
সিলেটের পাথরকাণ্ডে একের পর এক বেরিয়ে আসছে থলের বিড়াল। এই লুটপাটে রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি সঙ্গ দিয়েছেন স্থানীয় প্রশাসনের প্রায় সব স্তরের কর্মকর্তারা। বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক (ডিসি), সহকারী কমিশনার (ভূমি), পুলিশ সুপার (এসপি), থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এবং কোম্পানীগঞ্জে দায়িত্বপ্রাপ্ত চারজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) সরাসরি মদদ ছিল পাথর লুটপাটে। এ ছাড়া টাকার ভাগ পেয়েছেন জেলা গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) ও পুলিশের বিশেষ ইউনিট পুলিশ ইন্টার্নাল ওভারসাইটের (পিআইও) দুজন কর্মকর্তা। পুলিশকে ট্রাকপ্রতি ১০ হাজার টাকা দেওয়া হতো তিনটি শর্তে। স্থানীয় বিজিবির সংশ্লিষ্টতার তথ্য মিলেছে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে। সব মিলিয়ে ৪ কোটি ঘনফুট পাথর লুটপাটে প্রায় ৮০ কোটি টাকা কমিশন ঢুকেছে স্থানীয় প্রশাসনের পকেটেই। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) ৩১ নেতাকর্মীসহ ৪২ জন সরাসরি জড়িত ছিলেন পাথর লুটে। কালবেলার নিজস্ব অনুসন্ধান, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) রাষ্ট্রীয় বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে উঠে এসেছে এসব তথ্য।
স্থানীয় পরিবেশবাদীদের মতে, সিলেট থেকে অন্তত ৪ কোটি ঘনফুট পাথর লুট হয়েছে। প্রতি ট্রাকে ৫০০ ঘনফুট করে হলে ৪ কোটি ঘনফুট পাথর লুটতে প্রয়োজন হয়েছে অন্তত ৮০ হাজার ট্রাক। দুদকের গোয়েন্দা প্রতিবেদন বলছে, প্রতি ট্রাকে ১০ হাজার টাকা করে কমিশন পেলে ডিসি-এসপিসহ স্থানীয় প্রশাসনের পকেটে ঢুকেছে অন্তত ৮০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী সিলেটের ভোলাগঞ্জে ১৫ একর জায়গাজুড়ে সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্র। এখানে মূল আকর্ষণ সাদাপাথরে ভরা স্বচ্ছ নীল পানি এবং পাথুরে নদী খাত। খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত এ অঞ্চলটি ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্তঘেঁষা, যা পাহাড়ি ঢল এবং ঝরনাধারা দিয়ে বয়ে আসা স্বচ্ছ পানির জন্য পরিচিত। ‘সাদাপাথর’ নামটিও এসেছে এখানকার নদী খাত ও নদীর পাড়জুড়ে ছড়িয়ে থাকা প্রাকৃতিক সাদাপাথরের কারণে। পানি এতটাই স্বচ্ছ যে, পাথরগুলো পানির নিচেও পরিষ্কার দেখা যায়। এ ছাড়া এখানে পাহাড় আর নদীর মিলনস্থল। যে কারণে এটি পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে। কিন্তু গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর থেকে সংঘবদ্ধ লুটপাটে এ সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্র রূপ নিয়েছে বালুচরে। সাদাপাথর, জাফলং, বিছনাকান্দি ও উৎমাছড়া পর্যটনকেন্দ্র থেকে ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে প্রায় ৪ কোটি ঘনফুট পাথর লুট করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে শুরু থেকেই সংবাদ প্রকাশ করে আসছে কালবেলাসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম। তাতে কর্ণপাত করেনি সিলেটের প্রশাসন। তবে লুটপাট শেষে সরব হয় তারা। শুরু হয় লোক দেখানো অভিযান। কিন্তু অভিযানে এখন পর্যন্ত লুট হওয়া ২ শতাংশ পাথরও উদ্ধার করতে পারেনি প্রশাসন।
দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্থানীয় প্রশাসন এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ইন্ধন ও সরাসরি সম্পৃক্ততায় রাষ্ট্রীয় সম্পদ কয়েকশ কোটি টাকা মূল্যের পাথর উত্তোলন করে তা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। নদী ও পর্যটন এলাকা থেকে পাথর চুরি করে প্রথমে স্থানীয় স্টোন ক্রাশার কারখানাগুলোয় জমা করা হয়। পরে এসব পাথর ভেঙে ছোট ছোট টুকরা করা হয়। যাতে চুরি করা পাথরের অস্তিত্ব না পাওয়া যায়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, লুট করা পাথর প্রতি ট্রাকে ৫০০ ঘনফুট করে সরিয়ে নেওয়া হতো। প্রতি ঘনফুট ১৮২ টাকা করে হিসাব করা হতো। সে হিসাবে ট্রাকপ্রতি পাথরের দাম পড়ে ৯১ হাজার টাকা। এখান থেকে ট্রাকপ্রতি ১০ হাজার টাকা যেত জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন এবং জেলা এসপি, সংশ্লিষ্ট থানার ওসি, থানা পুলিশ ও ডিবির পকেটে। এ ছাড়া নৌকাপ্রতি উত্তোলন করা হতো ১ হাজার টাকা। জেলা প্রশাসন ও থানা পুলিশের মধ্যে ৫ হাজার টাকা করে ভাগ হতো। এ ছাড়া নৌকাপ্রতি ৫০০ টাকা করে পেতেন তারা। আরও ভাগ পেতেন ইউএনও, এসিল্যান্ড ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের তহশিলদার। পুলিশের অংশের ভাগ পেতেন এসপি, সার্কেল এসপি, ওসি এবং কোম্পানীগঞ্জ থানার অন্যান্য পুলিশ কর্মকর্তা ও জেলা ডিবি কর্মকর্তারা। টাকা যেত বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট পিআইওতে। এ সংস্থাটিকে বলা হয় ‘পুলিশের চোখ ও কান’। সংস্থাটির কাজ হলো—পুলিশ সদস্যদের কার্যক্রম নজরদারি, দুর্নীতি ও অদক্ষতার তথ্য সংগ্রহ ও তদন্ত। এর মাধ্যমে, অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও বিশ্বস্ততা নিশ্চিত করা হয় এবং পুলিশ বাহিনীর অভ্যন্তরীণ দুর্নীতিমুক্তকরণে সহায়তা করা হয়। তবে নিজেদের ভাগ ছাড়েননি এ সংস্থারও দুই সদস্য। তারা হলেন উপপরিদর্শক (এসআই) রানাকান্ত ও কনস্টেবল দেলোয়ার।
রাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি সংস্থা পাথর লুটপাটে জড়িতদের চিহ্নিত করেছে। এ রকম একাধিক প্রতিবেদন এসেছে কালবেলার হাতে। এসব প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাদাপাথর মূলত খনিজ সম্পদ। খনিজ সম্পদ সম্পর্কিত সব দায়দায়িত্ব খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর (বিএমডি) ওপর ন্যস্ত। তবে পাথর লুটপাটের ঘটনায় খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। সে হিসেবে সংস্থাটির দায়িত্বশীলরা পাথর লুটের অপরাধে দায়ী। এ ছাড়া বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবী পাথর উত্তোলন বন্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেননি। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষার পরিবর্তে পাথর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী, পরিবহন শ্রমিক ও রাজনৈতিক নেতাদের অবৈধ স্বার্থ রক্ষার অভিযোগ আনা হয়েছে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে।
তদন্তে সিলেটের সাবেক ডিসি মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মিলেছে। তার বিরুদ্ধে সদিচ্ছার অভাব, অবহেলা, ব্যর্থতা ও নিষ্ক্রিয়তার প্রমাণ পেয়েছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। এ ছাড়া তার অধীন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে না পারাও লুটপাটের অন্যতম কারণ।
পাথর লুটপাটে সরাসরি চারজন ইউএনওর দায় মিলেছে অনুসন্ধানে। তাদের মধ্যে আছেন কোম্পানীগঞ্জের ইউএনও আজিজুন্নাহার, যিনি দায়িত্ব পালন করেছেন চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি থেকে ১৯ আগস্ট পর্যন্ত। আরও আছেন গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করা ইউএনও মোহাম্মদ আবুল হাসনাত; গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর থেকে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করা ঊমী রায় এবং গত বছরের ১১ জুলাই থেকে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করা আবিদা সুলতানা।
একাধিক তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব ইউএনও তাদের দায়িত্ব পালনকালে নামমাত্র ও লোক দেখানো কিছু ব্যবস্থা ছাড়া পাথর লুট বন্ধে তেমন কার্যকর ব্যবস্থা নেননি।
পুলিশ সুপারের দায়দায়িত্বে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন এবং পরিবহন বন্ধে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দিলেও সিলেটের এসপি মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান সাদাপাথর উত্তোলন বন্ধে তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেননি। এসপির নিষ্ক্রিয়তা ও যোগসাজশের কারণে দুষ্কৃতকারীদের পক্ষে সাদাপাথর লুটপাট করা সম্ভব হয়েছে।
ওসির দায়দায়িত্বে বলা হয়েছে, কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে উজায়ের আল মাহমুদ আদনানসহ সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ অবৈধ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কমিশন নিয়ে পাথর লুটপাটে সহায়তা করেছেন। থানা পুলিশের নির্দিষ্ট সোর্স কখনো নিজেরাই এ চাঁদার টাকা উত্তোলন করতেন। অর্থ উত্তোলন ও সার্বক্ষণিক তদারকির দায়িত্ব পালন করেছেন কোম্পানীগঞ্জ থানার ছয়টি বিটের কর্মকর্তারা। এ ছাড়া এ লুটপাটে কোম্পানীগঞ্জ থানা ও গোয়াইনঘাট থানার প্রায় সব পুলিশ কর্মকর্তা কমিশন পেয়েছেন। পুলিশ প্রশাসনকে টাকা দেওয়া হতো তিনটি শর্তে। সেগুলো হলো—পাথরের ট্রাক না আটকানো, অভিযান না চালানো এবং অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনে বাধা প্রদান না করা।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে সাদাপাথর উত্তোলনে বিজিবি সদস্যদেরও জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিজিবি সদস্যরা নৌকাপ্রতি ৫০০ টাকা করে উত্তোলন করতেন। জানতে চাইলে ৪৮ বিজিবি সিলেট ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল নাজমুল হক কালবেলাকে বলেন, ‘আমি আমার সৈনিকদের বিষয়ে কনফিডেন্স। এ রকম কিছু ঘটেনি। যদি কেউ প্রমাণ দিতে পারে, তাহলে আমি ব্যবস্থা নেব।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিজিবি ৫০০ টাকা করে নিচ্ছে—এমন একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল। সেটির বিষয়ে আমরা প্রতিবাদ দিয়েছি।’ ভিডিওর বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘আমরা টাস্কফোর্সের বাইরে অভিযান চালিয়ে শত শত বারকি নৌকা আটক করেছি। মাস দুয়েক আগে আমরা দুটি বারকি নৌকা আটক করি। তখন এখানকার নামধারী কয়েকজন সাংবাদিক ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা নৌকা ছেড়ে দিতে তদবির করেন। না ছাড়ায় তারাই কিছুক্ষণ পর এসে একটা ভিডিও বানিয়ে সেটা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেন।’
পাথর উত্তোলনে বিএনপি, আওয়ামী লীগ, এনসিপি ও জামায়াতে ইসলামীর অন্তত ৩১ জনের সরাসরি সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মিলেছে একাধিক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে। বিএনপির জড়িত ব্যক্তিরা হলেন সিলেট মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী, সাধারণ সম্পাদক ইমদাদ হোসেন চৌধুরী, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাহাব উদ্দিন, সদস্য হাজি কামাল (পাথর ব্যবসায়ী), কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা শ্রমিক দলের সাবেক সভাপতি ও সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান লাল মিয়া, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন দুদু, সিলেট জেলা যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক রুবেল আহমেদ বাহার, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মুসতাকিন আহমদ ফরহাদ, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির দপ্তর সম্পাদক মো. দুলাল মিয়া দুলা, যুগ্ম আহ্বায়ক রজন মিয়া, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা যুবদল নেতা জসিম উদ্দিন, সাজন মিয়া, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির কর্মী জাকির হোসেন, মোজাফর আলী, মানিক মিয়া, সিলেট জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মকসুদ আহমদ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম ওরফে শাহপরান, কোষাধ্যক্ষ (বহিষ্কৃত) শাহ আলম ওরফে স্বপন, সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল কাশেম এবং পূর্ব জাফলং ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আমজাদ বক্স।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে জড়িতরা হলেন কোম্পানীগঞ্জ আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবদুল ওদুদ আলফু, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের কর্মী বিলাল মিয়া, শাহাবুদ্দিন, গিয়াস উদ্দিন, মনির মিয়া, হাবিল মিয়া ও সাইদুর রহমান।
জামায়াতের জড়িত নেতাকর্মীরা হলেন সিলেট মহানগর জামায়াতের আমির মো. ফকরুল ইসলাম ও সেক্রেটারি জয়নাল আবেদীন। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা জামায়াতের সাবেক আমির আজমান আলী ও জামায়াত নেতা মাস্টার শফিকুরেরও সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। সিলেট জেলা এনসিপির প্রধান সমন্বয়কারী নাজিম উদ্দিন ও মহানগর প্রধান সমন্বয়কারী আবু সাদেক মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম চৌধুরীর সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মিলেছে অনুসন্ধানে। এ ছাড়া স্থানীয় প্রভাবশালী আরও ১১ জনের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মিলেছে বিভিন্ন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে। তার হলেন ভোলাগঞ্জের আনর আলী, উসমান খাঁ, ইকবাল হোসেন আরিফ, দেলোয়ার হোসেন জীবন, আরজান মিয়া, মো. জাকির, আলী আকবর, আলী আব্বাস, মো. জুয়েল, আলমগীর আলম ও মুকাররিম আহমেদ।
জানতে চাইলে দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ‘পাথর লুটকাণ্ডে সিলেটের একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদন প্রধান কার্যালয়ে এসেছে। আগামী সপ্তাহে এটি কমিশনে তোলা হবে এবং অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। পাথর লুটে যারাই জড়িত তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’
দুদক সিলেটের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. নাজমুস সাদাৎ কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা অভিযানের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই প্রাথমিক তথ্য দুদকের সদর দপ্তরে পাঠিয়েছি। প্রাথমিকভাবে যারা জড়িত কিংবা সুবিধা নেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে, তাদের বিস্তারিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। পাথর লুটকাণ্ডের বিষয়টি প্রকাশ্য অনুসন্ধানের জন্য অনুমতি চেয়েছি চিঠিতে। কমিশন থেকে অনুমতি পেলে বিস্তারিত অনুসন্ধান করে জড়িতদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছে জেলা প্রশাসন: সিলেট ব্যুরো জানিয়েছে, সাদাপাথর লুট ও চুরির ঘটনায় ১০টি সুপারিশ প্রস্তুত করে প্রতিবেদন দাখিল করেছে জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটি। গতকাল বুধবার বিকেলে জেলা প্রশাসকের কাছে ৭ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (উন্নয়ন ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা) পদ্মাসন সিংহ।
বিষয়টি কালবেলাকে নিশ্চিত করেছেন বদলির আদেশ পাওয়া জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ। তিনি বলেন, ‘সাদাপাথরের ঘটনায় ১০টি মতামত বা সুপারিশ প্রস্তুত করা হয়েছে। সন্ধ্যার দিকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হবে।’ সিলেটে গতকাল ছিল শের মাহবুব মুরাদের শেষ কর্মদিবস।
জানা যায়, প্রতিবেদনে গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যম থেকে পাওয়া বিভিন্ন ব্যক্তির একটি তালিকা সংযুক্ত করা হয়েছে। তালিকায় ১৩৭ জনের নাম রয়েছে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। তাদের অধিকাংশই রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী। প্রতিবেদনে কারা কীভাবে পাথর লুট করে এবং পরিবেশ বিনষ্ট করে, সে বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি ১০টি সুপারিশ করা হয়েছে।
গত ১০ ও ১১ আগস্ট সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্র এলাকা থেকে পাথর লুটের ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় হয়। অভিযানে নামে যৌথ বাহিনী। লুট হওয়া পাথর উদ্ধার অভিযান শুরু করে তারা। আলোচিত এ ঘটনার পর জেলা প্রশাসন তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে। এতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পদ্মাসন সিংহকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটিতে রাখা হয় কোম্পানীগঞ্জের ইউএনও আজিজুন্নাহার ও সিলেট পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আফজালুল ইসলাম লিংকনকে।
ওই কমিটির গত ১৭ আগস্টের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করার কথা ছিল। পরে আরও তিন দিনের সময় বর্ধিত করা হয়।
‘পাথর চোরদের উৎসাহিত করার মতো কিছুই বলিনি’: পাথর চোরদের উৎসাহিত করে দেওয়া বক্তবের ব্যাখ্যা দিয়েছেন বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবী। গতকাল দুপুরে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে বিভিন্ন দপ্তরে কর্মরত কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা শেষে সাংবাদকিদের তিনি বলেন, ‘গত ৮ জুলাই আমরা ইজারা নিয়ে কথা বলেছি। পাথর চুরি নিয়ে কিছু বলা হয়নি। পাথর চোরদের উৎসাহিত করার মতো কিছুই আমি বলিনি। তেমন কিছু কেউ বললে বা ছড়ালে, সেটা ভুল মেসেজ।’
এদিকে সাদাপাথরে লুটকারীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছেন বিভাগীয় কমিশনার। তিনি বলেন, ‘পাথর লুটকারীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি হচ্ছে। কাজ চলছে অত্যন্ত সতর্ককতার সঙ্গে। যাতে প্রকৃত দোষীদের নাম তালিকায় আসে এবং নির্দোষ মানুষ হয়রানির শিকার না হন। তালিকা তৈরির পর তা প্রকাশ করা হবে।’
খান মো. রেজা-উন-নবী আরও বলেন, সিলেটে চোরাচালান ও খনিজ সম্পদ রক্ষায় জনবল বাড়ানো হচ্ছে। বিজিবির আরও তিনটি ব্যাটালিয়ন স্থাপনের বিষয়ে আলোচনা চলছে। এর মধ্যে একটি ব্যাটালিয়ন স্থাপনের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। পুলিশের জনবলও বাড়ানো হচ্ছে। এখানে একটি পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপনের বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন। এ ছাড়া আরও ক্যাম্প এবং চেকপোস্ট বসানো হবে।