
দেশের ব্যাংক খাতের সবচেয়ে বড় সংকটগুলোর একটি হয়ে দাঁড়িয়েছে খেলাপি ঋণ। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত ‘আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন-২০২৪’ থেকে জানা গেছে, দেশের ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের অর্ধেকের বেশি এখন উৎপাদনমুখী শিল্প খাতে আটকে আছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে উৎপাদনমুখী এ খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭১ হাজার ৩০৪ কোটি টাকা, যা সামগ্রিক খেলাপি ঋণের ৪৯ দশমিক ৪৩ শতাংশ। আগের বছরের একই সময় এর পরিমাণ ছিল ৭২ হাজার ৬৪১ কোটি টাকা। অর্থাৎ, এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ৯৮ হাজার ৬৬৩ কোটি টাকা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাত থেকে মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১৭ লাখ ১১ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩ লাখ ৪৬ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ২০ দশমিক ২৫ শতাংশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, উৎপাদনমুখী খাতে এই উচ্চমাত্রার খেলাপি ঋণ দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ। মূলত রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্বল তদারকি ও ঋণ বিতরণের নিয়মনীতি লঙ্ঘনের কারণেই এ খাতগুলোয় খেলাপি ঋণ আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, উৎপাদনমুখী শিল্পের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ বিতরণ করা হয়েছে তৈরি পোশাক (আরএমজি) খাতে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে এ খাতে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৮৮ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ৪৮ হাজার ৬৩৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১৪ দশমিক ০৪ শতাংশ। আগের বছর একই সময়ে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৭০২ কোটি টাকা। ফলে এক বছরে এ খাতের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৫ হাজার ৯৩৬ কোটি টাকা। দেশের প্রধান রপ্তানি খাত হওয়া সত্ত্বেও এই শিল্পে ঋণ ব্যবস্থাপনা ও আর্থিক শৃঙ্খলার অভাব স্পষ্ট।
টেক্সটাইল খাতেও একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। ২০২৪ সালের শেষে এ খাতে ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৪৯ হাজার ১৭১ কোটি টাকা, যার মধ্যে খেলাপি ঋণ ৩৬ হাজার ৫২০ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় ২১ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা বেশি। মোট খেলাপির অনুপাতে এ খাতে খেলাপির হার ১০ দশমিক ৫৪ শতাংশ। বিশ্লেষকরা বলছেন, টেক্সটাইল খাতের অনেক প্রতিষ্ঠান আর্থিক দুর্বলতা এবং বৈদেশিক চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে নিজেদের দায় পরিশোধে অক্ষম হয়ে পড়েছে।
চামড়া শিল্প খাতে ঋণের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম হলেও খেলাপির হার অনেক বেশি। ২০২৪ সালের শেষে এ খাতে মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ৮৯৮ কোটি টাকা, যার মধ্যে খেলাপি ঋণ ৫ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা বা প্রায় ৩৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ। আগের বছর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা, ফলে এ খাতে খেলাপি ঋণ এক বছরে বেড়েছে ২ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা। দেশের ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পটি নানা কারণে সংকটে রয়েছে। রপ্তানি বাজার সংকুচিত হওয়া, কাঁচামালের অভাব এবং নীতিনির্ধারণী দুর্বলতা এর পেছনে প্রধান কারণ।
এ ছাড়া জাহাজ নির্মাণ শিল্পেও খেলাপি ঋণ দ্রুত বেড়েছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে এ খাতে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ২০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা, যার মধ্যে খেলাপি ঋণ ৮ হাজার ৩১ কোটি টাকা। আগের বছর এ পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ, এক বছরে এ খাতের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা। দেশীয় জাহাজ নির্মাণ শিল্প একসময় সম্ভাবনাময় বলে বিবেচিত হলেও বর্তমানে অর্থনৈতিক চাপ, প্রতিযোগিতামূলক বাজার এবং বৈদেশিক অর্ডারের সংকটের কারণে খাতটি বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে।
কৃষিভিত্তিক শিল্প খাতেও ঋণ বিতরণ বেড়েছে, তবে খেলাপির পরিমাণ তুলনামূলকভাবে নিয়ন্ত্রিত রয়েছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে এ খাতে ঋণের পরিমাণ ছিল ৬৬ হাজার ৯৫৮ কোটি টাকা, এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ৭ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা। এ ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য খাতে মোট বিতরণকৃত ঋণ ছিল ৩ লাখ ২৩ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকা, যার মধ্যে খেলাপি ঋণ ৮৮ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকা, অর্থাৎ ২৫ দশমিক ৫১ শতাংশ।
ব্যাংক কর্মকর্তাদের মতে, অনেক ক্ষেত্রেই ঋণ বিতরণে যথাযথ যাচাই-বাছাই করা হয় না। ঘুরেফিরে বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকেই ঋণ দেওয়া হয়, যাদের অনেকেই রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। এ কারণে তারা ঋণ নিলেও ফেরত দেয় না। অনেক প্রতিষ্ঠান আবার নামে-বেনামে অর্থ তুলে বিদেশে পাচার করে, যা আর ফিরে আসে না। এর ফলে ব্যাংকের মূলধন ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে এবং সাধারণ আমানতকারীর অর্থ সুরক্ষিত থাকছে না।
বিশ্লেষকদের মতে, খেলাপি ঋণের বর্তমান চিত্র শুধু ব্যাংক খাতের নয়, বরং সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য এক বড় হুমকি। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর নীতিমালা, শক্তিশালী তদারকি এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। না হলে দেশের ব্যাংক খাত এক গভীর অনিশ্চয়তার দিকে এগিয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।