Image description
রাজনৈতিক সরকার এ ব্যবস্থা ধরে রাখতে চায়

আওয়ামী সরকারের আমলে ফোনে আড়ি পাতার তদন্তের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে কমিটি গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। কোথা থেকে কত টাকায় এসব যন্ত্র কেনা হয়েছে, কীভাবে ব্যবহার করা হয়েছে পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখবে গঠিত কমিটি। এ বিষয়ে শিগগিরই প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। কমিটি বিদেশি বিশেষজ্ঞদেরও মতামত নিতে পারবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, নজরদারি কেবল কল রেকর্ডেই সীমাবদ্ধ ছিল না; গড়ে তোলা হয়েছিল যেকোনো ডিভাইসের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার কাঠামো।

তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তা ও বেসিসের সাবেক সভাপতি ফাহিম মাশরুর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বর্তমান সরকারের আমলেই এনিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। রাজনৈতিক সরকার এসব ব্যবস্থা ধরে রাখতে চায়। তাই নতুন সরকার আসার আগেই আড়িপাতা নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তিনি আরও বলেন, অনেক আগেই বিষয়টি নিয়ে তদন্তের উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিল। মানবাধিকার ও ব্যক্তিনিরাপত্তা ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। কারা কিনেছে, কত টাকা ব্যয় হয়েছে, ভেন্ডর কারা ছিল- এসব তদন্ত করে শ্বেতপত্র প্রকাশ করা উচিত। ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি)-কে বিলুপ্ত করা প্রয়োজন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রজ্ঞাপন জারির পর তদন্তের কাজ এগিয়ে নেওয়া হবে। প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও আইসিটি বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবের নাম কমিটির প্রধান হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি বলেন, বাস্তব পরিস্থিতি ও বিগত আওয়ামী সরকারের ফ্যাসিস্ট আচরণের নমুনা পাওয়া যাবে তদন্তে।

নজরদারির কাজে নিয়োজিত দুটি সংস্থার কথা উঠে আসে। একটি ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি)। অপরটি ডিপার্টমেন্ট অব টেলিকমিউনিকেশন (ডিওটি)। এ দুটি সংস্থাকে বিলুপ্ত করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন অনেকে। এনটিএমসি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ডিওটি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এক বছরে দেড় লাখ ফোনকল রেকর্ড করা হয়। রাজনৈতিক ব্যক্তি কিংবা আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য হুমকি- এমন ব্যক্তিদের ফোনকল রেকর্ড করে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে ফাঁস করা হয়। এ কাজটি করেন এনটিএমসির সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (বরখাস্ত) জিয়াউল আহসান। তার বিরুদ্ধে গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ রয়েছে। জিয়াউল আহসান ২০২২ সাল থেকে এনটিএমসি মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে কয়েকটি মামলায় আটক রয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে আড়িপাতার সরঞ্জাম কেনার প্রবণতা বেড়ে যায়। যা থেকে বোঝা যায়, ভিন্নমত দমনের মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখতে এসব নজরদারি প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়েছে। বিষয়টি সম্প্রতি অফিসিয়ালি জানানো হয় জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনকে। এতে তারা বিস্ময় প্রকাশ করেছে বলে সূত্র জানায়। ২০০৮ সালে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং মোবাইল অপারেটরদের অর্থায়নে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ের ভবনে গঠিত হয় ন্যাশনাল মনিটরিং সেন্টার (এনএমসি)। ২০১৩ সালে নাম বদলে এনটিএমসি হয়। ২০১৪ সাল থেকে স্বতন্ত্র সংস্থা হিসেবে এটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে কার্যক্রম শুরু করে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, নজরদারি ও আড়িপাতায় সবচেয়ে বেশি খরচ করেছে এনটিএমসি। ২০১৬ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে ব্যয়ের পরিমাণ ৫২ মিলিয়ন ডলার বা ৬৩১ কোটি টাকা। আড়িপাতার যে কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছিল, নির্ধারিত কোনো প্রক্রিয়া না মেনেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের তাতে প্রবেশাধিকার ছিল। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারের উচ্চপর্যায়ের এক নীতিনির্ধারক বলেন, ক্ষমতার চেয়ারের সুরক্ষা করতে আইন ও নীতির তোয়াক্কা না করে এসব ফোনকল রেকর্ড করা হয়। যারাই আওয়ামী লীগ সরকারের বিরোধিতা করেছে বা ভিন্নমত পোষণ করেছে তাদেরই ফোনকল রেকর্ড করা হতো।

বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আলোচনা হয়। পরে এ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, সারভেইলেন্সের যন্ত্রপাতি বিগত সরকারের সময় কেউ বলছেন প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলারে কেনা হয়েছে। কেউ বলছেন, প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলারে কেনা হয়েছে। পুরো রিপোর্টে আমরা যা পড়েছি সেখানে স্পষ্ট- গত স্বৈরাচারী সরকার নাগরিক অধিকার হরণের জন্য নজরদারির যন্ত্রপাতি, স্পাইওয়ার ব্যবহার করেছে। কেড়ে নেওয়া হয় ন্যূনতম বাক-স্বাধীনতা। সংবিধানে যে গোপনীয়তার অধিকার দেওয়া হয়েছে, তা খর্ব করা হয়েছে। কোথা থেকে কত টাকায় এগুলো কেনা হয়েছে, যদিও রিপোর্টে বলা হয়েছে অনেক কিছু ইসরায়েল থেকে কেনা হয়েছে- পুরো বিষয়টি কমিটি খতিয়ে দেখবে।