Image description
পরবর্তী সরকার নিয়ে আলোচনা

ঢাকায় অতীতে পাকিস্তানের একাধিক পররাষ্ট্রমন্ত্রী সফর করেছেন। কিন্তু দেশটির বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী কাম উপ-প্রধানমন্ত্রী ইসহাক দারের সদ্য সমাপ্ত সফরটি নানা কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। এটাকে অভূতপূর্ব সফর বলা হচ্ছে। এই সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রায় নিঃশেষ হয়ে যাওয়া তার রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রভাব-ক্ষেত্র ফিরে পেতে চেষ্টা করেছে পাকিস্তান- এমনটাই অনুমান বিশ্লেষক এবং পেশাদারদের। তবে কাজটি সহজ হবে বলে মনে করছেন না তারা। এ প্রসঙ্গে এক পেশাদারের মূল্যায়ন ছিল এমন- ‘বহু বছর পর সম্পূর্ণ নতুন এক প্রেক্ষাপটে সফরটি হয়েছে। তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও উপ-প্রধানমন্ত্রীর প্রটোকল নিয়ে স্পেশাল ফ্লাইটে ঢাকায় আসেন। সঙ্গত কারণেই তাকে বর্ণাঢ্য আনুষ্ঠানিকতায় বরণ করা হয়। সফরটি পূর্ণ দ্বিপক্ষীয় বলে যেসব অ্যাপয়েনমেন্ট চেয়েছে পাকিস্তান তার সবই দেয়া হয়েছে হোস্টের তরফে। কোথাও কোনো কমতি রাখা হয়নি। পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে কয়েক মিনিটের একান্ত বৈঠক হয়েছে। আনুষ্ঠানিক আলোচনা ছিল একঘণ্টার বেশি সময় স্থায়ী। সেখানে ৬টি দলিল সই হয়। অতিথির সম্মানে মধ্যাহ্নভোজ হয়েছে যথাযথ প্রটোকলে। সব মিলে সফরটি ভালো হয়েছে বলতেই হবে। ফল কি? আলোচনার দরজা খুলেছে। তারা তাদেরটা বলেছে, আমরা আমাদের বক্তব্য যথাযথ গুরুত্বে উপস্থাপন করেছি। এই সফরে পাকিস্তানের অর্জন বেশি- এমন সমালোচনা মেনে ওই কর্মকর্তা বলেন, তাদের আরও বেশি প্রত্যাশা ছিল হয়তো। কিন্তু আমরা সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণেই জোর দিয়েছি। বাড়তি কিছু নয়। তবে এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, গত ১৫ বছর ইচ্ছাকৃতভাবে পাকিস্তানকে এড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নথি বলছে-  নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশে বিজিত দেশটির কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এটাই সম্ভবত প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফর! ২০১২ সালে সর্বশেষ পাকিস্তানের আলোচিত পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রব্বানী খার ঢাকা সফর করেন। ইসলামাবাদে ডি-৮ শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানাতে এসেছিলেন তিনি। তখন দুই দেশের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা হলেও তা দ্বিপক্ষীয় সফর ছিল না।

সিনেটর ইসহাক দার বিশেষ বিমানে শনিবার মধ্যাহ্নে ঢাকায় পৌঁছান। ভারতের আকাশ ব্যবহারে বিধিনিষেধ থাকায় চীন ঘুরে তাকে ঢাকায় পৌঁছাতে হয়। রোববার মধ্যরাতে তিনি ফিরে গেছেন জেদ্দাগামী কমার্শিয়াল ফ্লাইটে। আপাতত গন্তব্য সৌদি আরব। গাজার মানবিক সংকট নিয়ে জেদ্দায় ওআইসি পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের জরুরি বৈঠকে অংশ নিতে গেছেন তিনি। ক্যালেন্ডারের হিসাবে সফরটি ৩ দিনের হলেও কার্যত ৩৬ ঘণ্টা বাংলাদেশে ছিলেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তার এই সফর নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক অঙ্গনে। গুরুত্বপূর্ণ ওই সফরের হেতু অন্বেষণে ব্যস্ত সময় পার করছেন বিশ্লেষক এবং পেশাদাররা। তারা যে যার মতো কনক্লুশন ড্র করার চেষ্টা করছেন। সফর সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র গত ক’ঘণ্টায় মানবজমিনকে এটা নিশ্চিত করেছে যে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারকে বরণে দৃশ্যত ঢাকা যতটা আন্তরিকতা দেখিয়েছে বাস্তবে বৈঠকগুলোর পরিবেশ তেমন ছিল না। বরং সেখানে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত ইস্যুগুলোর আলোচনায় উভয়পক্ষ হার্ড টাইম পার করেছে। আলোচনায় একাত্তরের গণহত্যার মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে কথা হয়েছে। যা সঙ্গত কারণেই পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং তার টিমকে অপ্রস্তুত করেছে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের তরফে খোলাসা করেই বলা হয়- ৭১’র বর্বর গণহত্যার জন্য পাকিস্তানকে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইতে হবে। অভিন্ন পাকিস্তানের সম্পদ বিভাজন, ৭০-এর ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ের ত্রাণ তহবিল হস্তান্তর এবং আটকে পড়া পাকিস্তানি নাগরিকদের প্রত্যাবাসনসহ ঐতিহাসিক ইস্যুগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে। এটা পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ককে টেকসই, বাস্তবভিত্তিক ও ভবিষ্যৎমুখী করবে। অন্যথায় পদে পদে তা বাধাগ্রস্ত হবে। যেমনটা অতীতে হয়েছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং তার সফরসঙ্গীরা নিজেদের ডিফেন্ড করার চেষ্টা করেন। তাদের তরফে ‘গণহত্যা’ শব্দটির উল্লেখ না করা হলেও যুদ্ধকালীন নানা দুঃখজনক ঘটনায় পাকিস্তানের পক্ষ থেকে খোলাখুলিভাবে অতীতে দু’বার দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়।

পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের বয়ান এখানেই থেমে যায়। তারা অভিন্ন পাকিস্তানের সম্পদ বিভাজন, ৭০-এর ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ের ত্রাণ তহবিল হস্তান্তর এবং আটকে পড়া পাকিস্তানি নাগরিকদের প্রত্যাবাসন বিষয়ে বাংলাদেশের চাওয়ার বিষয়ে একটি কথাও বলেননি বলে নিশ্চিত হয়েছে মানবজমিন। আলোচনা হঠাৎ থেমে যাওয়া প্রসঙ্গে বৈঠকে অংশ নেয়া সরকারি এক কর্মকর্তা গতকাল মানবজমিনকে বলেন- একাত্তরের অমীমাংসিত ইস্যু সমাধান হয়ে গেছে, পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সেই দাবি ধোপে টিকেনি। বাংলাদেশ সরকারের তরফে দলিল দিয়ে তা নাকচ করা হয়। সে কারণেই দুই দেশের অমীমাংসিত ইস্যু নিয়ে আগামী দিনে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে সম্মত হয়েছেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। 

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনায় পরবর্তী সরকার ও নির্বাচন নিয়ে কথা হয়
সূত্র মতে, রোববার বিকালে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিনেটর ইসহাক দার। আগের দিনে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয় তার। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতে বাংলাদেশের রাজনীতি, আগামী নির্বাচন এবং পরবর্তী সরকার নিয়ে কথা হয়। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রধান উপদেষ্টাকে বলেন, গভর্মেন্ট অব দ্য ডে অর্থাৎ যখন যে সরকার থাকবে তার সঙ্গেই কাজ করতে চায় পাকিস্তান। অতীতেও তাদের এমন মনোভাব ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতেও তা থাকবে আশা করেন তিনি।

আসছেন পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী, যাবেন বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা সচিব

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের সফরের পর এবার পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। এদিকে গত মাসে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফরের ফিরতি সফর হিসেবে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা জননিরাপত্তা সচিব ইসলামাবাদ সফর করতে পারেন বলে আভাস মিলেছে। সেগুনবাগিচা জানিয়েছে- সফর বিনিময়ের বিষয়টি আলোচনার টেবিলে রয়েছে কিন্তু কোনটাই এখনো চূড়ান্ত নয়। 

চীনের মধ্যস্থতা এবং…

পাকিস্তানের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক হচ্ছে। সিরিজ সফর করছেন দেশটির মন্ত্রী-সচিব। এটা তৃতীয় দেশ, বিশেষ করে চীনের ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগের কারণে কি না? আরও স্পষ্ট করে বললে- চীনের মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ-পাকিস্তান ‘ভঙ্গুর’ সম্পর্ক জোড়া লাগছে কি? এমন প্রশ্ন ছিল পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের সঙ্গে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের বৈঠক পরবর্তী ব্রিফিংয়ে। জবাবে একবাক্যে তা নাকচ করেন উপদেষ্টা মিস্টার হোসেন। চীনের ওই উদ্যোগ তিন দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে পরিসর বাড়ানোর প্রস্তাব বাংলাদেশের দিক থেকে করা হয়েছে জানিয়ে  উপদেষ্টা বলেন, এটা আগেও বলেছি, এখনো বলছি। আমাদের দুই দেশের সম্পর্ক বিষয়ে চীনের উৎসাহ আছে। পাকিস্তানেরও তো আছেই। তবে চীনের ত্রিদেশীয় উদ্যোগে তাদের দুই দেশের চাওয়া আর আমাদের চাওয়ার মধ্যে ভিন্নতা আছে। আমরা চাই এখানে চতুর্থ, পঞ্চম দেশও আসুক। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক গত সরকারের আমলে, ইচ্ছাকৃতভাবে পিছিয়ে রাখা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে আরও ৮-১০টা দেশের মতোই স্বাভাবিক সম্পর্ক চাই। এর চেয়ে বেশি কিছু নয়।