Image description

জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে রাজধানীর জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়া ৪৯৩ জন এক চোখের এবং ১১ জন দুই চোখের দৃষ্টি চিরতরে হারিয়েছেন। এ ছাড়া, ২৮ জন গুরুতর আহত জুলাইযোদ্ধা দুই চোখের দৃষ্টি স্বল্পতায় ভুগছেন। আর ৪৭ জন একচোখে দৃষ্টি স্বল্পতায় ভুগছেন বলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির রেটিনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক যাকিয়া সুলতানা। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ ২১তম সাক্ষী হিসেবে দেয়া জবানবন্দিতে এ তথ্য জানিয়েছেন তিনি।  

গতকাল গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত হত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ তিনজনের বিরুদ্ধে অষ্টম দিনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। এদিন সকালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে এ সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। মোট ৫ জন সাক্ষীর জবানবন্দি নেয়া হয়েছে। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে সাক্ষীদের জেরা করেন, পলাতক আসামি শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন।

এদিকে, জুলাই আন্দোলনের সময় ফার্মগেটে শহীদ নাফিজসহ তিনজনকে হত্যা মামলায় শচীন মল্লিক নামে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাকে ২৮শে আগস্ট ট্রাইব্যুনালে হাজির করার নির্দেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। 

ডিএমপি’র সাবেক কমিশনার হাবিবসহ চারজনকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ: আন্দোলন চলাকালে রামপুরায় ছাদের কার্নিশে ঝুলে থাকা যুবককে গুলির ঘটনায় ডিএমপি’র সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ চার পুলিশ সদস্যকে হাজির হতে দু’টি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। গতকাল পরোয়ানা ফেরতের প্রতিবেদন দাখিলের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ আদেশ দেন। এই মামলায় তিনটি অভিযোগ আনা হয়েছে। সেগুলো হলো- গত বছরের ১৯শে জুলাই রাজধানীর রামপুরায় কার্নিশে ঝুলে থাকা যুবক আমির হোসেনকে গুলি, গুলি বাসিত খান মুসার (৭) মাথা ভেদ করে চলে যায়। এতে তার দাদি মায়া ইসলাম মারা যান। একইদিন রামপুরায় মো. নাদিম নামের আরও এক ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়।

এই মামলায় মোট পাঁচজন আসামি। তাদের মধ্যে চারজন পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আবেদন করলে ট্রাইব্যুনাল তা মঞ্জুর করে। মামলায় একমাত্র গ্রেপ্তার আসামি রামপুরা পুলিশ ফাঁড়ির সাবেক এএসআই চঞ্চল চন্দ্র সরকারকে গতকাল ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। এ মামলার পরবর্তী তারিখ আগামী ১লা সেপ্টেম্বর ধার্য করেছে ট্রাইব্যুনাল।
সাক্ষীর জবানবন্দি: সাক্ষ্য-১, জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক খায়ের আহমেদ চৌধুরী বলেন, তিনি জুলাই আন্দোলনের ছয়জন গুলিবিদ্ধ আহতকে চিকিৎসা দিয়েছেন। তিনি আহতদের শরীর থেকে ছয়টি বুলেট উদ্ধার করেছেন, যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তার কাছ থেকে জব্দ করেছেন।

সাক্ষ্য-২, জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক যাকিয়া সুলতানা বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ১৭ই জুলাই পিলেটবিদ্ধ পাঁচজন রোগী এসেছিল। ১৮ই জুলাই দিনটি ছিল রক্তস্নাত দিন। ওইদিন দুপুরের দিকে প্রায় ১০০ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়। আরও আনুমানিক ১০০ রোগীকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়। আহতদের বয়স ১৪-২৫ এর মধ্যে ছিল। তাদের কেউ কেউ এক হাত দিয়ে এক চোখ, দুই হাত দিয়ে দুই চোখ ধরে ছিল। এদিন রাত ৯টায় আমরা ১০টা টেবিলে অপারেশন করতে থাকি।
তিনি বলেন, গত বছরের ৪, ৫ ও ৬ই আগস্ট আমরা অসংখ্য রোগী গ্রহণ করি; যাদের চোখে অপারেশন করা হয়। এসব রোগীরা ভীত সন্ত্রস্ত ছিল। নিরাপত্তার কারণে অনেক রোগী তাদের নাম-ঠিকানা গোপন করে ছদ্মনাম দিয়েছে। মোবাইল নম্বর ভুল দিয়েছে, তাদের পরিচয় ভুল দিয়েছে বলে জানান তিনি। 

সাক্ষ্য-৩, জুলাই আন্দোলনে শহীদ মারুফ হোসেনের বাবা ফুচকা ও চটপটি বিক্রেতা মো. ইদ্রিস বলেন, আমার ছেলে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়তো। সময় পেলেই গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে আমাকে সহযোগিতা করতো। ১৯শে জুলাই আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয় মারুফ। সে সময় সঙ্গে তার মামা ফয়সাল ছিল। মো. ইদ্রিসকে ফোন করে ফয়সাল জানায়, রামপুরা ব্রিজের ওপর থেকে পুলিশ, বিজিবি ও ছাত্রলীগ আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি করছে। সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে ফোন করে বলে মারুফ গুলিবিদ্ধ হয়েছে বাড্ডা ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে। তখন তাকে এএমজেড হাসপাতালে নিয়ে যায়। 
তিনি বলেন, মারুফের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় ঢাকা মেডিকেলে নিতে বলে সেখানকার ডাক্তাররা। পথে রামপুরা ব্রিজের ওপর আওয়ামী লীগ, পুলিশ, বিজিবি মিলে আমার ছেলেকে বহনকারী এম্বুলেন্সটি আটকায়। তখন মারুফের শরীরে অক্সিজেন লাগানো ছিল, সে বেঁচে ছিল। ১৫-২০ মিনিট ধরে রেখে পুলিশ জানায়- সে মারা গেছে, তাকে হাসপাতালে নেয়ার দরকার নেই। আমার ছেলের গুলিবিদ্ধ স্থানটি তখন গামছা দিয়ে পেঁচানো ছিল। পুলিশ রাইফেলের বাঁট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দেখে। তখন আমাদের ছেলে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎক মৃত ঘোষণা করেন। 

ইদ্রিস আরও বলেন, ছেলের লাশ নিয়ে যেতে চাইলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পোস্টমর্টেম ছাড়া দিতে চায়নি। দু’দিন পর ২১শে জুলাই পোস্টমর্টেম করে আমার ছেলের লাশ হস্তান্তর করে। পুলিশি বাধার কারণে ছেলের লাশের পোস্টমর্টেম করতে দেরি হয়েছে। বাড্ডা থানার ওসি তার এলাকায় এমন ঘটনা ঘটেনি বলে অস্বীকার করেন। পূর্ব বাড্ডার কবরস্থানে ছেলের লাশ দাফন করা হয়।

তিনি ছেলের হত্যাকাণ্ডের জন্য নির্দেশদাতা হিসেবে শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান কামাল, চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, স্থানীয় এমপি ওয়াকিল উদ্দিন এবং মাঠে থাকা কাউন্সিলর তাপস ও জাহাঙ্গীর আলম ও বাড্ডা থানার ওসি ও রামপুরা থানার ওসি এবং বিজিবি’র রেদোয়ানের বিচার চান।
সাক্ষ্য-৪, লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী আমেনা আক্তার জবানবন্দিতে বলেন, ‘গত বছর ৪ঠা আগস্ট আন্দোলন চলাকালে মাদাম ব্রিজ এলাকা থেকে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের ১২০-১৩০ জন সশস্ত্র অবস্থায় তাদের ওপর হামলা করে। তারা গুলি করতে করতে তাদের দিকে এগিয়ে আসে। তখন ছাত্রলীগের লোকজনের গুলিতে একজন ছাত্র গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যান। পরে জেনেছি তার নাম সাদ আল আফনান। আফনান ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন।

তিনি বলেন, একপর্যায়ে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা আমাকে ধাওয়া করে ধরে ফেলে মারপিট করতে থাকে। অজ্ঞাতনামা দু’জন আন্দোলনকারী আমাকে উদ্ধার করে লক্ষ্মীপুর আধুনিক হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমি সেখানে দুইদিন চিকিৎসাধীন ছিলাম। পরে আমি বাড়ি গিয়ে শুনেছি ৪ঠা আগস্ট আরও ৪ থেকে ৫ জন শহীদ হয়েছে। ২০০’র বেশি আহত হয়েছে।
সাক্ষ্য-৫, কুমিল্লার দেবিদ্বারে আওয়ামী লীগের গুলিতে শহীদ হওয়া বাসচালক আবদুর রাজ্জাকের মা ৫৫ বছর বয়সী হোসনে আরা বেগম তার জবানবন্দিতে বলেন, গত বছর ৪ঠা আগস্ট আমার ছেলে আন্দোলনে যায়। বেলা দেড়টার দিকে আমরা খবর পাই আমার ছেলে আহত হয়েছে দেবিদ্বার থানার বানিয়াপাড়া আজগর আলী স্কুলের কাছে। গিয়ে দেখি দুইজন মহিলা কাঁদছে। রাস্তার ওপর অনেক রক্ত পড়ে ছিল। পরে আমি সেখান থেকে দেবিদ্বার উপজেলা হাসপাতালে গিয়ে আমার ছেলের বউ ও আমার মেয়েকে দেখতে পাই। আমি রাজ্জাককে এক নজর দেখি। তখন উপস্থিত লোকজন বলে আমার ছেলে মারা গেছে। আমি তখন অজ্ঞান হয়ে যাই। 

তিনি বলেন, রাত ৯টার দিকে নয়ন দারোগা ফোন দিয়ে থানায় ডেকে নিয়ে পোস্টমর্টেম করতে হবে বলে একটি কাগজে স্বাক্ষর নেয়। সেখানে আওয়ামী লীগের নেতা মোস্তাফিজুর রহমান সরকার আমাকে বলে নগদ সাত লাখ টাকা দিয়ে দিচ্ছি, দুইটা দোকান দিচ্ছি, ছেলের বউ নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবেন। মামলা করার দরকার নেই। আমি টাকা নেই নাই। পরদিন জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে আমার ছেলের লাশ দাফন করি।
তিনি বলেন, রাজ্জাক যখন আন্দোলনে যায়, তখন তার বউ আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিল। তার পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে দাদিকে বলে বাবা কখন আসবে। তার বাবাকে এনে দিতে কান্না করতে থাকে। এ সময় রাজ্জকের স্ত্রী ১১ মাস বয়সী ছেলেকে দেখিয়ে ট্রাইব্যুনালে বলেন, এটিই শহীদ আবদুর রাজ্জাকের ছেলে। এ সময় শহীদ রাজ্জাকের মা কান্নায় ভেঙে পড়েন।