
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ১৯৯০ সালের নির্বাচনে পূর্ণ প্যানেলে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। যে জয় ছিল স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের তৎকালীন প্রেক্ষাপটে ছাত্রসমাজের গর্জনমুখর এক সাফল্য। তিন দশক পর আবারও ভিন্ন এক প্রেক্ষাপট—ছাত্র-জনতার জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে সঙ্গে নিয়ে ডাকসু নির্বাচন। এবারও নব্বইয়ের সেই ইতিহাস নতুন করে লিখতে পূর্ণ প্যানেলে জয়ের স্বপ্ন দেখছেন ছাত্রদল নেতারা। আর সেই জয়ের লক্ষ্যে গতকাল বুধবার ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের জন্য পূর্ণাঙ্গ প্যানেল ঘোষণা করেছে সংগঠনটি। যাতে সহসভাপতি (ভিপি) পদে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবিদুল ইসলাম খানকে। এ ছাড়া জসীমউদ্দীন হল শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক শেখ তানভীর বারী হামিমকে সাধারণ সম্পাদক (জিএস) এবং বিজয় একাত্তর হল শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক তানভীর আল হাদী মায়েদকে করা হয়েছে সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) প্রার্থী।
স্বাধীনতার পর ১৯৯০ সালের ডাকসু নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি, ২৭ হাজার। ভোট গ্রহণ হয় ৬ জুন। স্বৈরাচার হঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রচার চালায় ছাত্রদল। এর আগের নির্বাচনগুলোতে শুধু হল সংসদে আসন পেলেও নব্বইয়ের নির্বাচনে ডাকসুতে পূর্ণ প্যানেলে বিজয়ী হয় জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। সংগঠনটি থেকে ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হন আমান উল্লাহ আমান, আর জিএস হন খায়রুল কবির খোকন। হল ও ডাকসু মিলিয়ে ১৮৮টি পদের মধ্যে ১৫১টিই পায় ছাত্রদল। ছাত্রলীগের শাহে আলম ও কামরুল আহসানের নেতৃত্বাধীন প্যানেল দুটি হল সংসদে পূর্ণ প্যানেলে জয়ী হয়। আর রোকেয়া, শামসুন্নাহার এবং এ এফ রহমান হলে সাতটি পদ পায় ছাত্র ইউনিয়ন।
নব্বইয়ের নির্বাচনে ছাত্রদলের বড় ব্যবধানে জয়ের কারণ হিসেবে ডাকসুর তৎকালীন জিএস খায়রুল কবির বলেন, ‘ওই সময় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ছাত্রদল। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ভোট দেন আমাদের প্যানেলকে।’
এবারের ডাকসু নির্বাচনও একটি গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে হতে যাচ্ছে। যাতে অসামান্য অবদান ছিল ছাত্রদলের। তাই ফের ডাকসুতে নিজেদের সেই নব্বইয়ের সোনালি ইতিহাস ফিরিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর বিএনপির এই সহযোগী ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা।
ঢাবি ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন কালবেলাকে বলেন, ‘নব্বইয়ে স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদলের যেমন ভূমিকা ছিল, ঠিক একইভাবে ফ্যাসিবাদবিরোধী দীর্ঘ লড়াইয়ে এবং চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগকারী ছাত্রসংগঠন ছাত্রদল। আমরা মনে করি, এবার যদি একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয় এবং সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত হয় তাহলে নব্বইয়ের ধারাবাহিকতায় ২৫-এর ডাকসুতেও ছাত্রদল পূর্ণ প্যানেলে বিজয় অর্জন করবে।’
ছাত্রদল আবারও একটি ‘ডাকসুক্ষণ’ পেতে যাচ্ছে উল্লেখ করে ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান কালবেলাকে বলেন, ‘১৯৯০ সালে যে গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল তাতে ছাত্রদলের বড় ভূমিকা ছিল। যেটার ফলাফল ডাকসু নির্বাচনে তারা পেয়েছিল। ঠিক একইভাবে, স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে একটা নিকৃষ্ট ফ্যাসিস্টের বিরুদ্ধে সবচেয়ে দীর্ঘ লড়াই চালিয়ে গিয়েছিল ছাত্রদল। ১৪ তারিখ রাতে (গত বছরের ১৪ জুলাই) ছাত্রদল কোটা সংস্কার আন্দোলনকে স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে রূপদান করেছিল, যাতে অন্যান্য সংগঠন বাধা দিয়েছিল। সুতরাং এই রাষ্ট্রের স্বার্থে, রাষ্ট্রের ক্রুশিয়াল মোমেন্টে (সংকটময় মুহূর্তে), সংকটকালীন মুহুর্তে যারা রাষ্ট্রকে সার্ভ করেছে, সেবা করেছে, রাষ্ট্রের প্রশ্নে আপসহীন ছিল, সেই জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল আবারও একটি ডাকসুক্ষণ পেতে যাচ্ছে। আমি বিশ্বাস করি ৯০-এর পুনরাবৃত্তি ঘটতে যাচ্ছে ২০২৫-এর ডাকসুতে।’
একইভাবে পূর্ণ প্যানেলে জয়ের আশাবাদী জিএস প্রার্থী শেখ তানভীর বারী হামিম। তিনি বলেন, ‘নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর আমরা যেভাবে ডাকসু নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় এনেছিলাম সেভাবে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পর হতে যাওয়া ডাকসু নির্বাচনেও দেশের মানুষকে ভূমিধস বিজয় উপহার দেব ইনশাআল্লাহ।’
ডাকসুতে পূর্ণাঙ্গ প্যানেলে যারা : ঢাবির অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে গতকাল দুপুরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব ডাকসু নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য সংগঠনটির পূর্ণাঙ্গ প্যানেল ঘোষণা করেন। ডাকসুতে ২৮টি পদে নির্বাচন হলেও জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সানজিদা আহমেদ তন্বীর সম্মানে গবেষণা ও প্রকাশনা সম্পাদক পদটি শূন্য রেখে তাকে সমর্থন দিয়েছে ছাত্রদল। তন্বী এই পদে ডাকসুতে নির্বাচন করছেন। জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনাকে ধারণ করে ছাত্রদল এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানান সংগঠনের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব।
ডাকসুর অন্যান্য পদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পাদক পদে আরিফুল ইসলাম, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক পদে এহসানুল ইসলাম, কমন রুম, রিডিং রুম ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক পদে চেমন ফারিয়া ইসলাম মেঘলা, আন্তর্জাতিক সম্পাদক পদে মেহেদী হাসান, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে আবু হায়াত মো. জুলফিকার জিসান, ক্রীড়া সম্পাদক পদে চিম চিম্যা চাকমা, ছাত্র পরিবহন সম্পাদক পদে সাইফ উল্লাহ সাইফ, সমাজসেবা সম্পাদক পদে সৈয়দ ইমাম হাসান অনিক, ক্যারিয়ার উন্নয়ন সম্পাদক পদে আরকানুল ইসলাম রূপক, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সম্পাদক পদে আনোয়ার হোসাইন, মানবাধিকার ও আইন সম্পাদক পদে মেহেদী হাসান মুন্নাকে মনোনয়ন দেয় ছাত্রদল। এ ছাড়া প্যানেলে সদস্যপদে জারিফ রহমান, মাহমুদুল হাসান, নাহিদ হাসান, হাসিবুর রহমান সাকিব, শামীম রানা, ইয়াসিন আরাফাত, মুনইম হাসান অরূপ, রঞ্জন রায়, সোয়াইব ইসলাম ওমি, মেহেরুন্নেসা কেয়া, ইবনু আহমেদ, শামসুল হক আনান ও নিত্যানন্দ পালকে মনোনয়ন দেওয়া হয়।
প্যানেল ঘোষণার পর ছাত্রদলের প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দেন। পরে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ আনাসের কবর জিয়ারত করেন সংগঠনের নেতাকর্মীরা। আর এর মধ্য দিয়ে শুরু হয় ছাত্রদলের নির্বাচনী কার্যক্রম।
প্যানেল ঘোষণার পর রাকিবুল ইসলাম রাকিব বলেন, তারা বিশ্বাস করেন, সাহসী, মেধাবী ও বিচক্ষণ শিক্ষার্থীরা ভোট দিয়ে ছাত্রদলের প্যানেলকে জয়ী করবেন। ছাত্রসমাজের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও দীর্ঘদিন ধরে যারা শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে কাজ করেছেন, তাদেরই প্যানেলে মনোনীত করা হয়েছে।
হল সংসদে ভিপি-জিএস প্রার্থী যারা: হল সংসদ নির্বাচনের জন্য ১৮টি হলে প্যানেল ঘোষণা করেছে ছাত্রদল। গতকাল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদ এ প্যানেল ঘোষণা করে। মাস্টারদা সূর্যসেন হল সংসদে ছাত্রদলের প্যানেলে ভিপি হিসেবে মনোয়ার হোসেন প্রান্ত, জিএস পদে লিয়ন মোল্লা প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। কবি জসীমউদদীন হলে ভিপি পদে মো. আব্দুল ওহেদ, জিএস পদে সিফাত ইবনে আমিন; মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে ভিপি হিসেবে মো. জাহেদুল ইসলাম, জিএস পদে যোবায়ের হোসেন; বিজয় একাত্তর হলে ভিপি পদে মো. সাজ্জাদ হোসেন, জিএস পদে মো. সাকিব বিশ্বাস; শেখ মুজিবুর রহমান হলে ভিপি পদে সাইফ আল ইসলাম দীপ, জিএস পদে রিনভী মোশাররফ; হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে ভিপি পদে আবু জার গিফারী রিফাত, জিএস পদে মহিবুল ইসলাম আকন্দ; সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ভিপি পদে মো. ইমন মিয়া, জিএস পদে তাওহিদুল ইসলাম; স্যার এ এফ রহমান হলে ভিপি পদে রাকিবুল হাসান, জিএস পদে কাওসার হামিদ; শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে ভিপি পদে হাসিবুর রহমান আসিফ, জিএস পদে নাজমুস সাকিব; জগন্নাথ হলে ভিপি হিসেবে পল্লব চন্দ্র বর্মন, ভিএস পদে সত্যজিৎ দাস; ড. মুহম্মদ শহিদুল্লাহ হলে আশিকুর রহমানকে ভিপি, রবিউল ইসলাম নাহিদকে জিএস; ফজলুল হক মুসলিম হলে শেখ রমজান আলী রকিকে ভিপি, হারুন খান সোহেলকে জিএস; অমর একুশে হলে আসাদুল হক আসাদকে ভিপি ও শাহনোমান জিওনকে জিএস পদে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া ছাত্রীদের পাঁচটি হলের মধ্যে রোকেয়া হলে ছাত্রদলের প্যানেলে শ্রাবণী আক্তারকে ভিপি, আনিকা বিনতে আশরাফকে জিএস ও শ্রাবন্তী হাসান বন্যাকে এজিএস প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। শামসুন নাহার হলে তায়েবা হাসান বিথীকে ভিপি, রাবেয়া খানম জেরিনকে জিএস প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে সাদিয়া রশিদকে ভিপি, মালিহা অবন্তীকে জিএস ও জান্নাতুল ফেরদৌস ইতিকে এজিএস প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। কবি সুফিয়া কামাল হলে তাসনিয়া জান্নাত চৌধুরীকে ভিপি, তাওহিদা সুলতানাকে জিএস ও জাকিয়া সুলতানা আলোকে ছাত্রদলের এজিএস প্রার্থীর মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে এবং বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হলে শারমিন খানকে ভিপি ও জান্নাতুল ফেরদৌস পুতুলকে জিএস প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।