
‘রোজার আগে নির্বাচন’ ঘোষণা সরকারের অনেক ব্যর্থতাকে কার্পেটের নিচে চাপা দিয়েছে :: ঘোষিত সময়ে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেই নির্ভর করছে সরকারের সফলতা-ব্যর্থতা ‘মানুষ মরণশীল। প্রত্যেককেই একদিন না একদিন মরতে হবেই। মৃত্যুর পরে একজন মানুষের কর্ম তাকে বাঁচিয়ে রাখে। বিশ্বজয়ী অনেক রাজা-বাদশার মৃত্যুর পর মানুষ মনে রাখেনি। অথচ রাষ্ট্রের কোনো পদেই ছিলেন না; ডা: মুহাম্মদ ইব্রাহিমকে একটি হাসপাতাল (বারডেম) প্রতিষ্ঠার জন্য এখনো স্মরণ করে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে কী একশ বছর পর মানুষ মনে রাখবে?
তিনি কী অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দেশের ভোটের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন? নাকি সাদ্দাম হোসেন পরবর্তী ইরাকের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট গাজী মাশাল আজিল আল-ইয়াওয়ারের মতো মার্কিন এজেন্ডা বাস্তবায়নের পথে হাটবেন? এ নিয়ে বিতর্ক চলছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা, মানুষের প্রত্যাশা-প্রাপ্তি নিয়ে আলোচনা-বিচার বিশ্লেষণ হচ্ছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর এক বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন এবং মাফিয়া নেত্রী হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ রীতিমতো উৎযাপন করেছে। ভারতের পুুতুল হাসিনা জনগণের ভোটের অধিকার ছিনতাই করে জনগণের উপর জুলুম-নির্যাতন এবং মাফিয়াতন্ত্র কায়েমের মাধ্যমে দেশকে ভারতের পদানত করে রেখেছিল।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে প্রায় ১৬ বছরের রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় মাফিয়াতন্ত্রের অবসান ঘটেছে। আন্দোলনে অনেক রক্ত ঝড়েছে। কেবল গত বছরের ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত রাজধানীসহ সারা দেশে হাসিনার নির্দেশে তার অনুগত আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের সশস্ত্র ক্যাডারদের হামলায় ১৪শ’ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হয়েছে হাজারো ছাত্র-তরুণ-তরুণী। ড. ইউনূসের মতো বরেণ্য ব্যক্তিত্ব অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নোয়ায় সবার প্রত্যাশা ছিল অতীতের ব্যর্থতা সংশোধন করে দেশ নতুনভাবে যাত্রা শুরু করবে। মানুষ ভোটের অধিকার ফিরে পাবে এবং প্রতিটি সেক্টরে ন্যায্যতার ভিত্তি স্থাপিত হবে সবার মধ্যে এনিয়ে ইতিবাচক প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়। হাসিনা যে ছাত্রলীগ আর যুবলীগের পান্ডাদের চাকরি দিয়ে প্রশাসনকে আওয়ামীকরণ করেছে তা থেকে মুক্ত হবে। শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ফিরে যাবে, কৃষকরা উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য পাবে, শ্রমিকরা কাজ পাবে, ব্যবসায়ীরা নির্বিঘেœ ব্যবসা করবে; বেকারদের কর্মসংস্থান হবে, আইন-শৃংখলার উন্নতি হবে এবং নাগরিক ন্যায় বিচার পাবে। প্রশ্ন হলো অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরে মানুষের এই প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে মিল-অমিল কতটুকু? রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করছেন জুলাই বিপ্লবের এক বছর পূর্তিতে যেমন সংস্কার প্রক্রিয়া, রিজার্ভ বৃদ্ধি ও নির্বাচনী প্রস্তুতিসহ কিছু অর্জন দেখছি; তেমনি অনেক ব্যর্থতা এবং গøানিও দেখছি।
জুলাই গণঅভ্যুত্থান শুধু ৩৬ দিনের আন্দোলন ছিল না। এটি ছিল গত ১৭ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা থেকে মুক্তির আন্দোলনের ধারাবাহিকতার শেষ পরিণতি। হাসিনা ভারতের সহায়তায় দেশে মাফিয়াতন্ত্র কায়েম করেছিল। প্রতিটি সেক্টরে তাবেদার সৃষ্টি করে বিরোধী রাজনীতি ধ্বংসের চেষ্টা হয়েছে। বছরের পর বছর বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের উপর জুলুম-নির্যাতন, হত্যা, খুন-গুম, আইন-শৃংখলা বাহিনীকে দিয়ে পৈশাচিক নির্যাতন ও দেড় যুগ ধরে ভোট দিতে না পারার বঞ্চনার প্রতিশোধও ছিল এই অভ্যুত্থানে। এ জন্য জাতিকে অনেক মূল্যও দিতে হয়েছে। জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের প্রতিবেদনে অনুযায়ী জুলাই আন্দোলনে শেখ হাসিনার নির্দেশে আইন-শৃংখলা বাহিনীর গুলিতে এক হাজার ৪০০ ছাত্র-জনতা নিহত হয়। পাশাপাশি ১১ হাজারের বেশি মানুষ পঙ্গু ও আহত হয়। সশস্ত্র বাহিনী প্রথম দিকে আইন-শৃংখলা রক্ষা বাহিনীগুলোর সহায়তায় থাকলেও পরবর্তী সময়ে জুলাইয়ের শেষের দিকে সাধারণ মানুষের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকৃতি জানায়। যার পরিণতি হাসিনার পালায়ন। পৃথিবীর কোনো দেশ মানবাধিকার লংঘনকারী এবং বিপুলসংখ্যক মানুষ হত্যাকারী হাসিনা আশ্রয় না দিলেও হিন্দুত্ববাদী ভারত সন্ত্রাসের রানী হাসিনাকে আশ্রয় দেয়। পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশটি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নানামুখি ষড়যন্ত্র করতে থাকে।
ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জুলাইয়ের আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের জন্য দেশের মানুষের পাহাড়সম প্রত্যাশা। অন্তর্বর্তী সরকার প্রত্যাশিত সব আকাক্সক্ষা পূরণ করতে পারেনি; প্রশাসনকে এখনো ভারতের তাবেদারমুক্ত করা যায়নি। প্রশাসনে আওয়ামী চেতনার কর্মকর্তারা রয়েছেন এই শক্তিতে দিল্লিতে পলাতক হাসিনা একের পর এক হুংকার হুমকি দিয়েই যাচ্ছেন। হাসিনা যে ভারতের স্বার্থে ১৫ বছর যে সব দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করেছে সেগুলোও সরকার প্রকাশ করেনি। তবে দিল্লির রানী হাসিনার বিরুদ্ধে সব রাজনৈতিক দল ও জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারা সরকারের একটি বড় অর্জন। জনদাবির মুখে ইতোমধ্যেই ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমনকি নির্বাচন কমিশন থেকে নৌকা প্রতীক বাদ দেয়া হয়েছে। শুদু তাই নয় সবধরনের অনিশ্চয়তা দূরে ঠেলে দিয়ে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ প্রকাশ এবং রমজানের আগে জাতীয় নির্বাচনের চ‚ড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য বড় অর্জন। কারণ আগামী জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে ভারতের নীল নকশা অনুযায়ী সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি (পিআর) নির্বাচনের দাবিতে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন রাজনৈতিক বিশৃংখলা সৃষ্টির চেষ্টা করে। এমনকি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া শিক্ষার্থীদের দল এনসিপিও দিল্লির ফাঁদে পা দেয় এবং নাম সর্বস্ব কিছু দলকে নিজেদের দাবির প্রতি নিতে সমর্থ হয়।
মাফিয়াতন্ত্রের রানী হাসিনা দেশের রাজনীতি এবং প্রশাসনিক সিস্টেম ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। দলীয় কারণে প্রশাসনে কার্যক টর্ণেডো বয়ে গেছে। গত বছরের ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর প্রশাসনে শৃংখলা ফেরাতে বিভিন্ন সেক্টরে সংস্কারের লক্ষ্যে সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে সংবিধান, নির্বাচন, বিচার, পুলিশ, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন, মিডিয়া, স্বাস্থ্য, শ্রমিক অধিকার, নারী অধিকার এবং স্থানীয় সরকার সংক্রান্ত এই ১১টি কমিশন গঠিত হয়। কমিশনগুলো তাদের প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দেয়। চলতি বছরের ২৫ মে ক্যাবিনেট ডিভিশন নির্বাচন, বিচার, দুর্নীতি দমন, পুলিশ এবং জনপ্রশাসন সংক্রান্ত ১২১টি তাৎক্ষণিক বাস্তবায়নযোগ্য সংস্কার প্রস্তাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছে। এদিকে সংস্কার প্রস্তাবনা এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করে রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়। ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপের ভিত্তিতে ‘জুলাই সনদের’ একটি খসড়া তৈরি করা হয়; যেখানে ৬২টি সংস্কার প্রস্তাবে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই প্রস্তাবগুলোকে দেশের সংবিধান, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচন, প্রশাসন ও দুর্নীতি দমন কাঠামোকে সময়োপযোগী ও গণমুখী করার সম্ভাব্য রূপরেখা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। সংস্কার প্রক্রিয়ার গতি খুবই ধীর মনে হচ্ছে।
ড. ইউনূসের সরকার খাদের কিনার থেকে অর্থনীতিতে তুলে আনার চেষ্টা করছে। ব্যাংকিং সেক্টরে ধ্বংস এবং বৈদেশিক রিজার্ভের ধ্বংস নেমেছিল। সেখান থেকে সরকার অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের চেষ্টা করছে। দেশে বাণিজ্য গতিশীল এবং বিদেশি বিনিয়োগের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলন-২০২৫ করেছে।এছাড়াও প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনি সংস্কারের লক্ষ্যে স্বাধীন বিচার বিভাগকে শক্তিশালীকরণ উদ্যোগ, পুলিশ সংস্কারে মানবাধিকার সেল, বডিক্যাম, পররাষ্ট্রনীতিকে একক দেশের ওপর নির্ভশীলতা থেকে ভারসাম্যপূর্ণ, বহুমেরু পদ্ধতির দিকে পুনর্বিন্যাস, প্রবাসী ও শ্রম অধিকার, জুলাই অভ্যুত্থানের সব শহীদ ও আহতদের তালিকা সতর্কতার সঙ্গে প্রণয়ন; ৭৭৫ জন শহীদ যোদ্ধা পরিবারকে প্রায় ১০০ কোটি টাকা সঞ্চয়পত্র ও ভাতা প্রদান এবং ১৩ হাজার ৮০০ জন আহত যোদ্ধাকে ১৫৩ কোটি টাকা সহায়তা প্রদান করা হয়। গুরুতর আহতদের উন্নত চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য বিদেশে পাঠানো হয়েছে। তারপরও নির্বাচন নিয়ে ছিল অনিশ্চয়তা। মানুষের প্রত্যাশিত ভোটের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় আগামী বছরের ফেব্রæয়ারি মাসের প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য। মূলত ফেব্রæয়ারিতে নির্বাচন সরকারের অনেক ব্যর্থতাকে কর্পেটের নিচে চাপা দিচ্ছে। এছাড়া হাসিনা পালানোর পর থেকে এক বছরে সামরিক ক্যু, জুডিশিয়াল ক্যু, ১৫ আগস্ট ইস্যুতে ঢাকা ঘেঁড়াও, সচিবালয় ঘেঁড়াও, প্রশাসনে অস্থিরতা, আনসার বিদ্রোহ, সংখ্যালঘু নির্যাতনের কথিত ইস্যু, গার্মেন্টস শিল্পে অস্থিরতা, পাহারে অশান্তি, গোপালগঞ্জের নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের অরাজকতা, ইসকন ইস্যুতে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ, হিন্দুত্ববাদী ভারতের খিঙ্কট্যাঙ্কদের বাংলাদেশে মৌলবাদের উত্থানের মিথ্যা বয়ান সাজিয়ে বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি নষ্টের চেষ্টাসহ মাফিয়ানেত্রী হাসিনাকে আশ্রয় দেয়া ভারতের সব ধরনের ষড়যন্ত্র দেশবাসী ও রাজনৈতিক দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে মোকাবিলা করতে সম্ভম হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
তবে প্রশাসনকে এখনো পুরোপুরি গতিশীল করা যায়নি। কিছু উপদেষ্টার অযোগ্যতা ও দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আওয়ামী লীগের অলিগার্ক আমলারা নানা সুযোগ নিচ্ছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের ভিতরে সরকার, সরকারের কিছু কিছু উপদেষ্টার দীর্ঘমেয়াদী ক্ষমতায় থাকার খায়েশে নির্বাচন পেছানোর নানা চেষ্টা হয়েছে। এমনকি মব জাস্টিসকে কঠোর ভাবে দমন করা যায়নি। ফ্যাসিস্ট হাসিনা দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনামলে গোটা প্রশাসনকে দলীয়করণ করেছেন; প্রশাসনের সচিব থকে শুরু করে জেলার উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারা আওয়ামী লীগের কর্মী বাহিনীতে সাজানো হয়েছে। তাদের মাধ্যমে হাসিনা তিনটি জাতীয় নির্বাচনের নামে প্রহসন এবং বিরোধী দলকে জুলুম-নির্যাতনের মাধ্যমে দমিয়ে রেখেছিলেন। দীর্ঘ এক বছরেও হাসিনা অনুগত আমলাদের বেশির ভাগই এখনো প্রশাসনে বহাল রয়ে গেছেন। এখনো আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা দেশে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টায় সংগঠিত হচ্ছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানসহ গত ১৬ বছরে পুলিশ, র্যাব, বিজিবির যে সদস্যরা গুলি করে হাজারো মানুষ হত্যা করেছে, তাদের চিহ্নিত ও গ্রেফতার করা হয়নি। পুলিশ ও প্রশাসনের কোনো সংস্কার হয়নি; এখনো আইন-শৃংখলা রক্ষার নামে চলছে ঘুষ। মামলা নিয়ে চলছে বাণিজ্য। এখনো প্রশাসনে তদবির বাণিজ্য, ঘুষ, দুর্নীতি সবই চলছে। বিগত বছরগুলোতে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের দমনে আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্য যারা আয়নাঘর বানিয়েছে, অবৈধ নির্বাচনে রাতে ব্যালটে সিল মেরেছে, গুম-খুন করেছে, সেই গোয়েন্দা সংস্থার ন্যূনতম সংস্কার ও দোষীরা শাস্তির আওতায় আসেনি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রলীগের ক্যাডার যারা শিক্ষক হিসেবে ও অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে চাকরিতে ঢুকেছে তাদের চিহ্নিত এবং চাকরিচ্যুত করা হয়নি। যে গণমাধ্যম হাসিনার তোষামোদি করতো, যে সাংবাদিকরা হাসিনার ফ্যাসিবাদের সহযোগী ছিল, সেই গণমাধ্যমের কোনো সংস্কার হয়নি। ব্যক্তি সংস্কার বা জাতিকে কাউন্সিলিং করার কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ১৬ বছর ধরে নতুন প্রজন্ম ফ্যাসিবাদী কাঠামোর মধ্যে বেড়ে উঠেছে, তাদেরকে মেন্টাল কাউন্সিলিংয়ের কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা হচ্ছে নতুন বাংলাদেশের মূল বৈশিষ্ট্য হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্র, অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র, কল্যাণমুখী, বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী এবং দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন। অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্র নিশ্চিত করার জন্য সব ধর্ম, জাতি, লিঙ্গ ও বর্ণের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে ধর্মীয় চেতনা ধারণ করে শিক্ষা-শিল্প-সংস্কৃতির চর্চায় উদ্যোগী হওয়া। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার অধিকার নিশ্চিত করা গেলেও গণঅভ্যুত্থানের পর সমগ্র পুলিশ বাহিনী নিষ্ক্রিয় হওয়ায় নতুন অপসংস্কৃতি ‘মব ভায়োলেন্স’-এর উদ্ভব হয়েছে। এই মব ভায়োলেন্সের নেপথে অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়ার নেপথ্যে ছাত্রনেতাদের গঠিত দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) রয়েছ এমন অভিযোগ উঠে। এমনকি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়ে যারা সূর্যসন্তানের গৌরব অর্জন করেন; তাদের কেউ কেউ নিয়োগ বদলি বাণিজ্য, চাঁদাবাজীর অভিযোগে অভিযুক্ত হন। তারপরও অন্তর্বর্তী সরকারের কেউ কেউ ওই দলকে পৃষ্ঠপোষকতা করেন এমন অভিযোগ উঠে।
অভ্যুত্থানের এক বছর হয়ে গেলেও পুলিশ প্রশাসনে নতুন পুলিশ নিয়োগ দেয়া হয়নি। ফলে হাসিনার অলির্গাকরা আইন-শৃংখলা নিয়ন্ত্রণে গরিমসি করছেন। হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত ১৯৪টি মব ভায়োলেন্সে ১২১ জন প্রাণ হারিয়েছে। এতে আন্তর্জাতিক মহল মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ওই একই সময়ে ৪৪৪টি রাজনৈতিক সহিংসতায় ১২১ জনের মৃত্যু ঘটে এবং চার হাজার ৯৮২ জন আহত হয়। আগস্ট ২০২৪ থেকে ডিসেম্বর ২০২৪-এর মধ্যে এক হাজার ৫৬৫টি হত্যা মামলা, এক হাজার ৪১২টি ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা এবং ৬৪২টি অপহরণের ঘটনা রেকর্ড করা হয়।
অর্থনীতির গতিধারায় প্রত্যাশিত গতি না পাওয়ায় উচ্চ মুদ্রাস্ফীতিতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে, প্রান্তিক মানুষের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। সার্বিকভাবে সামাজিক চাপ ও অস্থিরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি, ব্যাংক সেক্টরে শৃংখলা ফিরিয়ে আনা, গার্মেন্টস সেক্টরে শৃংখলা ফিরিয়ে আনা, এনবিআরকে পুনর্গঠন ইত্যাদিতে অগ্রগতি হয়েছে।
জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, সরকার গঠনের পর আমাদের তিনটি দায়িত্ব ছিল: সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন। জুলাই অভ্যুত্থানের ছাত্র-শ্রমিক-জনতা দেয়ালে দেয়ালে যে প্রত্যাশার কথা লিখে রেখেছিল তার অন্যতম ফোকাস ছিল রাষ্ট্রব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কার। সে লক্ষ্যে আমরা বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করেছিলাম। তাদের মধ্যে প্রধান প্রধান সংস্কার কমিশনগুলো যে সুপারিশ পেশ করেছে সেগুলোর মধ্যে স্বল্প সময়ের মধ্যে বাস্তবায়নযোগ্য করেছি। সব রাজনৈতিক দলকে সঙ্গে নিয়ে জাতির কাছে জুলাই ঘোষণাপত্র উপস্থাপন করেছি। জুলাই অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে করা সংস্কারগুলোর মাধ্যমে অর্থনৈতিক খাত, বিচার ব্যবস্থা ও জনপ্রশাসনে গতিশীলতা আসবে; স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। দুর্নীতি, অনিয়ম ও হয়রানি হ্রাস পাবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ পূর্ণ উপলক্ষে গতকাল সংবাদ সম্মেলন করে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম শান্তি ও স্থিতিশীলতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, গণতান্ত্রিক সংস্কার ও জুলাই সনদ, জুলাই হত্যাযজ্ঞের বিচার, নির্বাচন পরিকল্পনা ও সংস্কার, প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনগত সংস্কার ১২টি সফল্যের চিত্র তুলে ধরেছেন। অন্যদিকে গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান ফেসবুকে পোস্টে প্রেস সচিবের ১২ সফলতার বিপরীতে ১২টি ব্যর্থতা দেখিয়েছেন। তার এই ব্যর্থতার খতিয়ান হচ্ছেÑ এনএসআই, ডিজিএফআই আয়নাঘর বানিয়েছে, ৩টা অবৈধ নির্বাচন করেছে, গুম-খুন করেছে, সেই গোয়েন্দা সংস্থার ন্যূনতম সংস্কার ও দোষীরা শাস্তির আওতায় আসেনি। বিচার বিভাগ, সচিবালয়, বিভিন্ন দফতর ও সেক্টর এবং স্থানীয় প্রশাসনে আওয়ামী সেটআপ পুরোপুরি বহাল। অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরে প্রত্যাশা-প্রাপ্তি নিয়ে যেন সমীরকণ চলছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রমজানের আগে নির্বাচনের ঘোষণার পর সারাদেশে নির্বাচনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। এ ধারা চলতেই থাকেন। যথাসময়ে নির্বাচন হলে সব ধরনের অনিশ্চয়তা কেটে যাবে। যথাসমযে যাতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সে লক্ষ্যে সকলকে সতর্ক ও সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। ১৯৯১ সালের বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ, ১৯৯৬ সালে বিচারপতি হাবিবুর রহমান, ২০০১ সালে বিচারপতি লতিফুর রহমান ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছেন। আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষিত সময়ে নির্বাচন করে ইতিহাস সৃষ্টি করবেন সে প্রত্যাশাই করছে দেশবাসী।