

ভারতের পোশাক রফতানি বেড়েছে ১৬ দশমিক ১০ শতাংশ, সংখ্যায় ১৫ দশমিক ২৭ শতাংশ এবং ইউনিট দামে ০ দশমিক ৭১ শতাংশ। পাকিস্তানও ১১ দশমিক ৮১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে, সংখ্যায় বেড়েছে ১৭ দশমিক ০৩ শতাংশ। তবে প্রতিটি পোশাকের গড় দাম কমেছে ৪ দশমিক ৪৬ শতাংশ।

ইন্দোনেশিয়ার প্রবৃদ্ধি ১৬ দশমিক ৮০ শতাংশ, কম্বোডিয়ার প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি— ২৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ। সংখ্যার দিক থেকে কম্বোডিয়া ৩১ দশমিক ১১ শতাংশের উল্লম্ফন দেখিয়েছে। তবে দেশটির ইউনিট দাম কমেছে ৫ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ।

লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে মেক্সিকো সামান্য বেড়েছে ২ দশমিক ৪০ শতাংশ, সংখ্যায় ১০ দশমিক ৫৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিপরীতে হন্ডুরাসের রফতানি কমেছে ১১ দশমিক ৭৮ শতাংশ, সংখ্যায় আরও বেশি—১৭ দশমিক ৩১ শতাংশ হ্রাস।

কোরিয়ার অবস্থাও নড়বড়ে। তাদের রফতানি কমেছে ৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ, সংখ্যায় হ্রাস ২৪ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ হলেও ইউনিট দামে বেড়েছে ২১ দশমিক ৭৪ শতাংশ।

বাজারের সামগ্রিক বিশ্লেষণ

বিশ্লেষকরা বলছেন, বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীনের প্রভাব কমে যাওয়ায় বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, ভারত, পাকিস্তান ও কম্বোডিয়ার মতো দেশগুলো নতুন সুযোগ পাচ্ছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের সাফল্য সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। কারণ দেশটি একসঙ্গে পরিমাণ, গুণমান ও দামের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পেরেছে।

বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য উত্তেজনা, উচ্চ শুল্ক আর উৎপাদন ব্যয় বাড়ার কারণে মার্কিন বাজারে চীনের অবস্থান দুর্বল হচ্ছে। একসময় যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক আমদানির অর্ধেকের বেশি চীন থেকে আসতো। এখন সেই শূন্যস্থান পূরণ করছে বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, ভারত ও কম্বোডিয়ার মতো দেশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় অগ্রগতি দেখিয়েছে বাংলাদেশ।

বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক ও বাংলাদেশ অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, “আমাদের খাতের স্থিতিশীলতা ও সক্ষমতা প্রমাণ হয়েছে। বাংলাদেশ এখন শুধু সস্তা পোশাকের উৎস নয়— মান, সময়মতো সরবরাহ ও সাসটেইনেবল উৎপাদনের মাধ্যমে ক্রেতাদের আস্থা অর্জন করছে।”

যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কে বাংলাদেশের পোশাক খাতে নতুন সুযোগ

যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা পাল্টা শুল্ক কার্যকর হওয়ার পর বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলছে। বিশেষ করে ভারত ও চীনে উচ্চ শুল্কের কারণে অনেক মার্কিন ক্রেতা প্রতিষ্ঠান সেখান থেকে অর্ডার সরিয়ে এনে বাংলাদেশের কারখানাগুলোর সঙ্গে দরকষাকষি শুরু করেছে।

রফতানিমুখী তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা জানান, গত দুই সপ্তাহে মার্কিন ক্রেতাদের কাছ থেকে বাড়তি ক্রয়াদেশের অনুসন্ধান আসতে শুরু করেছে। এমনকি পূর্বে স্থগিত হওয়া অর্ডারও আবার ফিরছে। তবে দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন ক্রেতাদের সঙ্গে কাজ করছে—এমন প্রতিষ্ঠানের কাছেই মূলত এই অনুসন্ধান বেশি আসছে। এর বড় অংশ ভারত থেকে স্থানান্তরিত অর্ডার।

শুধু ক্রেতারাই নয়, কৌশলগতভাবে দীর্ঘ মেয়াদে মার্কিন অর্ডার ধরে রাখার লক্ষ্যে ভারতের বড় রফতানিকারকরা বাংলাদেশের শীর্ষ রফতানিকারকদের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে পোশাক উৎপাদনে আগ্রহ দেখাচ্ছে। অপরদিকে চীনা বিনিয়োগকারীরাও বাংলাদেশে তৈরি পোশাক কারখানা স্থাপনে আগ্রহী।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশি তৈরি পোশাক রফতানির সবচেয়ে বড় একক বাজার হলো যুক্তরাষ্ট্র। এই বাজারে শীর্ষ ১০ রফতানিকারক দেশ হলো—ভিয়েতনাম, চীন, বাংলাদেশ, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মেক্সিকো, হন্ডুরাস, কম্বোডিয়া, পাকিস্তান ও দক্ষিণ কোরিয়া। গত ৩১ জুলাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নতুন শুল্ক কাঠামো ঘোষণা করেন। এতে বাংলাদেশের পণ্যে শুল্ক ২০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়, যা ভিয়েতনামের সমান। তবে চীনা পণ্যে শুল্ক ৩০ শতাংশ এবং ভারতের পণ্যে ২৫ শতাংশ ধরা হয়েছে। এর বাইরে রাশিয়ার জ্বালানি কেনার কারণে ভারতের পণ্যে অতিরিক্ত আরও ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, যা ২৭ আগস্ট থেকে কার্যকর হয়েছে।

বিজিএমইএ’র সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “সব উৎপাদক দেশের পণ্যে পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এখন ভোক্তারা কতটা এ বাড়তি খরচ মেনে নেন, সেটিই আসল প্রশ্ন। যদি ভোক্তারা মানিয়ে নিতে পারেন, তবে ক্রয়াদেশ আরও বাড়বে।”

ইতোমধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠান বাড়তি অর্ডারের সুবিধা পাচ্ছে। স্প্যারো গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম বলেন, “আগামী বসন্তের জন্য আমাদের কাছে ৫-১০ শতাংশ এবং গ্রীষ্মের জন্য ১০-১৫ শতাংশ বাড়তি ক্রয়াদেশ রয়েছে। এ কারণে ক্রেতাদের অনুমতি নিয়ে এখন আমরা ২ ঘণ্টার পরিবর্তে ৩ ঘণ্টা ওভারটাইম করাচ্ছি।”

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

বৈশ্বিক অর্থনীতি নানা চ্যালেঞ্জে থাকলেও পোশাক বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান দৃঢ় হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে শুল্কনীতি, সরবরাহ শৃঙ্খল ও ভোক্তা প্রবণতা—সব মিলিয়ে বাংলাদেশের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করছে। তবে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে গুণগত মান, সময়মতো সরবরাহ এবং সাসটেইনেবল প্রোডাকশন মডেল আরও জোরদার করার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা।