Image description

শেখ হাসিনার শাসনামলে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপাওয়া অধিকাংশ বিচারক বহাল রয়েছেন উচ্চ আদালতে। সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে তারা বিচারিক দায়িত্ব পালন করছেন গুরুত্বপূর্ণ একক এবং দ্বৈত বেঞ্চে। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এখন আপাত: তারা সেজেছেন ‘নিরপেক্ষ’। কিন্তু তাদের রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার স্বাক্ষর রয়েছে হাসিনা রেজিমের সময় দেয়া বিভিন্ন রায়ের পাতায় পাতায়। ধর্মপ্রাণ মানুষ, স্বাধীনতা,মুক্তিযুদ্ধ, একাত্তর, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, বেগম খালেদা জিয়া, আওয়ামী বন্দনা ইত্যাদি বিষয়ে তারা স্পষ্ট করেছেন রাজনৈতিক আনুগত্য। কিন্তু চব্বিশের জুলাই-আগস্ট পরবর্তী সময়ে কেউ ভোল পাল্টেছেন। কেউ সেজেছেন ‘নিরপেক্ষ’। এদের মধ্যে অনেক বিচারক রয়েছেন চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ ও দলদাস। 

কিন্তু রহস্যজনক কারণে এই দলদাস,দুর্নীতিবাজ বিচারকদের বিষয়ে এখন টু শব্দটি করছেন না ‘আওয়ামীবিরোধী’ দাবিদার আইনজীবী নেতারাও। বরং আদালতের বাইরে তারা সেই বিতর্কিত বিচারকদের সঙ্গে বজায় রেখেছেন ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও সখ্যতা। অথচ দেড় দশকের আওয়ামী শাসনামলে ধ্বংসপ্রাপ্ত গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় স্তম্ভ হচ্ছে বিচার বিভাগ। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের বড় প্রতিশ্রæতি ছিলো বিচার বিভাগকে দলদাস মুক্ত করা। সেই প্রক্রিয়ায় গত এক বছরে কিছু সংস্কার উদ্যোগ নেয়া হলেও বিচারপ্রার্থীদের সামনে গুণগত তেমন পরিবর্তন আনতে পারেনি। তবে হাসিনা রেজিমের ধ্বংসপ্রাপ্ত বিচার বিভাগের উত্তরণে গৃহিত অনেক পদক্ষেপ এখন দৃশ্যমান। সমালোচনা রয়েছে, বিচারপ্রাপ্তিতে দীর্ঘসূত্রিতা, মামলা জট, নথি সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা, রেকর্ড রুম, সেকশন, বেঞ্চ অফিসার, নকল প্রাপ্তিতে হয়রানি বন্ধ হয়নি। হাসিনার দেড় দশকের শাসনামলে বিচারিক আদালতে নিয়োগ দেয়া হয় সহ¯্রাধিক বিচারক। তারা আওয়ামী ফ্যাসিবাদের সমর্থন জুগিয়েছেন নিজ নিজ অবস্থানে থেকে। অন্তর্বর্তী সরকার বিচারিক আদালতে সেই অর্থে কোনো আঁচড় কাটেনি।

বিগত সময়ে নানাভাবে নিগৃহিত কিছু জুডিশিয়াল সার্ভিস ক্যাডার ( বিচারক)কে কিছু গুরুত্¦পূর্ণ পদে পদায়ন করেছে। ফ্যাসিবাদী মানসিকতার বিচারকগণ এখন ভোলপাল্টিয়ে তাদের অনেকে এখন হয় ড. মুহাম্মদ ইউনূস সমর্থক। না হয় বিএনপি কিংবা জামায়াতে ইসলামীর গুণগান করছেন। ব্যাপক সমালোচনার প্রেক্ষিতে গত ১০ জুলাই বহুল বিতর্কিত ও দুর্নীতিবাজ ১৮ বিচারককে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায় সরকার। তাদের চাকরির মেয়াদ ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ায় সরকারি চাকরি আইন,২০১৮ এর ৪৫ ধারা অনুযায়ী অবসরে পাঠানো হয় তাদের। যদিও দুর্নীতি এবং ফ্যাসিবাদী ভূমিকার কারণে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত কোনো ব্যবস্থা এখনো দৃশ্যমান নয়।

উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কিছুটা সংস্কার আনার চেষ্টা চলছে। এই প্রথমবারের মতো ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল’র মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে বিচারক। সাত সদস্যের স্বতন্ত্র এ কাউন্সিলে আগ্রহী বিচারিক আদালতের বিচারক এবং আইনজীবীরা আবেদন করেছেন। যাচাই-বাছাই শেষে কাউন্সিলের সুপারিশ মোতাবেক নিয়োগ হচ্ছে বিচারক। ভিত্তিতে শিঘ্রই হয়তো দেয়া হবে এ নিয়োগ। বৈশিষ্ট্যমন্ডিত অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল সাধারণের কাছে প্রশংসা কুড়িয়েছে। কিন্তু এতে দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে আইনজীবীদের নিয়োগ দেয়ার সুযোগ সীমীত থাকায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট অথরিটি নিয়ে সমালোচনা করেছে সুপ্রিমকোর্ট বার। সংগঠনটির দাবি অনুযায়ী জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিলে আইনজীবী প্রতিনিধি রাখা হয় নি। তবে এ সংক্রান্ত জারিকৃত অধ্যাদেশকে ‘ইতিবাচক’ বলে অভিহিত করেছেন বারের অধিকাংশ আইনজীবী।

তবে এর আগে অন্তর্বর্তীকালিন সরকার দায়িত্ব নেয়ার তিন মাসের মধ্যে হাইকোর্ট বিভাগে ২৩ অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগ দেয়া হয় আগের রীতি অনুসারে। উচ্চ আদালতে বিচারক সঙ্কট নিরসনে গত ১১ মাসে আর কোনো বিচারক নিয়োগ দেয়া হয়নি। এই সঙ্কটের অজুহাতে আওয়ামী আমলে নিযুক্ত হাসিনার দলদাস ও বিতর্কিত বিচারকদের দিয়ে এখনো চলছে বিচার কার্যক্রম। ১২ জনকে দীর্ঘ মেয়াদে ছুটিতে পাঠানো হলেও অধিকাংশই রয়েছেন বহাল।

নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচারবিভাগ পৃথকীকরণের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গতবছর ২১ সেপ্টেম্বর রোডম্যাপ ঘোষণা করেন প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। সেই রোডম্যাপ ধরে এগোনোর চেষ্টা করছে বিচার বিভাগ। বিচারক নিয়োগ, বদলি, পদায়ন, পদোন্নতির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হচ্ছে সুপ্রিমকোর্ট থেকে। বিচারিক আদালতের আইনি অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে সুপ্রিমকোর্ট কর্তৃপক্ষ।

শুরু করেছে কিছু প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার। এর মধ্যে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিসের পদ সৃষ্টির ক্ষমতা সুপ্রিমকোর্টের ওপর ন্যস্ত করে ‘বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস গঠন বিধিমালা, ২০২৫’ এবং জুডিসিয়াল সার্ভিসের সদস্যদের সরকারের আইন ও বিচার বিভাগে পদায়নের সুনির্দিষ্ট বিধিমালা প্রণয়ন অন্যতম। দেশের আদালত প্রাঙ্গনে তথ্য ও সেবা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। আদালতে দক্ষ কর্মচারী নিয়োগের লক্ষ্যে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ভাবে নিয়োগের কার্যক্রম চালু করার জন্য নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে।

দুর্নীতি প্রতিরোধে অধস্তন আদালতের বিচারকদের সম্পত্তির হিসাব গ্রহণ। সংগৃহিত হিসেবের নথি পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সাব-রেজিস্ট্রারদের জন্য ব্যক্তিগত তথ্য বিবরণী তৈরি করা হয়েছে। জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার ওপর সংঘটিত বিভিন্ন অপরাধের প্রসিকিউশন কার্যক্রম মনিটরিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে গঠন করা হয়েছে একটি বিশেষ সেল।

অ্যাটাস্টেশন (সত্যায়ন) সেবাকে শতভাগ অনলাইনের আওতায় আনা হয়েছে। বিচারপ্রার্থী মানুষের জামিনপ্রাপ্তি সহজীকরণের লক্ষ্যে অনলাইনে বেইলবন্ড জমা দেয়ার লক্ষ্যে প্রথমবারের মতো সফটওয়্যার প্রস্তুত করা হয়েছে। এটির এখন পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার চলছে।

ঘয়রানিমূলক রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার করা হচ্ছে। জেলা পর্যায়ে গঠিত কমিটি এবং আইন ও বিচার বিভাগ কর্তৃক এজাহার, চার্জশীট সহ বিভিন্ন বিষয় পর্যালোচনার পর ১৫ হাজারেরও বেশি মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়েছে। সাইবার আইনের অধীনে ৪০৮ ‘টি স্পিচ অফেন্স’ সংক্রান্ত মামলা এবং জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুথানে অংশ নেয়া ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া ৭৫২টি হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এর ফলে লাখ লাখ রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও স্বাধীন মতের মানুষ হয়রানি থেকে মুক্ত হয়েছেন।

গম্প্রতি সম্প্রতি এক ব্রিফিংয়ে আইন,বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল দাবি করেন, আইন মন্ত্রণালয়ের দৈনন্দিন কার্যক্রমে লক্ষনীয় গতিশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। গত এক বছরে মন্ত্রী পর্যায়ে নিষ্পত্তিকৃত নথির সংখ্যা ১২৮৩টি, বিগত সরকারের একই সময়ে ৮৩৪ টি নথি নিষ্পত্তি হয়েছিলো। গত এক বছরে আইন মন্ত্রণালয় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগসহ অন্যান্য দপ্তরে ৩৯১টি বিষয়ে আইনি মতামত প্রদান করেছে (গত সরকারের আমলে ছিল ১৮০টি)। এসময়ে সনদ, এফিডেভিট, দলিলসহ ৩৬ ধরণের মোট ১,৫৯,৫৪৪টি ডকুমেন্ট সত্যায়ন হয়েছে। এ সংখ্যা পূর্ববর্তী আওয়ামী সরকারের তুলনায় দ্বিগুন।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর বিভিন্ন সংস্কার কমিশন গঠন করে। এর মধ্যে গুম সংক্রান্ত অপরাধ তদন্ত কমিশন ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে আইন মন্ত্রণালয় থেকে সাচিবিক সহায়তা দেযা হয়। আইন উপদেষ্টা জানান, দেশে প্রথমবারের মতো বিধিমালা ও প্রবিধানগুলোকে কোডিফাই করার কাজ শুরু হয়েছে।

আইন মন্ত্রণালয়ের দেয়া তথ্য মতে, সারাদেশের বিভিন্ন আদালত ও ট্রাইব্যুনালে ৪৮৮৯ জন সরকারী আইন কর্মকর্তা এবং অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসে ২৭৪ জন অ্যাটর্নীকে নিয়োগ দেয় সরকার। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিচারক ও প্রসিকিউটর নিয়োগ করা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগে পাঁচজন বিচারপতি, হাইকোর্ট বিভাগে ২৩ জন বিচারপতি নিয়োগে সাচিবিক সহায়তা দিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল : চব্বিশের মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারের লক্ষ্যে গতবছর ১৪ অক্টোবর পুনর্গঠন করা হয় ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১’। বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদার ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান। তিন সদস্যের এ ট্রাইব্যুনালে অপর দুই সদস্য হলেন, শফিউল আরম মাহমুদ এবঙ মতিতুল হক এনাম চৌধুরী। মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় চলতিবছর ৮ মে পুনর্গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। বিচারপতি মো: নজরুল ইসলাম চৌধুরী ট্রাইব্যুনালটির চেয়ারম্যান। অপর দুই সদস্য হলেন, মো: মঞ্জুরুল বাঝিদ এবং নূর মোহাম্মদ শাহরিয়ার কবীর।

ট্রাইব্যুনাল দু’টিতে সরকারপক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য প্রধান প্রসিকিউটর নিয়োগ দেয়া হয়েছে অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ তাজুল ইসলামকে। তিনি ছাড়াও প্রসিকিউশন টিমে সিনিয়র অ্যাডভোকেট মো: মিজানুল ইসলামসহ ১৭ জন আইনজীবী নিযুক্ত রয়েছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারযোগ্য মামলা তদন্তের জন্য রয়েছে পৃথক তদন্ত সংস্থা। চব্বিশের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে তদন্ত সংস্থার কাছে এ পর্যন্ত ৪শ’৫০টি অভিযোগ দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে ৩০টি মিস কেস। এর মধ্যে দাখিলকৃত তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে ৪টি মামলার। এর মধ্যে ২টি মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন হয়েছে। একটি মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। গতকাল (৭ আগস্ট) পর্যন্ত এ মামলায় ৭ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ এবং সাক্ষীকে আসামিপক্ষের আইনজীবীর জেরা সম্পন্ন হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল-১ এ সাক্ষ্য গ্রহণ অব্যাহত রয়েছে। এ মামলায় ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং পুলিশের তৎকালিন আইজি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে চব্বিশের হত্যা,নির্যাতন,অঙ্গহানি,অগ্নিসংযোগ তথা মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করেন সাক্ষীগণ। সাক্ষীগণ অভিযুক্তদের বিচার দাবি করেন।
পক্ষান্তরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ চলছে রংপুরে শহীদ আবু সাঈদ হত্যা মামলার বিচার। অভিযোগ আমলে নেয়ার পর এ মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ ধার্য রয়েছে আগামি ২৩ আগস্ট।