
দেশের সর্ববৃহৎ রাজস্ব সংগ্রাহক প্রতিষ্ঠান জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) চলছে নজিরবিহীন অস্থিরতা। মাত্র দুই সপ্তাহেরও কম সময়ে সংস্থাটির ৪ শতাধিক কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। এর বাইরে বিভিন্ন সময়ে ৩০ জনের বেশি সাময়িক বরখাস্ত এবং পাঁচ জনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। সর্বশেষ আন্দোলনে অংশ নেওয়ার অভিযোগে গত মঙ্গলবার একসাথে ৯ জন কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়।
প্রতি বছর বাজেটের পর মাঠ প্রশাসনে কিছুটা রদবদল হওয়া নতুন কিছু নয়। তবে এবার পরিবর্তনের সংখ্যা, গতি এবং শাস্তিমূলক পদক্ষেপের ধরন—সব মিলিয়ে রাজস্ব প্রশাসনে এক অনাকাঙ্ক্ষিত অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। কর্মকর্তাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা। বদলি-বরখাস্তের ঝড়
গত ১২ আগস্ট থেকে একের পর এক বদলির নির্দেশ আসতে শুরু করে।
১২ আগস্ট বদলি হন কাস্টমস ক্যাডারের ৭৩ জন উপ-কমিশনার। ১৩ আগস্ট বদলি হন ৮৪ জন উপ-কর কমিশনার ও ৬ জন কমিশনার। ১৭ আগস্ট বদলি করা হয় ৯ জন কাস্টমস কমিশনারকে। ১৮ আগস্ট একসঙ্গে ১৩১ জন সহকারী কর কমিশনার, ১৯ আগস্ট বদলি করা হয় ৪১ জন অতিরিক্ত কর কমিশনারকে। ২০ আগস্ট বদলি হন শতাধিক কর্মকর্তা, বরখাস্ত হন একজন উপ-কর কমিশনার। ২১ আগস্ট সাময়িক বরখাস্ত করা হয় উপ-কর কমিশনার লিংকন রায়কে, তার বিরুদ্ধে ১৪৬ কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতির অভিযোগ আনা হয়েছে।
রবিবার (২৪ আগস্ট) জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাস্টমস অ্যান্ড এক্সাইজ ক্যাডারের চার কর্মকর্তাকে নতুন কর্মস্থলে বদলি ও পদায়ন করেছে। এনবিআরের কাস্টমস ও ভ্যাট প্রশাসন-১ শাখা থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী উপ-কমিশনার অনুরূপা দেবকে কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট চট্টগ্রামে, যুগ্ম কমিশনার চপল চাকমাকে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরে, অতিরিক্ত কমিশনার মো. মুশফিকুর রহমানকে কাস্টমস হাউজ বেনাপোলে এবং অতিরিক্ত কমিশনার মো. মিলন শেখকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে পদায়ন করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সোমবার (২৫ আগস্ট) থেকে নতুন কর্মস্থলে যোগদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এভাবে টানা দুই সপ্তাহে বদলি করা হয়েছে প্রায় ৪ শতাধিক কর্মকর্তাকে। এর বাইরে গত ছয় সপ্তাহে বদলির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫০০-এর বেশি। শাস্তিমূলক ব্যবস্থায় এখন পর্যন্ত বরখাস্ত হয়েছেন ৩০ জনের বেশি এবং বাধ্যতামূলক অবসরে গেছেন ৫ জন কর্মকর্তা। বাংলাদেশের রাজস্ব প্রশাসনের ইতিহাসে এটি এক নজিরবিহীন ঘটনা।
আন্দোলনের পটভূমি
অন্তর্বর্তী সরকার সম্প্রতি এনবিআর বিলুপ্ত করে দুটি নতুন বিভাগ গঠন করেছে—রাজস্ব নীতি বিভাগ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ।
সরকারের যুক্তি, নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন আলাদা হলে স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বাড়বে। কিন্তু এনবিআরের কর্মকর্তারা মনে করেন, এতে প্রশাসন ক্যাডারের কর্তৃত্ব বেড়ে গেছে, আর কাস্টমস ও ট্যাক্স ক্যাডারের গুরুত্ব কমে গেছে।
এ নিয়ে প্রথমে সীমিত কর্মবিরতি শুরু হলেও পরবর্তীকালে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়। জুনের শেষ দিকে চট্টগ্রাম বন্দর, ঢাকা কাস্টমস হাউজ ও বেনাপোলে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম কার্যত অচল হয়ে পড়ে। ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন, সরকার রাজস্ব হারায় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়।
এক ব্যবসায়ী নেতা তখন বলেছিলেন—“যুদ্ধ পরিস্থিতি ছাড়া বাংলাদেশে বন্দরের এমন অচলাবস্থা নজিরবিহীন।”
এরপরই সরকার কঠোর অবস্থান নেয়। আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে শুরু হয় বদলি, বরখাস্ত ও অবসরের ঝড়।
সংস্কারের প্রয়োজন বনাম আস্থার সংকট
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত মাত্র ৭ শতাংশ— যা বিশ্বের অন্যতম সর্বনিম্ন। দুই দশক ধরে কর ব্যবস্থার অটোমেশনের কথা বলা হলেও এর অগ্রগতি নগণ্য। একইসঙ্গে প্রভাবশালী গোষ্ঠী কর ছাড়ের সুযোগ নিচ্ছে, অসৎ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে রাজস্ব ফাঁকি অব্যাহত রয়েছে।
এনবিআরের নিজস্ব হিসাব বলছে— সরকারের রাজস্ব আদায়ের সমপরিমাণ অর্থ কর অব্যাহতি ও কর ব্যয়ের মাধ্যমে হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে সংস্কার অপরিহার্য হলেও তার বাস্তবায়নের কৌশল ও স্বচ্ছতার ঘাটতি উল্টো অনিশ্চয়তা তৈরি করছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান মন্তব্য করেন— “রাজস্ব প্রশাসনের আধুনিকায়ন জরুরি ছিল। কিন্তু এনবিআরকে দুটি বিভাগে ভাগ করার পদক্ষেপ খণ্ডিত আকারে নেওয়া হয়েছে। এতে কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ ও স্বচ্ছতার অভাব আস্থার সংকট আরও বাড়িয়েছে।”
অধ্যাদেশে সংশোধনী: সমাধান কতটা?
কর্মকর্তাদের অসন্তোষ কমাতে সরকার দ্রুত অধ্যাদেশ সংশোধন করে। গত ২১ আগস্ট উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদিত ‘রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫’ অনুযায়ী— রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের নেতৃত্ব দেবেন অভিজ্ঞ রাজস্ব কর্মকর্তা। তবে রাজস্ব নীতি বিভাগে নিয়োগ দেওয়া যাবে প্রশাসন ক্যাডার বা এনবিআর ক্যাডার উভয়ের মধ্য থেকে।
ফলে কর্মকর্তাদের দাবি আংশিক পূরণ হলেও অসন্তোষ পুরোপুরি কাটেনি।
সাবেক এনবিআর সদস্য ফরিদ উদ্দিন বলেন, “কর্মকর্তাদের দাবি যৌক্তিক হলেও আন্দোলনের ধরন যৌক্তিক ছিল না। এখন আস্থার পরিবেশ তৈরি করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।”
সৎ বনাম অসৎ কর্মকর্তার প্রশ্ন
একটি বিতর্কিত বিষয় হলো— অনেক সৎ কর্মকর্তা কেবল আন্দোলনে অংশ নেওয়ার কারণে চাকরি হারাচ্ছেন। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এতে শুদ্ধাচারের পরিবর্তে দুর্নীতি আরও উৎসাহিত হবে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোরতা যেমন জরুরি, তেমনই সৎ কর্মকর্তাদের প্রণোদনা দেওয়াও সমান গুরুত্বপূর্ণ। কেবল ভয় দেখিয়ে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় সম্ভব নয়।
ব্যাংক তথ্য অ্যাক্সেস নিয়ে বিতর্ক
এনবিআর এখন করদাতাদের ব্যাংক তথ্য রিয়েল-টাইমে জানার সুযোগ চাইছে। এতে বার্ষিক সুদ আয়, উৎসে কর কর্তন, বছরের শেষ দিনের অ্যাকাউন্ট ব্যালান্স অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
কর বিশেষজ্ঞরা একে সময়োপযোগী বললেও ব্যাংকাররা গোপনীয়তা ফাঁসের ঝুঁকি নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, “সংবেদনশীল তথ্য বহু হাত ঘুরে গেলে আমানতকারীরা নিরুৎসাহিত হবেন, ব্যাংক আমানতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।”
তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে এ ব্যবস্থা কর ফাঁকি রোধের পাশাপাশি ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম নিয়ন্ত্রণেও সহায়ক হবে।
সামনে যে চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশ বাজেট ঘাটতি ও ক্রমবর্ধমান ঋণের চাপে আছে। শিগগিরই এলডিসি তালিকা থেকেও বেরিয়ে আসছে দেশ। ফলে রাজস্ব আহরণ বাড়ানো ছাড়া বিকল্প নেই।
কিন্তু এজন্য কেবল কর্মকর্তাদের নয়, করদাতাদের আস্থাও ফিরিয়ে আনতে হবে। সৎ করদাতাদের সুরক্ষা, কর ফাঁকির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা, কর্মকর্তাদের জন্য ভয়ের বদলে প্রণোদনার পরিবেশ—এসব মিলিয়েই একটি ভারসাম্যপূর্ণ সংস্কার প্রয়োজন।
অন্যথায়, এনবিআরের সংস্কার প্রচেষ্টা আস্থা সৃষ্টির বদলে আরও অনিশ্চয়তা বাড়াবে— যার খেসারত গুনতে হবে দেশের গোটা অর্থনীতিকে।