
প্রশাসন ক্যাডারের পর এবার অন্যান্য ক্যাডারে বঞ্চিত ৭৮ অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ করেছে এ–সংক্রান্ত পর্যালোচনা কমিটি। যাদের পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে, তাদের মধ্যে গ্রেড-১ পদে ১২ জন, গ্রেড-২ পদে ৩২ জন এবং গ্রেড-৩ পদে ৩৪ জন কর্মকর্তা আছেন। এসব কর্মকর্তা ইতিমধ্যে অবসরে গেছেন। আগের কোনো তারিখ থেকে কোনো বিষয় কার্যকর করা হলে তাকে ‘ভূতাপেক্ষ’ বলা হয়। তবে বঞ্চিত ১৩২ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতির সুপারিশ করেনি কমিটি। এদিকে ফ্যাসিবাদ ও দোসর মুক্ত প্রশাসন গড়তে হলে প্রশাসনে কর্মরত ইন-সার্ভিস এবং আউট সার্ভিস বঞ্চিত ও বৈষম্যের শিকার কর্মকর্তাদের বিভিন্ন পদে পদোন্নতির পাশাপাশি পদায়ন জরুরী বলে মনে করছেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, জুলাই গন অভ্যুত্থানের পর সচিবালয়সহ মাঠ প্রশাসনের অনেক শীর্ষ পদে পতিত শেখ হাসিনা এবং আওয়ামীলীগের সুবিধাভোগী ও আস্থাভাজন কর্মকর্তারা এখনও বহাল তবিয়্যতে রয়েছে। এর ফলে অন্তবর্তী সরকারের অনেক পলিসি ও নীতি বাস্তবায়নে মারাত্মক শ্লথ গতি পরিলক্ষিত হচ্ছে।
গত এক বছরে অন্তত নয় জন সচিব ও ১৯ জন অতিরিক্ত সচিবকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে এবং আরও ৮৭ জনকে ওএসডি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকে দুর্নীতিগ্রস্ত ও ক্ষমতার অপব্যবহারকারী হিসেবে পরিচিত। তবে দীর্ঘ ধারাবাহিকতায় গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা এসব কর্মকর্তাদের হঠাৎ সরিয়ে দেওয়ায় প্রশাসনের ধারাবাহিকতায় বাধা সৃষ্টি করেছে। প্রশাসনে পদোন্নতি বঞ্চিত অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের আবেদন পর্যালোচনা কমিটির দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দিয়েছেন পদোন্নতি বঞ্চিত অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণের আবেদন পর্যালোচনা কমিটি। তবে বঞ্চিত ১৩২ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতির সুপারিশ করেনি কমিটি। আবার প্রশাসন থেকে আওয়ামীলীগের সুবিধাভোগী ও আস্থাভাজন কর্মকর্তারা এখনও বহাল তবিয়্যতে তাদের বিষয়ে কোনো সুপারিশ করা হয়নি। এ নিয়ে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করছে। ইন-আউট সার্ভিসের কর্মকর্তারা প্রশাসনে নিয়োগ আসছে। গতকাল বুধবার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে পর্যালোচনা প্রতিবেদন জমা দেন পদোন্নতি ‘বঞ্চিত’ অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের আবেদন পর্যালোচনা কমিটির আহ্বায়ক ও সাবেক অর্থসচিব জাকির আহমেদ খান। এটি কমিটির দ্বিতীয় প্রতিবেদন। এই কমিটির প্রথম প্রতিবেদনের সুপরিশের আলোকে প্রশাসনের উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত ৭৬৪ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ইতিমধ্যে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।
এ প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন পদোন্নতি বঞ্চিত অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের আবেদন পর্যালোচনা কমিটির আহ্বায়ক ও সাবেক অর্থ সচিব জাকির আহমেদ খান। এতে ৭৮ অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে এ তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আওতায় ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট পর্যন্ত সময়কালে চাকরিতে বঞ্চনার শিকার এবং এ সময়ের মধ্যে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের আবেদন পর্যালোচনা করে সুপারিশ দিতে গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর জাকির আহমেদ খানকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি দুই ধাপে তার কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে। প্রথম ধাপে উপসচিব থেকে তদূর্ধ্ব পদে বঞ্চনার আবেদনগুলোর পর্যালোচনা করে গত বছরের ১০ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন দিয়েছিল। এরপর দ্বিতীয় ধাপে প্রশাসন ক্যাডার ছাড়া অন্যান্য যেসব ক্যাডারে তৃতীয় গ্রেড বা তদূর্ধ্ব পদ রয়েছে, সেসব ক্যাডারের বঞ্চিত কর্মকর্তাদের কাছ থেকে আবেদন আহ্বান করা হয়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ৩১৮টি আবেদন জমা হয়। এর মধ্যে ৬৮টি আবেদন কমিটির আওতাবহির্ভূত ছিল। আর ৪০টি আবেদন তথ্যগতভাবে অসম্পূর্ণ ছিল। পরে কমিটি ২১০টি আবেদন পর্যালোচনা করে। পর্যালোচনায় কমিটি ৭৮ জন কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দেওয়া যেতে পারে বলে সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে ৬ জন কর্মকর্তাকে তিন ধাপ, ১৭ জন কর্মকর্তাকে দুই ধাপ এবং ৫৫ জন কর্মকর্তাকে এক ধাপ পদোন্নতির সুপারিশ করেছে। ১৩২ জন কর্মকর্তাকে কমিটি পদোন্নতির সুপারিশ করেনি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আওতায় ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট পর্যন্ত সময়কালে চাকরিতে বঞ্চনার শিকার এবং উল্লিখিত সময়কালের মধ্যে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের আবেদন পর্যালোচনাপূর্বক সুপারিশ প্রণয়নের জন্য গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর জাকির আহমেদ খানকে আহ্বায়ক করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ এবং আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের প্রতিনিধির সমন্বয়ে ৫ সদস্যবিশিষ্ট গঠিত কমিটি দুই ধাপে তার কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে। কমিটি প্রথম ধাপে উপ-সচিব ও তদূর্ধ্ব পদে বঞ্চনার আবেদনগুলো পর্যালোচনাপূর্বক গত ১০ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন দাখিল করে। দ্বিতীয় ধাপে প্রশাসন ক্যাডার ছাড়া অন্যান্য যেসব ক্যাডারে তৃতীয় গ্রেড বা তদূর্ধ্ব পদ রয়েছে সেসব ক্যাডারের বঞ্চিত কর্মকর্তাদের কাছ থেকে আবেদন আহ্বান করা হয়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ৩১৮টি আবেদন জমা পড়ে।
তন্মধ্যে ৬৮টি আবেদন কমিটির আওতাবহির্ভূত এবং ৪০টি আবেদন তথ্যগতভাবে অসম্পূর্ণ হওয়ায় মোট ১০৮টি আবেদন বিবেচনা করা সম্ভব হয়নি। ফলে কমিটি পর্যালোচনাযোগ্য আবেদন ছিল ২১০টি। এসব আবেদন যাচাই-বাছাই করার জন্য কমিটি ১৪টি সভা করেছে। প্রত্যেক ক্যাডারের আবেদন বিবেচনার সময় কমিটির সভায় সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের লিখিত সুপারিশ, বৈঠকে উপস্থিত প্রতিনিধির মতামত এবং আনুষঙ্গিক বিষয়াদি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়েছে। পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে কমিটি সুপারিশ প্রণয়ন করেছে। পদোন্নতির জন্য সুপারিশকৃত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, কমিটি ৬ জন কর্মকর্তাকে ৩ ধাপ, ১৭ জন কর্মকর্তাকে ২ ধাপ এবং ৫৫ জন কর্মকর্তাকে ১ ধাপ পদোন্নতির সুপারিশ করেছে। যাদের পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়নি প্রতিটি ক্ষেত্রে তার সুনির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে, পদোন্নতি বঞ্চিত অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণের আবেদন পর্যালোচনা কমিটির দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রতিবেদন-২০২৫ প্রধান উপদেষ্টার কাছে পেশ করা হয়। এ সময় প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব সিরাজ উদ্দিন মিয়া উপস্থিত ছিলেন। গত ১৫ বছরে যেসব আইন-কানুন শিথিল করা হয়েছে, সেগুলো সংশোধন করে আরও কঠোর করার জন্য এখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। যার ফলে সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতিতে জড়ানোর সুযোগ বেড়েছে।
স্বৈরাচারের একচ্ছত্র দোসর ও সহযোগী হিসেবে বিবেচিত গত ২০১৮ ও ২০২৪ সালের অবৈধ নির্বাচনের কারিগর ও আওয়ামীলীগের পক্ষে পলিসি মেকিং থেকে শুরু করে পদোন্নতি-পদায়নের নিয়ন্ত্রক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী কর্মকর্তারা। ৩৬ জুলাই-এর রূপকার ও আন্দোলনের নেপথ্যের নায়ক, নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে অগ্রসরমান,দীর্ঘদিন বঞ্চিত ও বৈষম্যের শিকার প্রশাসন ক্যাডারের ৯ম ব্যাচের অসাধারণ যোগ্য, দক্ষ ও ধীশক্তি সম্পন্ন সিনিয়র কর্মকর্তা মো. শামসুল আলম-কে এখনও তাঁর প্রাপ্য সিনিয়র সচিব পদে পদোন্নতি-পদায়ন করা হয়নি। এছাড়া ৩৬ জুলাই আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালনকারী এ বি এম আব্দুস সাত্তার, আবদুস খালেক, কাজী মেরাজ হোসেন, মো, মসিউর রহমান, মো, ফরিদুল ইসলাম, মঞ্জুর মোর্শেদ চৌধুরী, শেখাবুর রহমান, ইহসানুল হক, আফজালুর রহমান, ইউনুস আলী, জাকির কামাল, ড. আনোয়ার উল্ল্যাহ, মো.শামসুজ্জোহাসহ তিন শতাধিক কর্মকর্তা (যারা অবসরে আছেন) প্রাপ্য সম্মান ও সুযোগ থেকে এখনো বঞ্চিত রয়েছেন। প্রশাসনের বঞ্চিত অতিরিক্ত সচিব শেখাবুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন,ফ্যাসিস্ট হাসিনা মুক্ত প্রশাসন গড়তে হলে ইন সার্ভিস ও আউট সার্ভিস বঞ্চিত ও বৈষম্যের শিকার কর্মকর্তাদের উপযুক্ত পদে পদায়নের প্রয়োজন হবে। সেক্ষেত্রে আউট সার্ভিস (যারা অবসরে গেছেন) কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা শারীরিক-মানসিক সক্ষমতাসহ বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় নিয়োজিত এবং অধিকদতর দক্ষ ও মেধাবী বলে সবার কাছে সুপরিচিত।তাদেরকে জাতির প্রয়োজনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে উপযুক্ত স্থানে পদায়ন করলে দেশ ও জাতির সেবা দিতে সক্ষম হবেন। এদিকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে খুব শিগগিরই দেশের সব জেলায় নতুন জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ দিতে যাচ্ছে সরকার। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যেই নতুন ডিসিদের নিয়োগ চূড়ান্ত করা হবে। এরই মধ্যে নতুন ফিটলিস্ট তৈরির কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ইতোমধ্যে সিলেট জেলায় নতুন জেলা প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।