Image description
ডাকসুর শীর্ষ ৩ পদে লড়াই

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে ক্যাম্পাসজুড়ে। আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরুর পর ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছেন প্রার্থীরা। এবারের নির্বাচনে বড় ছাত্র সংগঠনের প্যানেল ছাড়াও ব্যক্তিগত পরিচিতি ও নেতৃত্বগুণে বেশ কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থীও আলোচনায় উঠে এসেছেন। সংশ্লিষ্টদের মতে, ডাকসুর ইতিহাসে দলীয় প্যানেলের আধিপত্য থাকলেও এবার কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থী শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে পারেন।

ডাকসু নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, এবারের নির্বাচনে রেকর্ডসংখ্যক প্রার্থী অংশ নিচ্ছেন। ১০টি প্যানেল ও স্বতন্ত্র মিলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৪৭১ জন প্রার্থী। তবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন ছাত্রদল, শিবির, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ, ছাত্র অধিকার পরিষদসহ বড় কয়েকটি সংগঠন ও একাধিক স্বতন্ত্র প্যানেলের প্রার্থীরা। তাদের নিয়েই বেশি মাতামাতি হলেও স্বতন্ত্র কয়েকজন প্রার্থীও ভোটের ফলে চমক দেখাতে পারেন বলে মনে করছেন অনেকেই। দলীয় প্যানেলের বাইরে ব্যক্তিগত পরিচিতি, নেতৃত্বের গুণাবলি, বাকপটুতা ও ক্যাম্পাসে সক্রিয় ভূমিকায় আলোচনায় উঠে এসেছেন এসব প্রার্থী। পর্যবেক্ষকদের মতে, সহসভাপতি (ভিপি), সাধারণ সম্পাদক (জিএস) কিংবা সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে তাদের কেউ নির্বাচিত হলে সেটি অবাক করার কিছু হবে না।

এমন প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন—ভিপি পদে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী শামীম হোসেন। জিএস পদে আইন বিভাগের আরাফাত হোসেন এবং ইংরেজি বিভাগের আশিকুর রহমান। এজিএস পদে গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের প্যানেলে কাঙ্ক্ষিত পদে মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করা তাহমিদ আল মোদাসসির চৌধুরী, সানজানা আফিফা অদিতি এবং আশিকুর রহমান জীম আলোচনায় এগিয়ে আছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বলছেন, দলীয় এবং বিভিন্ন প্যানেলের প্রার্থীরা বেশি আলোচনায় আছেন। সুযোগ-সুবিধাও তারা বেশি পাচ্ছেন। তবে এর বাইরে কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থী আলাদাভাবে নজর কেড়েছেন। বিশেষত, যেসব শিক্ষার্থী রাজনীতিবিমুখ তারা আলোচনায় থাকা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের দিকেই ঝুঁকছেন। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের দাবি, প্যানেলভুক্ত প্রার্থীদের বেশি সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। আচরণবিধি লঙ্ঘন করলেও তাদের বিরুদ্ধে নেওয়া হচ্ছে না কোনো ব্যবস্থা। কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থী এসব বিষয়ে নির্বাচন কমিশন বরাবর অভিযোগও করেছেন।

ভিপি প্রার্থী শামীম হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী। কোনো ধরনের দলীয় বা স্বতন্ত্র প্যানেলের অংশ না হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে লড়ছেন ভিপি পদে। তাকে ঘিরে এরই মধ্যে বিস্তর আলোচনা চলছে ক্যাম্পাসজুড়ে। বিশেষ করে তার বাকপটুতা নজর কাড়ছে সবার। শামীম জোর দিয়েছেন একাডেমিক রিফর্মের (সংস্কার) বিষয়ে, যা শিক্ষার্থীরাও পছন্দ করছেন। তিনি বলেন, ‘ডাকসুতে সবাই আদর্শিক লড়াই করবে, আমি একাডেমিক রিফর্মের রাজনীতি করব। যেটা আমার কমফোর্ট জোন।’ এ ছাড়া নির্বাচিত হলে শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে ইংরেজি ভাষা শেখার ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতিও তাকে আলোচনায় রেখেছে।

শামীম বলেন, ‘আমি ভিপি হলে সবাই ভিপি হবে। আমি এখনো সরাসরি নিয়মিত ছাত্র, ১৯-২০ সেশন বা (রানিং) এমএ ব্যাচ থেকে ভিপি পদে দাঁড়িয়েছি। আমার আর আপনার মধ্যে দূরত্ব কেবল একটি ব্যালটের এপার-ওপারে। আমি রাজনৈতিক নেতা হতে আসিনি, শিক্ষার্থীদের দাবি আদায়ে তাদের প্রতিনিধি হতে চাই।’

স্বতন্ত্র জিএস প্রার্থী হিসেবে আলোচনার তুঙ্গে আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী আরাফাত চৌধুরী। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য প্রতিষ্ঠিত ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা মঞ্চ’র সহ-প্রতিষ্ঠাতা তিনি। এ প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে অনেক শিক্ষার্থীকে সহায়তা করেছেন। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের আইনগত সহায়তা দিতে প্রতিষ্ঠা করেছেন সাইবার এইড বাংলাদেশ নামে একটি সংগঠন। এ ছাড়াও অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুদের নিয়ে কাজ করা সেবাধর্মী সংগঠন ‘সেভ দ্য টুমরো’-র সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করে আসছেন।

আরাফাত চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, ‘প্যানেলের প্রার্থীরা অনেক সময় দলীয় স্বার্থে আবদ্ধ থাকে; কিন্তু আমি শুধু শিক্ষার্থীদের স্বার্থেই কাজ করব। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আমার সবচেয়ে বড় শক্তি হলো স্বাধীনতা। আমার সিদ্ধান্ত, আমার পরিকল্পনা, আমার কর্মসূচি হবে একান্তই শিক্ষার্থীদের কল্যাণকে কেন্দ্র করে। প্যানেলের প্রার্থীদের চ্যালেঞ্জ হলো সংগঠনের চাপ ও দলীয় এজেন্ডা, কিন্তু আমার চ্যালেঞ্জ হলো শিক্ষার্থীদের আস্থা অর্জন করা এবং সেটিই আমার আসল শক্তি। শিক্ষার্থীরা যখন দেখবেন যে একজন প্রার্থী তাদের জন্য নিরলসভাবে কাজ করতে চায়, দলীয় নির্দেশনা বা গোষ্ঠীগত স্বার্থের বাইরে থেকে, তখন আমি বিশ্বাস করি তারা আমাকেই বেছে নেবেন আস্থার কারণে, ভিশনের কারণে এবং তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমার দৃঢ় প্রতিশ্রুতির কারণে।’

এবারের ডাকসু নির্বাচনে জিএস পদের আরেক আলোচিত প্রার্থী মো. আশিকুর রহমান। ভিন্নধর্মী এক ইশতেহার ঘোষণা করে আলোচনায় এসেছেন তিনি। সেটার শিরোনামে আশিকুর লিখেছেন, ‘ডাকসুতে আগুন লাগাতে চলে এলাম বন্ধুরা’। ফেসবুকে দেওয়া পোস্টারে আশিকুরের চোখে সানগ্লাস, হাতে লাইটার আর ঠোঁটে জ্বলন্ত সিগারেট দেখা গেছে। তার এই ব্যতিক্রমী প্রচার তরুণদের মধ্যে আলোচনার জন্ম দেয়। তবে অনেকেই এর সমালোচনাও করেছেন। আশিকুর ইংরেজি বিভাগের ২০২২-২৩ সেশনের শিক্ষার্থী।

এক সাক্ষাৎকারে আশিকুর রহমান বলেন, ‘ডাকসু নির্বাচনে আমি অন্তত মেঘমল্লার বসুকে হারাব। আমি যেহেতু একটা পদে দাঁড়িয়েছি, অবশ্যই আমি একটা কিছু নিয়ে ফিরব। যারা আদর্শের রাজনীতি করে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে লোয়েস্ট ক্যান্ডিডেট হলো মেঘমল্লার। ওরে যদি না হারাতে পারি, তাহলে তো আমার ম্যান্ডেটই থাকবে না।’

বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ (বাগছাস) থেকে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় থাকলেও সংগঠনটির প্যানেলে ঠাঁই না পাওয়ায় শেষ মুহূর্তে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে এজিএস পদে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেন বাগছাসের মুখ্য সংগঠক তাহমিদ আল মোদাসসির চৌধুরী। সাংগঠনিক দক্ষতা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, বিতর্ক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে সম্পৃক্ত থাকায় শিক্ষার্থীদের মনে জায়গা করে নিয়েছেন এ প্রার্থী।

তাহমিদ কালবেলাকে বলেন, ‘এবারের ডাকসু নির্বাচন অন্যান্য সময়ের চেয়ে আলাদা। প্যানেলগুলোর ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের ভয় যেমন আছে, শঙ্কাও আছে। তারা আবারও কি ছাত্ররাজনীতির কালো থাবার মধ্যে নিয়ে যাবে? আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের কো-কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিজের সঙ্গে জড়িত ছিলাম, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা দীর্ঘদিনের। এ ছাড়া আমার লিডারশিপ স্কিল, সততা এবং নিষ্ঠার জায়গাগুলো শিক্ষার্থীদের কাছে প্রমাণ করেছি। আমার ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে একটি শিক্ষা, গবেষণা ও শিক্ষার্থীবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার এ যাত্রায় শিক্ষার্থীরা আমাকে বেছে নিবে বলে বিশ্বাস করি।’

এ ছাড়া এই পদে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেন একই সংগঠন থেকে মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করা সানজানা আফিফা অদিতি এবং আশিকুর রহমান জীম। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু থেকেই ছাত্রলীগের নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন অদিতি। ক্যাম্পাসে ছাত্র অধিকার পরিষদ এবং পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। অন্যদিকে জুলাই গণঅভ্যুত্থান চলাকালে ছাত্রলীগ থেকে সর্বপ্রথম পদত্যাগ করে আন্দোলনকে ভিন্নমাত্রা দিয়েছিলেন জীম। এরপর থেকেই ক্যাম্পাসে বেশ আলোচনায় আছেন এই শিক্ষার্থী।

সানজানা আফিফা অদিতি কালবেলাকে বলেন, ‘স্বতন্ত্র হিসেবে একটু চ্যালেঞ্জ হয়ে যায়। কারণ, লড়াইটা শুধু নিজের এবং শুধু একাই লড়তে হয়। একটি দলের ফান্ড থাকে, মিডিয়া থাকে এবং কাজ করার জন্য কর্মী থাকে। একক লড়াইয়ে তার কিছুই থাকে না। তবে এটাই আমার জন্য পরীক্ষা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার একজন এজিএস হিসেবে শক্ত এবং লড়াকু প্রার্থী চায়। যে এই লড়াই শেষ দিন অবধি চালিয়ে যেতে পারবে, সে বিশ্ববিদ্যালয়ের হালও শক্তভাবে ধরতে পারবে। শিক্ষার্থীদের সমর্থন ও ভালোবাসার কাছে এসব বাধা কোনো বাধা নয়। পেছনে দলীয় কর্মী নেই, কিন্তু পাশে পরিবার ও বন্ধুরা আছেন।’

আর আশিকুর রহমান জীম বলেন, ‘জুলাই এবং জুলাই-পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশের প্রয়োজনে আমি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছি। দেশের স্বার্থে কখনোই পিছপা হইনি। এই বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষার্থীদের জন্যও আমি পিছপা হবো না। আমি আশা করি, শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিনিধি হিসেবে আমাকে বেছে নেবে। যদিও প্যানেলভুক্ত কিছু প্রার্থীকে বেশি সুবিধা দেওয়া হচ্ছে বলে আমি মনে করি।’