
চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে আবাসিক প্লট উন্নয়ন প্রকল্পের মাটি ভরাটে দুর্নীতির মাধ্যমে ৪৮ লাখ টাকার বেশি আত্মসাতের অভিযোগে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রামের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী কাওসার মোর্শেদসহ চারজনের বিরুদ্ধে গত ফেব্রুয়ারিতে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। একই সঙ্গে আসামিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশও করে সংস্থাটি। তবে দুর্নীতির মামলায় বিচারের মুখোমুখি না করে উল্টো এই প্রকৌশলীকে ‘পুরস্কৃত’ করা হচ্ছে। এরই মধ্যে তাকেসহ দুর্নীতির মামলার দুই আসামিকে ঢাকার মিরপুরে প্রমোশনাল বদলি করা হয়েছে। এখন কাওসার মোর্শেদকে দেওয়া হচ্ছে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার দুই প্রকল্পের দায়িত্ব।
গৃহায়ন সূত্রে জানা গেছে, জুলাই-গণঅভ্যুত্থানে নিহতদের পরিবারের জন্য ফ্ল্যাট প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব পাচ্ছেন কাওসার মোর্শেদ। একই সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য পুনর্বাসন প্রকল্পের (৫০২টি ফ্ল্যাট নির্মাণ) দায়িত্বও দেওয়া হচ্ছে তাকে। এরই মধ্যে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরি করে বাস্তবায়নের জন্য মন্ত্রণালয় ও জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ একাধিক বৈঠক করেছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নিহতদের পরিবারের জন্য ফ্ল্যাট প্রকল্পটি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য পুনর্বাসন প্রকল্পটি গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় গ্রহণ করছে। এর মধ্যে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নিহতদের পরিবারের জন্য ফ্ল্যাট প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৬১ কোটি টাকা। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পুনর্বাসন প্রকল্পের ব্যয়ও ৫০০ কোটি টাকার বেশি।
জানা গেছে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নিহতদের জন্য ৮০৪টি ফ্ল্যাট নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের উদ্যোক্তা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় হলেও বাস্তবায়ন করবে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। শুরু থেকেই এই প্রকল্পের বিভিন্ন দিকে নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এর মধ্যেই এই প্রকল্পসহ ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার দুই প্রকল্পের দায়িত্ব পেতে যাচ্ছেন আরেক বিতর্কিত কর্মকর্তা জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ মিরপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী কাওসার মোর্শেদ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গণঅভ্যুত্থানে নিহতদের পরিবারের জন্য ৮০৪টি ফ্ল্যাট নির্মাণের যে প্রকল্প সরকার নিয়েছে, তার আওতায় শহীদ পরিবারের সদস্যরা বিনামূল্যে ফ্ল্যাট পাবেন। তবে যেখানে এই প্রকল্পের ভবন তৈরি করা হবে, সেখানে ১৮টি পুরোনো ভবনে ৫৭৫ জন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকেন। তাদের উচ্ছেদ করে গণঅভ্যুত্থানে নিহতদের পরিবারের জন্য ফ্ল্যাট প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। এর জন্য সেখানে মাটি পরীক্ষা করতে গেলে সেখানে থাকা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বাধা দিলে নির্বাহী প্রকৌশলী মোর্শেদ বিভিন্ন হুমকি-ধমকি দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। একইভাবে উচ্ছেদকৃত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে যারা বৈধভাবে ফ্ল্যাটে বসবাস করছেন, তাদের জন্য আলাদা করে (৫০২টি ফ্ল্যাট নির্মাণ) প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে মিরপুরে; কিন্তু বরাদ্দ পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাবি, তাদের পুনর্বাসন না করে দেওয়া পর্যন্ত তারা বর্তমান আবাসস্থল ছাড়বেন না।
কাগজপত্র ঘেটে দেখা গেছে, মীরসরাইয়ে আবাসিক প্লট উন্নয়ন প্রকল্পের মাটি ভরাটে দুর্নীতির মাধ্যমে ৪৮ লাখ ৭৭ হাজার ৮৯৪ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের তিন প্রকৌশলীসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২-এর সহকারী পরিচালক ইমরান খান অপু বাদী হয়ে নিজ কার্যালয়ে মামলাটি করেন। মামলার আসামিরা হলেন জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রামের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী কাওসার মোর্শেদ, চট্টগ্রাম উপ-বিভাগের সাবেক প্রকৌশলী মো. অলিউল ইসলাম, উপসহকারী প্রকৌশলী আশ্রাফুজ্জামান এবং মেসার্স হক কনস্ট্রাকশন প্রপার্টি ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড মের্সাস ইউটি মংয়ের (জেভি) পার্টনার ইনচার্জ মাঈনুল কবির। মামলার এজাহারে বলা হয়, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রামের অধীনে মীরসরাই উপজেলার কিসমত জাফরাবাদে সাইট অ্যান্ড সার্ভিসেস আবাসিক প্লট উন্নয়ন প্রকল্পের মাটি ভরাট কাজে আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে প্রতারণার মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহার করে সরকারি ৪৮ লাখ ৭৭ হাজার ৮৯৪ টাকা আত্মসাৎ করেন, যা দণ্ডবিধির ৪০৯/৪২০/১০৯ ধারা এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
এ বিষয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ও জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ফেরদৌসী বেগম কালবেলাকে বলেন, নির্বাহী প্রকৌশলী কাওসার মোর্শেদের নামে দুদকে মামলা আছে। কোনো অনিয়ম দুর্নীতির কারণে যদি কারও নামে দুদকে মামলা থাকে, তার বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার সেটা নেওয়া হবে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে নির্বাহী প্রকৌশলী কাওসার মোর্শেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘দুদক যা করছে, তা যথাযথভাবে করেনি। এ বিষয়ে কিছুই জানি না। এ বিষয় নিয়ে তো আমাদের মন্ত্রণালয় কোনো প্রশ্ন তোলেনি; কিন্তু কার কথা শুনে কীভাবে মামলা দিয়েছে তারাই (দুদক) জানে। তবে এ মামলা যথাযথ না, ভিত্তিহীন মামলা।’
দুই প্রকল্পের কাজের বিষয়ে জানতে তিনি বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানে নিহতদের পরিবারের জন্য ৮০৪টি ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্পের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করছি। ডিপিপি তৈরি করে করা হয়েছে, মাটি পরীক্ষার কাজও চলছে। নিহতদের পরিবারের প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৬১ কোটি টাকার মতো। এ ছাড়া সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পুনর্বাসনের জন্য ৫০২টি ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে।’
উপসহকারী প্রকৌশলী আশ্রাফুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, ‘দুদক যে মামলা দিয়েছে, তা মনগড়া ও ভিত্তিহীন মামলা। এই মামলা যে করা হয়েছে, তার কিছুই জানি না। দুদক স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের লোকজন দিয়ে যাচাই-বাছাই ও তদন্ত করছে। এ মন্ত্রণালয় তো এসব বিষয়ে ভালো করে জানে না।’