
অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরে ক‚টনীতিতে সাফল্যের চেয়ে ব্যর্থতার পাল্লাই বেশি ভারী। গত বছরের ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয়া অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য শুধু অভ্যন্তরীণ রাজনীতিই নয়, আন্তর্জাতিক মহলে পরিস্থিতির গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করাও ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে চীন, ভারত, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিমা বিশ্ব এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কাছে এ সরকারের স্বীকৃতি আদায় ও গণঅভ্যুত্থানের বিষয়টি গ্রহণযোগ্য করে তোলা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক, ঋতসহায়তা অক্ষুন্ন রাখা এবং বিদেশি সহযোগিতায় চলমান ছোট-বড় প্রকল্পগুলোর কার্যক্রম অব্যাহত রাখাও ছিল অত্যন্ত জরুরি। এর পাশাপাশি, চলমান রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান, বিনিয়োগে বিদেশিদের আকর্ষণ করা এবং বিভিন্ন দেশের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক স্থাপন ছিল অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ।
ক‚টনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক উত্তেজনা ও নির্বাচনী অনিশ্চয়তার পটভ‚মিতে গঠিত এই অন্তর্বর্তী সরকারের কাঁধে ছিল তিনটি অগ্রাধিকারভিত্তিক দায়িত্ব : একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করা, আন্তর্জাতিক মহলে রাজনৈতিক আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য ক‚টনৈতিক ভিত্তি গড়ে তোলা। এ সময় বিশ্ব রাজনীতিতে বহু পরিবর্তন, দক্ষিণ এশিয়ায় বাণিজ্য প্রতিযোগিতা, বৈশ্বীক মুদ্রাস্ফীতি এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ভ‚রাজনৈতিক টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে সরকারকে এগিয়ে যেতে হয়েছে। তবে সরকার চাইলে নির্বাচনের রোডম্যাপ আরও আগেই ঘোষণা করলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করানোসহ আরও অনেক জটিলতা কাটানো সম্ভব হতো। বিশ্লেষকরা মনে করেন, গত এক বছরে সরকারের ক‚টনৈতিক সাফল্যের ক্ষেত্রে মোটাদাগে কোনো বিষয় চোখে পড়েনি। বিশেষ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কার্যকলাপ ছিল অনেকটাই সমন্বয়হীনতায় পরিপূর্ণ। স্বয়ং পররাষ্ট্র উপদেষ্টার ক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন ছিল। তাঁকে পাশ কাটিয়ে অনেককিছুই নিয়ন্ত্রণ করেছেন প্রধান উপদেষ্টার জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান। যিনি গত যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কারোপের ইস্যূতে অনেক দিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করেছেন। তবে শেষ পর্যন্ত বাণিজ্য উপদেষ্টার নেতৃত্বেই একটা ফলাফল এসেছে। নিজের মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ বিষয়েও পররাষ্ট্র উপদেষ্টার তৌহিদ হোসেনের তেমন কোনো ভূমিকা ছিল না বললেই চলে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ক‚টনীতিতে সবচেয়ে বড় অগ্রগতি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যনীতিতে সফলতা। এটা উল্লেখযোগ্য সাফল্য বিবেচনা করা হলেও এে আগে-পিছে কোথাও ছিলেন না পররাষ্ট্র উপদেষ্টা। উল্লেখ্য, গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পণ্যের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ করেছে, যেখানে ভারত পেয়েছে ২৫ এবং পাকিস্তান ১৯ শতাংশ। এর ফলে তৈরি পোশাক, হোম টেক্সটাইল এবং চামড়াজাত পণ্য রফতানিতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বিজিএমইএর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মাত্র ১ মাসে ১৫০ মিলিয়ন ডলারের অর্ডার বৃদ্ধি পেয়েছে। ক‚টনৈতিক বিশ্লেষক হুমায়ুন কবীর মনে করেন, এক বছরে এটি সরকারের একটি উল্লেখযোগ্য ক‚টনৈতিক সাফল্য। অনেক বড় দেশও এ ক্ষেত্রে সফল হতে পারেনি। তিনি বলেন, সরকার লবিংয়ের জন্য বিশেষ দূত নিয়োগ করেছে, যিনি মার্কিন সিনেট, বাণিজ্য বিভাগ এবং ডায়াসপোরা কমিউনিটির সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করেছেন। ‘লিগ্যাল স্ট্যান্ডিং অব ডেমোক্রেসি ট্রানজিশন’ শীর্ষক বিশেষ বার্তা যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টে পাঠানো হয়। ধারাবাহিক আলোচনার ফলে বাংলাদেশ পাল্টা শুল্কে সুবিধা পেয়েছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ক‚টনৈতিক আরেকটি সাফল্য হলো মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজার আবার উন্মুক্তকরণ। এ বছরের মে মাসে মালয়েশিয়ার সরকার বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য শ্রমবাজার আংশিকভাবে খুলে দেয়। এর মাধ্যমে কনস্ট্রাকশন, টুরিজম, পরিষেবা এবং কৃষি খাতে নিয়োগের অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রাথমিকভাবে ২০ হাজার শ্রমিক নেওয়ার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বোয়েসেলের মাধ্যমে ‘গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট’ চুক্তি নবায়ন করা হয়েছে। একই সঙ্গে মানব পাচারবিরোধী কমিটিতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। যদিও মালয়েশিয়ার সরকারি সূত্র জানিয়েছে, বোয়েসেল নির্দ্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এখনও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জনশক্তি পাঠাতে পারেনি। আগামী ১১ আগষ্ট প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস মালয়েশিয়া যাবেন। তখন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সাথে তাঁর বৈঠকের কথা রয়েছে। সেখানে দুই নেতার উপস্থিতিতে জনশক্তি রফতানিতে আরও এক লাখ শ্রমিকের বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষর হতে পারে। এটি হলে মালয়েশিয়া যেতে কোনো শ্রমিককে ৪/৫ লাখ টাকা তো দূরের কথা, একটি টাকাও খরচ করা লাগবে না। অর্থাৎ বিনা টাকায় চাকরির গ্যারান্টি নিয়ে একজন শ্রমিক মালয়েশিয়ায় যাওয়ার সুযোগ পাবেন। এতে করে সিন্ডিকেট অকার্যকর হয়ে যাবে। দালালের খপ্পড়ে শ্রমিকরা যাতে আর না পড়ে সেজন্য মালয়েশিয়া সরকার এমন চুক্তি করতে যাচ্ছে বলে মালয়েশিয়া দূতাবাস সূত্রে জানা গেছে। এটি কার্যকর হলে এটাই হবে বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বড় ক‚টনৈতিক সাফল্য। যদিও এটা সম্ভব হতে চলেছে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সাথে ড. ইউনূসের পুরনো বন্ধুত্বের কারণে। এখানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উল্লেখযোগ্য কোনো ভ‚মিকা নেই।
এ ছাড়া সরকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে জোরালো বক্তব্য দিলেও এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি। বরং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে পড়েছে। চীনের মধ্যস্থতায় পুনর্বাসনের কথা থাকলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। কক্সবাজারে মানবিক সহায়তা তহবিলে ২০ শতাংশ ঘাটতি দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিব রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের ঘোষণা দেওয়ার পাঁচ মাস পরও এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি। মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কোনো ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি। গত পাঁচ মাসে মিয়ানমারের জান্তা সরকার আরও বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা নাগরিককে বলপূর্বক বাংলাদেশে প্রবেশ করিয়েছে। মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ করাও সম্ভব হয়নি। ফলে এই প্রক্রিয়া এখন ঝুলে রয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২৫ আগস্ট কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে একটি বিশেষ সম্মেলন হবে। সেখানে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, জাতিসংঘ প্রতিনিধি এবং সংশ্লিষ্টরা অংশ নেবেন। সম্মেলন উদ্বোধন করবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
এ ছাড়া আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সদর দপ্তরে রোহিঙ্গা, আন্তর্জাতিক শরণার্থী এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীবিষয়ক বিশেষ অধিবেশন হবে। সেখানে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুটি জোরালোভাবে তুলে ধরা হবে বলে জানা গেছে। চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পে স্বচ্ছতার ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
এদিকে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হলেও সরকারের প্রকৃত ক‚টনৈতিক সাফল্য অর্জন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। গত ৪ আগষ্ট সোমবার সেন্টারে টিআইবির কার্যালয়ে ‘কর্তৃত্ববাদী সরকার পতন-পরবর্তী এক বছর: প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এমন মন্তব্য করেছে সংস্থাটি। টিআইবি গবেষণা প্রতিবেদনে বলছে, সরকারে তথ্য প্রকাশে সমন্বয়হীনতা ও গোপনীয়তার প্রবণতা রয়েছে। ভারতের অবন্ধুসুলভ আচরণের ফলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে সংকট ও তার ফলে অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব অব্যাহত রয়েছে।
রাষ্ট্রীয় বা সরকারি কার্যক্রমে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পর্যবেক্ষণে অগ্রগতি সম্পর্কে টিআইবি বলছে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার আর্থিক ও অন্যান্য সহায়তা প্রদান ও সহায়তার অঙ্গীকার রয়েছে। দুর্নীতি দমনে সহায়তার ঘোষণা, পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা, মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার, দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপন ও তদন্ত চলমান। বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার পক্ষ থেকে মানবাধিকারের সুরক্ষা, সংখ্যালঘু সুরক্ষা, সহিংসতার ঘটনার পূর্ণ এবং স্বাধীন তদন্তের প্রয়োজনীয়তা, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের অধিকার সুরক্ষিত রাখা, আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয় প্রতিবেদনে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের আলোচনায় অগ্রগতি কথাও বলা হয় এতে।
টিআইবির পর্যবেক্ষণে সরকারের ঘাটতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, রাখাইনে ‘মানবিক করিডর’ দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকারের অস্পষ্ট অবস্থান ও তথ্য প্রকাশে ঘাটতি রয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের অবন্ধুসুলভ আচরণ, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ; সীমান্তে হত্যা ও ‘পুশ ইন’ অব্যাহত; বাণিজ্যে বাধা আরোপ; ক‚টনৈতিক টানাপোড়েন; শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া না জানানোও সরকারের ঘাটতি বলে মনে করে টিআইবি।