
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের উত্তাপ তুঙ্গে। চলছে প্রার্থীদের শেষ মুহূর্তের প্রচারণা। প্রার্থীদেরকে মাঠের চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি মোকাবিলা করতে হচ্ছে অনলাইনের চ্যালেঞ্জও। ঢাবি শিক্ষার্থীদের তো বটেই দেশের নানা স্থানের মানুষের কুরুচিপূর্ণ ও মানহানিকর মন্তব্য সইতে হচ্ছে। অশ্রাব্য গালাগাল, কুরুচিপূর্ণ ছবি এবং মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে তিরস্কার- নিত্যনৈমিত্ত্যিক ঘটনা। যে সকল ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে এ ধরনের মন্তব্য করা হয়, ভুক্তভোগীরা সে সকল অ্যাকাউন্টকে ডাকেন ‘বট’ বলে। ফলে ডাকসু নির্বাচনকে ঘিরে মুহুর্মুহু এই ‘বট’ আক্রমণে হতবিহ্বল প্রার্থীরা।
সাধারণত কোনো রকম বিচার-বিশ্লেষণ ছাড়াই কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ে বিরোধিতা করে মন্তব্য ছুড়ে দেয়ার কাজে ব্যবহৃত হয় ‘বট অ্যাকাউন্ট’। ডাকসুকে ঘিরে বিভিন্ন দলের লোকজনের নিয়ন্ত্রিত বট যেমন আছে, তার চেয়ে বেশি আছে নিজস্ব অ্যাকাউন্ট। বিরোধী মতাদর্শের প্রার্থীদের ফেসবুক পোস্টের মন্তব্যের ঘরে গিয়ে এ সকল অ্যাকাউন্ট বিভিন্ন রকম বাজে মন্তব্য করে। সাইবার অ্যাটাকে ভেঙে পড়ছেন অনেক প্রার্থী।
সাইবার অ্যাটাকের অভিযোগ রয়েছে ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে। প্রার্থীদের মন্তব্যের ঘরে একই রকম কায়দায় হুমকি এবং চরিত্র হননের কাজ করে যাচ্ছে ছাত্রশিবির সমর্থিত অগণিত ফেসবুক অ্যাকাউন্ট। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আল বটর নামে পরিচিত শিবিরের বট বাহিনী। অন্যদিকে, শিবির সমর্থকরা ছাত্রদলের বট অ্যাকাউন্টগুলোকে একত্রে বটফোর্স বলে থাকে। সাধারণত শিবিরের বট অ্যাকাউন্টগুলোকে বেপর্দা নারী ও বামপন্থি প্রার্থীদেরকে হুমকি ও মানহানিকর মন্তব্য করতে দেখা যায়।
এই বট অ্যাটাকের সবচেয়ে বড় ভয়াবহতা দেখা দেয় ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট মনোনীত জিএস প্রার্থী এস এম ফরহাদের প্রার্থিতা নিয়ে রিট করার পর। বামপন্থি অপরাজেয় ৭১, অদম্য ২৪ প্যানেলের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক বি এম ফাহমিদা আলম রিট করেন হাইকোর্টে। ফলে সাময়িক স্থগিত হয় ডাকসু। সৃষ্টি হয় উত্তেজনা। এ সময় আলী হুসেন নামে এক শিক্ষার্থী ফাহমিদাকে গণধর্ষণের হুমকি দেন। মুহূর্তেই আলী হুসেনকে শিবির নেতা দাবি করে আন্দোলনের ডাক দেয় ছাত্রদল। যদিও আলী হুসেনের সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক দলের সম্পৃক্ততা পায়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত কমিশন।
এ ঘটনায় আলী হুসেনকে শিবির নেতা উল্লেখ করে ছাত্রদলের কর্মসূচির কারণে তিক্ততা বাড়ে ছাত্রদল ও শিবিরের মাঝে। পরদিনই সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রশিবির সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের দু’জন প্রার্থী ফাতেমা তাসনিম জুমা এবং উম্মে সালমার ওপর হওয়া বট অ্যাকাউন্টগুলোর পরিচয়সহ প্রিন্ট করে সংবাদ সম্মেলনে নিয়ে আসেন এস এম ফরহাদ। কুরুচিপূর্ণ এসব মন্তব্যের কয়েকটি তিনি পড়েও শোনান, একইসঙ্গে দেখিয়ে দেন এ সকল মন্তব্যকারীরা ছাত্রদলের বিভিন্ন পদ-পদবিপ্রাপ্ত।
সে ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ সমর্থিত বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেলের ভিপি পদপ্রার্থী আব্দুল কাদের ‘বেঁচে থাকতে চাই’ বলে আকুতিভরা এক পোস্ট দেন। একটি বেসরকারি সংবাদমাধ্যমের টকশো-তে তিনি ‘ছাত্রলীগ নারীদের প্রতি সহনশীল’ ছিল বলে মন্তব্য করেন। সে পোস্টে তিনি বলেন আমার ডাকসু’তে জেতা লাগবে না, কেবল বেঁচে থাকতে চাই। এতটুকু দয়া অন্তত আমাকে দেখানোর অনুরোধ। সেই রাজাকার (২০২৪ এর ১৪ই জুলাইয়ের রাজাকার স্লোগান) নিয়ে কথা বলার পর থেকেই যা শুরু হইছে, প্রতিনিয়ত সেটা আরও বাড়তেছে। তারপর থেকেই আমি ঘুমাতে পারি না। মাঝরাতে জেগে যাই, শরীর কাঁপতে থাকে। একটা মানুষকে নিয়ে আর কতো করবেন? মানুষের কতোটুকুই বা ধৈর্য ক্ষমতা থাকে, আমি আর কতোদিন নিতে পারবো জানি না। কেবল অনলাইনে এই হেনস্তাটা আমার পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকলেও মানা যাইতো, বাড়িতে গিয়ে আমার আম্মাকে পর্যন্ত কথা শোনাচ্ছেন। ১০ দিন আগের বক্তব্য কাট করে প্রোপাগান্ডা না ছড়ালেও পারতেন। পুরো বক্তব্য তুলে ধরলে বক্তব্যের সারমর্ম বুঝতে পারতো মানুষ।
কেবল তো শুরু, আরও পাঁচদিন বাকি। ততদিনে কি যে ঘটবে, সেটা ভাবতে গেলে আরও বেশি ট্রমাটাইজড হয়ে যাই।
সবচেয়ে বেশি কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য, ধর্ষণ এবং হুমকি পেয়েছেন ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের নারী প্রার্থীরা। এই প্যানেলের ফাতেমা তাসনিম জুমা একাই ৬৯৩টি অভিযোগ সংরক্ষণ করেছেন; যেখানে তাকে ধর্ষণের হুমকি, নির্যাতন, এমনকি পতিতাসম (স্লাট শেমিং) করা রয়েছে। এ সকল আইডি ও পেজে ঘুরে দেখা গেছে ছাত্রশিবিরের বিরোধী মতাদর্শের প্রতি তাদের সমর্থন আছে। কেউ কেউ আবার বিভিন্ন ইউনিটের পদধারী।
এদিকে, একই প্রার্থী এর আগে ছাত্রশিবিরের সমর্থক বট অ্যাকাউন্ট থেকেও হুমকি-ধমকি পেয়েছেন, যেমন পেয়েছেন ছাত্রদলের বট অ্যাকাউন্ট থেকেও। কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যের বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য জুমা ছাত্রদল মনোনীত এজিএস পদপ্রার্থী তানভীর হাদী আল মায়েদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে, মায়েদ বলেন অভিযোগ দাও।
অপরদিকে, শিবিরের দপ্তর সম্পাদক সিবগাতুল্লাহ সিবগাকে অবহিত করা হলে তিনি জুমাকে উত্তর দেন, হ্যাঁ, সে যা করেছে তা একটি গুরুতর অপরাধ। আমরা চট্টগ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ করছি এবং তাকে শনাক্ত করার জন্য কাজ করছি। ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। এ দু’টি স্ক্রিনশটই জুমা পোস্ট করেছেন নিজের আইডি থেকে। শিরোনামে তিনি লিখেছেন শিবিরের বট অ্যাটাক আমিও কম খাই নাই।
কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য কেবল মন্তব্যঘরে নয়, বার্তাঘর তথা ইনবক্সেও পৌঁছে যাচ্ছে। ছাত্রদলের ৭ নম্বর হাবিবপুর ওয়ার্ডের সভাপতি পদপ্রার্থী মো. আরিফ ডাকসু’র ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক পদপ্রার্থী উম্মে সালমার ইনবক্সে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেন। এ সংক্রান্ত একটি স্ক্রিনশট তিনি তার ফেসবুক ওয়ালে পোস্ট করেছেন। আশিকুর রহমান নামে আরেক বিএনপি সমর্থক মন্তব্যঘরে ছাত্রী সংগঠনের নেত্রীদের ধর্ষণের ইচ্ছা ব্যক্ত করে।
সাদিক কায়েম, এস এম ফরহাদ, আবিদুল ইসলাম খানের বিভিন্ন পোস্টের মন্তব্যঘরেও একইরকমভাবে বাজে মন্তব্য চলতে থাকে। যদিও নারী প্রার্থীদের মতো ভয়াবহ রকমের হুমকি কিংবা যৌন নিপীড়নমূলক মন্তব্য কম। তবে অনেক বেশি পরিমাণে আছে অশ্রাব্য গালাগালি, মারধর এবং হত্যার হুমকি। কথার ভঙ্গি, চলার ভঙ্গি নিয়েও বাজে মন্তব্যের শিকার হচ্ছেন আবিদুল ও ফরহাদ। হেভিওয়েট এই দুই প্রার্থী ক্রমাগত এসবের ভেতর দিয়ে কাজ করছেন নির্বাচনী প্রচারণায়।
একটি পোস্টে যখন বট অ্যাটাক হয়, তখন তা সংখ্যায় এত বেশি হয় এবং এত বেশি কুরুচিপূর্ণ হয়; যা সহ্য করার মতো মানসিক শক্তি থাকে না অধিকাংশ প্রার্থীরই। অল্প সময়ে অনেক বেশি গালিগালাজ জমা হয় মন্তব্যঘরে, ফলে হতবিহ্বল অবস্থা সৃষ্টি হয় প্রার্থীদের।
সবমিলিয়ে শেষ বেলায় বেশ স্তিমিত ডাকসু প্রার্থীরা। তবে নির্বাচনের আচরণবিধি মানা, কষ্টসাধ্য প্রচারণা যতটা কাহিনী তাদের করেছে তার চেয়ে অনেক বেশি করেছে মুহুর্মুহু বট অ্যাটাক। মানসিকভাবে ভেঙে পড়া কিংবা মচকে যাওয়া এ সকল প্রার্থীরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন ৯ তারিখের শেষ লড়াইয়ে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য।
এদিকে, ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে সাইবার অপরাধের বিষয়ে কোনো ছাড় দেয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে ডাকসু নির্বাচনের রিটার্নিং কার্যালয় গঠিত আচরণবিধি সংক্রান্ত টাস্কফোর্স ও সাইবার নিয়ন্ত্রণ সেল। বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তর থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, আগামী ৯ই সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনকে ঘিরে প্রচারণার সময় প্রার্থীদের অতীত কর্মকাণ্ড নিয়ে সাইবার বুলিং ও ব্যক্তিগত চরিত্র হননের ঘটনা ঘটছে। বিশেষত ছাত্রী প্রার্থীদের নিয়েও অপপ্রচারের চেষ্টা চলছে, যা মানবাধিকার পরিপন্থি। এ ধরনের অভিযোগ প্রমাণিত হলে ডাকসু আচরণবিধি টাস্কফোর্স ও সাইবার নিয়ন্ত্রণ সেল কঠোর ব্যবস্থা নেবে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ নেয়া হবে বলেও জানানো হয়। রিটার্নিং কর্মকর্তারা স্পষ্ট করেছেন, ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে সাইবার বুলিং কিংবা অপপ্রচারের বিষয়ে কোনো ছাড় দেয়া হবে না।