
কান্না থামে না তাহেরা বেগম দুলির। এক এক করে গ্রামের মানুষ এসে তার হাত চেপে ধরছে, চোখ মুছে দিচ্ছে, কেউ কিছু বলছে না। তবু দুলির একটা কথা বারবার শোনা যায়, আমার ভাইপোটা আর কোনোদিন ফিরবে না, বুকে আগুন জ্বলছে।
তিনি বলছেন মৌলভীবাজারের কুলাউড়া পৌরসভার মাগুড়া গ্রামের সন্তান নিউইয়র্ক পুলিশ কর্মকর্তা দিদারুল ইসলাম রতনকে নিয়ে। যিনি নিউইয়র্কে সন্ত্রাসীর গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন।
মঙ্গলবার দুপুরে সরেজমিনে দেখা গেছে, তার এই অকাল মৃত্যুতে শোকের মাতম বইছে পরিবারে। নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছে গোটা মাগুরা গ্রাম। কান্নায় ভেঙে পড়েছেন আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী ও প্রবাসী বাংলাদেশিরা। প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সবার মনে, ‘এমন এক মেধাবী, নম্র, দেশ-বিদেশের গর্ব হয়ে ওঠা মানুষ, হঠাৎ কেন নিভে গেল?’
এটি একটি অপূরণীয় ক্ষতি শুধু একটি পরিবারের নয়, কুলাউড়া, মৌলভীবাজার ও বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশি সমাজের। তার এমন মৃত্যুর সংবাদ শুনে মাগুরার বাতাসেও এখন যেন কান্নার গন্ধ। যে ঘরে রতনের হাসি ছিল, এখন সেখানে শুধু নিঃশব্দ দীর্ঘশ্বাস।
মানুষের মুখে একটাই প্রশ্ন, এমন করে হারাতে হবে? এমন একজন সৎ, নিষ্ঠাবান পুলিশ অফিসার, যিনি অন্যদের রক্ষা করতে গিয়ে নিজেই প্রাণ হারালেন, এতটা অন্যায় কেন? সত্যিই, রতনের মৃত্যু শুধু একটি জীবনের সমাপ্তি নয়, এটি হাজারো স্বপ্ন, ভালোবাসা, পরিবার, বন্ধুত্ব ও দায়িত্ববোধের এক অসমাপ্ত গল্প।
রতন শুধু পরিবারের নয়, গ্রামেরও গর্ব ছিলেন। তার শূন্য বাড়ির সামনে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মানুষ। মুখে কেউ কিছু বলছে না। এমন নীরবতা গ্রামে খুব কমই দেখা গেছে।
রতনের শৈশব কেটেছে বড়লেখার শিক্ষারমহল গ্রামে। বাবার চাকরির সূত্রে পরিবার চলে আসে কুলাউড়ায়। ২০০৯ সালে পরিবারের সঙ্গে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। উচ্চশিক্ষা শেষ করে ভর্তি হন নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগে। কর্মস্থল ছিল ব্রঙ্কসের ৪৭ প্রিসিঙ্ক্ট। দায়িত্ববোধ, সততা আর নিষ্ঠায় অল্প সময়ে সবার প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন।
রতনের স্ত্রী বর্তমানে অন্তঃসত্ত্বা। সেই অনাগত সন্তানের পৃথিবী দেখার আগেই রতন চলে গেলেন—এই সত্যটা মেনে নিতে পারছেন না কেউই। রতনের মা-বাবা ও দুই বোন নিউইয়র্কেই থাকেন। তারা লাশ বুঝে নিতে গিয়ে শুধু কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাদের আহাজারি ফোনে শুনেও কুলাউড়ার মানুষের হৃদয় ভার হয়ে উঠেছে।
রতনের স্কুলশিক্ষক আবু জাফর বললেন, রতন আমার ছাত্র ছিল। খেলাধুলায়, লেখাপড়ায়, ব্যবহার সবকিছুর মধ্যেই এক আলাদা জ্যোতি ছিল তার। এমন ছেলেকে হারানো আমাদের পুরো এলাকার জন্য দুঃস্বপ্নের মতো।
রতনের প্রতিবেশী হাসিম খান ভূট্রো বলেন, ও আমাদের গর্ব ছিল। এলাকার ছেলেদের পথ দেখাতো। বাইরে থাকলেও এলাকার খোঁজ রাখত, দেশে এলে সবার সঙ্গে মিশে যেত। আমরা ভাবতেই পারছি না সে আর নেই।
রতনের মৃত্যু কেবল তার পরিবারের জন্য নয়, প্রবাসী বাংলাদেশি সমাজের জন্যও এক অপূরণীয় ক্ষতি। তার জীবন কেবল নিজের সীমায় আবদ্ধ ছিলো না। তিনি হয়ে উঠেছিলেন একটি বৃহৎ সমাজের অনুপ্রেরণা।
কুলাউড়া উপজেলা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল বারী সুহেল বলেন, রতন ভাই ছিলেন হৃদয়ের মানুষ। তার মৃত্যুর খবরে আমরা যারা তাকে চিনতাম, সবাই স্তব্ধ। মনে হয়, এই পৃথিবীর অনিশ্চয়তা আমাদের কাঁধে এসে বসে আছে।