Image description

বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপানো ঘিরে নানা বিতর্কের পর দেশীয় প্রেস মালিকদের ‘সিন্ডিকেট’ ভাঙতে বই ছাপাতে আন্তর্জাতিক দরপত্র করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর অংশ হিসেবে আগামী শিক্ষাবর্ষের মাধ্যমিকের দরপত্র বাতিল করে পুনঃদরপত্র দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেজন্য এ-সংক্রান্ত বিধিতে কিছু শিথিলতা আনার প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ (ক্রয় কমিটি)। তবে বই ছাপানোর কাজে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা থাকার পরও সরকারের আন্তর্জাতিক দরপত্রে যাওয়ার সিদ্ধান্তের চরম বিরোধিতা করছেন প্রেস ও পেপার মালিকরা। তারা বলছেন, সরকারের এমন সিদ্ধান্তে দেশের কয়েক লাখ মানুষ কর্মসংস্থান হারানোর পাশাপাশি এই শিল্পে ৯০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগে ধস নামবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রমতে, গত মঙ্গলবার সরকারি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অনুষ্ঠিত ক্রয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে বই ছাপাতে আন্তর্জাতিক দরপত্র দিতে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা (পিপিআর) ২০০৮-এর বিধি ৮৩(১)(ক) কিছুটা সংশোধন করা হয়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ৮৩(১)(ক) অনুযায়ী আন্তর্জাতিক উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতির ক্ষেত্রে দরপত্র প্রস্তুত ও দাখিলের জন্য বিজ্ঞাপনের তারিখ থেকে কমপক্ষে ৪২ দিন সময় দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। তবে জরুরি প্রয়োজন বা দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে এ সময়সীমা কমানোর সুযোগ রয়েছে। মঙ্গলবার সেই বিধিতে সংশোধিত প্রস্তাব পাস করেছে ক্রয় কমিটি। এর মাধ্যমে দরপত্রে সময়সীমা ৪২ দিনের পরিবর্তে ১৫ দিনে নামিয়ে আনা হলো। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্তর্জাতিক দরপত্র যাওয়ার জন্যই সরকার বিধিতে এই পরিবর্তন এনেছে। যদিও এ বিষয়ে অফিসিয়ালি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।

এনসিটিবির কর্মকর্তারা বলছেন, দেশীয় দরপত্রের ক্ষেত্রে পিপিআর ২০০৮-এর বিধি ৬১(৪) প্রয়োগ করা হয়। সেখানে ২ কোটি টাকার কম দরপত্র হলে ১৪ দিন, ২ থেকে ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত ২১ দিন এবং ৫ কোটি টাকার ঊর্ধ্বে হলে ২৮ দিন সময় নির্ধারণ রয়েছে। তবে জরুরি প্রয়োজন বা দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে এ সময়সীমা ১০ দিন করার বিধান রয়েছে। সরকার ৬১ বিধিতে সংশোধনী না এনে ৮৩(১) বিধিতে সংশোধনী প্রস্তাব পাস করেছে। তার মানে এটা স্পষ্ট—সরকার বই ছাপাতে আন্তর্জাতিক দরপত্র দেওয়ার জন্যই সংশোধনী এনেছে।

জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ক্রয় ও অর্থনৈতিক অধিশাখার উপসচিব মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান ভূঁইয়া কালবেলাকে জানান, বই ছাপানোর কাজটি যেহেতু জরুরি প্রয়োজন, তাই কমিটি পিপিআর ৮৩ (১)(ক) বিধিতে সংশোধনী এনে দরপত্রের সময়সীমায় কিছু পরিবর্তন এনেছে। আন্তর্জাতিক দরপত্রের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সংশোধিত বিধিতে যেভাবে বলা আছে, দরপত্র সেভাবে হবে।

মঙ্গলবার সরকারের এমন সিদ্ধান্তের পর থেকেই মুদ্রণ শিল্পে আতঙ্ক বিরাজ করছে। প্রেস মালিকরা বলছেন, দেশীয় একটি প্রতিষ্ঠিত শিল্পকে ধ্বংস করতেই পরিকল্পিতভাবে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। মুদ্রণ শিল্প সমিতির একাধিক নেতা কালবেলাকে জানান, এই শিল্পের সঙ্গে ১০ থেকে ১২ লাখ লোক জড়িত। এর মধ্যে সরাসরি জড়িত ৫ লাখের বেশি লোক। কাগজ, কালি, মেশিনারি, প্যাকেজিং, ডিস্ট্রিবিউশন ইত্যাদি কাজে আরও ৫ থেকে ৬ লাখ লোক জড়িত। মুদ্রণ শিল্পে চেইনের সঙ্গে জড়িত কাগজ ও পাল্প ইন্ডাস্ট্রি যেমন পেপার মিল, আমদানিকারক, প্রিন্টিং মেশিনারি আমদানি ও সার্ভিস, বই বাইন্ডিং, প্যাকেজিং সেক্টর। বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপার কাজ বিদেশিদের হাতে গেলে দেশীয় এই শিল্প ধ্বংস হবে—এমন আশঙ্কা তাদের।

এনসিটিবির কর্মকর্তারা বলছেন, প্রাথমিকের ৯ কোটি বই ছাপার কেনাকাটার প্রস্তাব অনুমোদন করা হলেও আটকে দেওয়া হয়েছে মাধ্যমিকের ২১ কোটি বই কেনাকাটার প্রস্তাব। গত ১৯ আগস্ট ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির জন্য ১১ কোটি ৮৯ লাখ ৩২ হাজার ৮০২ কপি বই ছাপানোর জন্য তিনটি প্রস্তাব ক্রয় কমিটিতে উত্থাপন হয়, যার মোট ব্যয় ধরা হয় ৬০৩ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। নানা অভিযোগ তুলে সেটি অনুমোদন দেয়নি কমিটি।

এর আগে বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপানো ঘিরে নানা বিতর্ক দেখা দেয়। এনসিটিবির কর্মকর্তারা জানান, চলতি বছর দেশীয় প্রেস মালিকরা নিজেদের মধ্যে সমঝোতা বা সিন্ডিকেট করে দরপত্র দেওয়ায় সরকারের ৩২৩ কোটি টাকা গচ্চা যাচ্ছে। গত বছর নিম্নমানের বই দিয়েছে অন্তত ৪০টি প্রেস। এর আগের বছরগুলোয় একইভাবে নিম্নমানের বই দিয়ে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার ভর্ৎসনার শিকার হয় দেশীয় মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো। শুধু তাই নয়, বইয়ের মান মনিটরিংয়ের দায়িত্বে থাকা ইন্সপেকশন এজেন্টদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ ওঠে। আর্থিক সুবিধা নিয়ে নিম্নমানের বইকে ভালোমানের বই বলে সত্যায়ন করে এজেন্সিগুলো। এ ছাড়া সরকারের ক্রয় কমিটির কাছে অভিযোগ ছিল, চলতি বছর ৩০ কোটির বেশি বইয়ের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি কাজ যাচ্ছে আওয়ামীপন্থি প্রেস মালিকদের কাছে। বিশেষ করে সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের ছোট ভাই জুলাই আন্দোলনে হত্যা মামলার আসামি রব্বানী জব্বারের মালিকানাধীন আনন্দ প্রিন্টার্স ও এপেক্স প্রিন্টার্স তিন শ্রেণিতে ১৬টি লটে ৭২ লাখ বইয়ের কাজ পাওয়ায় আপত্তি তোলা হয়। সাবেক একজন মন্ত্রীর ভাই এ সময়ে কীভাবে কাজ পায়, সেই প্রশ্ন তুলে বিষয়টি শিক্ষা উপদেষ্টার কাছে জানতে চান কমিটির অন্য সদস্যরা। এ ছাড়া ২২৭টি লটের বিপরীতে ৯টি প্যাকেজ করায় আপত্তি তোলে টেকনিক্যাল কমিটি। এত অভিযোগ ও বিতর্কের মধ্যেই গত ২৬ আগস্ট ক্রয় কমিটি পিপিআর ৮৩(১)(ক) বিধিতে সংশোধনী আনে।

জানা গেছে, এরই মধ্যে দুই ভাগে প্রাথমিক পর্যায়ের প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির জন্য ১৯০টি লটে ৭ কোটি ৬৭ লাখ বই ছাপার প্রস্তাব অনুমোদন করেছে ক্রয় কমিটি। এতে মোট ব্যয় হবে ৩৮৮ কোটি ২ লাখ ৮৫ হাজার ৬৮৮ টাকা। ক্রয় কমিটি থেকে ফেরত আসা ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিতে মোট লট ছিল ২৭০টি। এর মধ্যে বইয়ের সংখ্যা ছিল ১১ কোটি ৮৯ লাখ। এতে মোট ব্যয় ধরা হয় ৬০৩ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। অন্যদিকে মাদ্রাসা পর্যায়ের ইবতেদায়ির ৫০টি লটের দরপত্র মূল্যায়ন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে এনসিটিবি। নবম-দশম শ্রেণিতে সবচেয়ে বেশি লট। এ দুই শ্রেণিতে ২৩৪টি লটের দরপত্র মূল্যায়ন পর্যায়ে রয়েছে। দরপত্র মূল্যায়ন যখন প্রায় শেষ, ঠিক এ সময়ে এসে দরপত্র বাতিল করায় এনসিটিবির কর্তা-ব্যক্তিরা বলছেন, এখন ফের দরপত্র দিয়ে জানুয়ারির মধ্যে বই দেওয়া অনেকটা কঠিন। তবে প্রাথমিকের বই ছাপানোর অনুমোদন হয়ে যাওয়ায় মাধ্যমিকের বই ছাপাতে চাপ কিছুটা কমবে। তবে সরকার যেহেতু দরপত্র জমা দেওয়ার সময়সীমা কমিয়েছে, এর সঙ্গে মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার অন্যান্য ধাপ দ্রুত সময়ে শেষ করা গেলে ডিসেম্বরের মধ্যে বই দেওয়া সম্ভব।

জানতে চাইলে এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক রিয়াদ চৌধুরী বুধবার কালবেলাকে বলেন, সরকার মাধ্যমিকে বইয়ের দরপত্র বাতিল করেছে—এমন কোনো সিদ্ধান্তের কথা অফিসিয়ালি জানি না, তবে শুনেছি। এখন সরকার যেভাবে সিদ্ধান্ত দেবে, সেভাবে কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, দরপত্র জমার সময়সীমা ১৫ দিন করা হয়েছে, আমাদের পক্ষ থেকে মূল্যায়নসহ অন্যান্য কাজ দ্রুত শেষ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। জানুয়ারির ১ তারিখের মধ্যে সব বই দেওয়া এখন আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।

প্রেস মালিকরা বলছেন, বই ছাপার ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ কাঁচামাল হলো কাগজ। বাংলাদেশ প্রেস মালিকরা বর্তমানে প্রতি টন কাগজ কিনছেন ১ লাখ ২৫ হাজার টাকায়। চীনে একই মানের কাগজের দাম ৭৭ থেকে ৮০ হাজার টাকা। কাজ পেলে চীন সরকার তাদের নানা ধরনের ভর্তুকি দেবে। ফলে বর্তমানে ফর্মাপ্রতি লোকাল প্রেস ৩ টাকা ১৫ পয়সায় রেট (দর) দিলে চীন ২ টাকা ২০ পয়সায় রেট দেবে। অর্থাৎ বই ছাপার প্রতিযোগিতায় দেশীয় প্রেস মালিকরা কোনোভাবেই টিকতে পারবে না। শুধু চীন নয়, এ কাজে যুক্ত হতে দক্ষিণ কোরিয়াও আগ্রহ প্রকাশ করেছে। আর ভারত যদি সে সুযোগ পায়—তবে পুরো বই ছাপার কাজ চলে যাবে বিদেশিদের হাতে।

এমন পরিস্থিতি দফায় দফায় বৈঠক করেছেন মুদ্রণ শিল্প সমিতির নেতারা। আন্তর্জাতিক দরপত্র ঠেকাতে তারা সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে যোগাযোগ করছেন। ১০ থেকে ১২ লাখ মানুষ যে শিল্পের সঙ্গে যুক্ত, সেটা বিনা কারণে বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া পিপিআরের লঙ্ঘন—এ বিষয়টি সরকারকে বোঝাতে চায় তারা। পিপিআর ২০০৬ এবং ২০০৮ অনুযায়ী গোপনীয়তা ও স্থানীয় শিল্প সংরক্ষণের জন্য কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে বিদেশি দরপত্রদাতাদের বিশেষ কিছু খাতে দরপত্র দেওয়ার বিধান নেই। এর মধ্যে রয়েছে জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা-সংক্রান্ত কাজ, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত বা সহজলভ্য পণ্য ও সেবা, ছোট ও মাঝারি আকারের প্রকল্প, প্রিন্টিং ও প্রকাশনা কাজ, তথ্যপ্রযুক্তি সেবা, স্থানীয় কৃষিপণ্য ও খাদ্য সরবরাহ। প্রিন্টিং ও প্রকাশনা কাজের মধ্যে সরকারি বই, প্রশ্নপত্র, গোপন নথি, সিকিউরিটি পেপার প্রিন্টিং অন্তর্ভুক্ত।

সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশনের এক্সপোর্ট অ্যান্ড মার্কেট ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান মুস্তাফিজুর রহমান কালবেলাকে বলেন, এটা সরকারের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে। কারণ, এ খাতে শুধু পেপার মিলগুলোর ৭০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। আর প্রেস মালিকদের রয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা। এখানে সরাসরি ও পরোক্ষভাবে ১০ থেকে ১২ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান জড়িত। আন্তর্জাতিক দরপত্র হলে এত লোক বেকার হয়ে যাবে। এমন সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের জন্য এরই মধ্যে সরকারের শীর্ষ মহলের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। শিক্ষা উপদেষ্টা ও সচিবকে বিষয়টি জানানো হয়েছে।