Image description

২০১৮ সালে সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলন করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ইংরেজি সাহিত্যের সাবেক শিক্ষার্থী নুরুল হক নুর পরের বছর ২০১৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হন। এরপর জাতীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। এর মধ্য দিয়ে ‘স্পষ্টভাষী’ নুর রাজনৈতিক অঙ্গনে হয়ে ওঠেন পরিচিত মুখ। তবে বিএনপির নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন করলেও নির্বাচন সামনে রেখে নুর সাম্প্রতিক সময়ে ‘নির্বাচন পদ্ধতি’ নিয়ে বিপরীত শিবিরে থাকা জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের দিকে খানিকটা ঝুঁকে পড়েছেন বলে অনেকের অভিমত। এ ছাড়া নানা ইস্যুতে মাঝেমধ্যে বিএনপির বিরুদ্ধেও সমালোচনামুখর তিনি। এমন অবস্থায় আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে রাজনীতিতে নুরুল হক নুরের গন্তব্য কোথায়—সেই প্রশ্ন আজ সামনে আসছে।

জানা গেছে, আগামীতে পটুয়াখালী-৩ (গলাচিপা-দশমিনা) আসন থেকে নির্বাচন করাই নুরের লক্ষ্য।

তবে সেখানে বিএনপি থেকে শক্ত প্রতিপক্ষ রয়েছেন হাসান মামুন; যিনি দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি। তাই নুরের লক্ষ্য দ্রুততম সময়ে মনোনয়ন নিশ্চিত করা। কিন্তু বিএনপি এখনো এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি। অবশ্য ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন এবং জুলাই-আগস্ট গণআন্দোলনে ‘নুরের সাহসী ভূমিকা’ বিবেচনায় রয়েছে দলটির। মিত্রদের জন্য আগামী নির্বাচনে বেশকিছু আসনও ছাড়বে বিএনপি। নির্বাচনে বিজয়ী হলে যুগপতের মিত্রদের নিয়ে জাতীয় সরকার গঠনেরও অঙ্গীকার রয়েছে তাদের।

নুরের ঘনিষ্ঠরা বলছেন, বিএনপি থেকে মনোনয়ন এখনো নিশ্চিত না হওয়ায় নির্বাচন সামনে রেখে কিছুটা কৌশলী ভূমিকা নিয়েছেন নুরুল হক নুর। বিএনপি-জামায়াত দুই শিবিরেই তিনি যোগাযোগ রাখছেন। তবে বিএনপি না জামায়াত, কোন জোটে যাবেন—সে ব্যাপারে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেননি। তার ঘনিষ্ঠজনদের দাবি, বিএনপি থেকে নুরের মনোনয়ন নিশ্চিত হলে তার বর্তমান অবস্থানও (সমালোচনামুখর) পাল্টে যেতে পারে।

অর্থনীতিবিদ রেজা কিবরিয়াকে আহ্বায়ক এবং নুরুল হক নুরকে সদস্য সচিব করে ২০২১ সালের ২৬ অক্টোবর নতুন দল ‘গণঅধিকার পরিষদ’-এর আত্মপ্রকাশ ঘটে। একপর্যায়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও মতবিরোধে দলটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। পরে ২০২৩ সালের ১০ জুলাই কাউন্সিলে নুরুল হক নুর গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি এবং রাশেদ খান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরপর ২০২৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পায় গণঅধিকার পরিষদ (জিওপি)।

নুর গণতন্ত্র মঞ্চের শরিক হয়ে ২০২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর থেকে বিএনপির নেতৃত্বে শুরু হওয়া ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন। তবে মাত্র চার মাসের মাথায় ২০২৩ সালের ৬ মে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে গণতন্ত্র মঞ্চ থেকে বেরিয়ে যান তিনি। তবে পুরো যুগপৎ আন্দোলনে পৃথকভাবে রাজপথে সক্রিয় ছিল গণঅধিকার পরিষদ। এরপর জুলাই-আগস্ট গণআন্দোলন সংগঠিত করার ক্ষেত্রেও নেপথ্য ভূমিকা রাখেন ভিপি নুর। আন্দোলন চলাকালে ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই নুরকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তাকে দুটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে মোট ১০ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। রিমান্ডে নুরের ওপর অকথ্য শারীরিক নির্যাতন চালানো হয় বলে গণঅধিকার পরিষদের পক্ষ থেকে অভিযোগ।

গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী সরকারের পতনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নুরুল হক নুরসহ যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলগুলোর ছয় নেতাকে এলাকায় জনসংযোগ ও সাংগঠনিক কার্যক্রমে সহযোগিতা করতে ২০২৪ সালের ২২ অক্টোবর সংশ্লিষ্ট ছয়টি জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের ‘অতীব জরুরি’ নির্দেশনা-সংবলিত চিঠি দেয় বিএনপি। ওই চিঠি পাওয়ার পর নির্বাচন সামনে রেখে এলাকায় (পটুয়াখালী-৩) গিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করার কাজ করছিলেন নুর। কিন্তু সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনায় বাধার সম্মুখীন হন। একপর্যায়ে চলতি বছরের জুনে ভিপি নুর ও বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী হাসান মামুনের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ভাঙচুর ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

বিএনপি পিআর পদ্ধতিতে নয়, বিদ্যমান ব্যবস্থায় জাতীয় নির্বাচন চায়। তারা জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন চায় না। অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ আগে স্থানীয় নির্বাচন এবং পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন চায়। এই দাবিতে দল দুটি রাজধানীতে সম্প্রতি বড় সমাবেশও করেছে। পিআরের পক্ষে থাকা নুরও জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের সমাবেশে অংশ নিয়ে এই পদ্ধতির পক্ষে কথা বলেন। জামায়াতের সমাবেশে অংশ নিয়ে দ্রুততম সময়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনেরও দাবি জানান।

নুরের ঘনিষ্ঠজনরা বলছেন, নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি ও জামায়াতের নেতৃত্বে পৃথক জোট গঠনের তৎপরতা চলছে। এমন অবস্থায় জামায়াত আর ইসলামী আন্দোলনও তো সুযোগের অপেক্ষায় আছে। কাছে টানতে নুরের মাথায় তারা হাত বুলাচ্ছেন। ফলে নুরেরও তাদের দিকে কিছুটা ঝুঁকে পড়া অস্বাভাবিক নয়।

জানতে চাইলে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর কালবেলাকে বলেন, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে আমরা বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল একত্রে আন্দোলন করেছি। ইসলামী আন্দোলন যুগপতে ছিল না, তবে আন্দোলনে তারা তাদের মতো ভূমিকা পালন করেছে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়েছে। সব দলের সঙ্গেই আমাদের সুসম্পর্ক আছে, এই সুসম্পর্ক ও সমন্বয় রেখে আমরা এগিয়ে যেতে চাই।

তিনি বলেন, বিএনপি, জামায়াত কিংবা ইসলামী আন্দোলন—কারও সঙ্গেই এখনো আমাদের কোনো নির্বাচনী জোট হয়নি, এটা নিয়ে আলোচনাও হয়নি। আমরা মনে করি, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাজনীতিতে মানুষের মধ্যে একটা বিকল্প আগ্রহ বা প্রত্যাশা রয়েছে, সেই জায়গাটায় আমাদের একটা সম্ভাবনা রয়েছে। সুতরাং আমরা সেই জায়গাটা ধরতে চাই অর্থাৎ মানুষের সেই আকাঙ্ক্ষাটা পূরণ করতে চাই। সে কারণে আমরা নিজেদের একটা স্বতন্ত্র অবস্থান বজায় রেখে এগোচ্ছি। আগামীতে আমরা আমাদের দলীয় প্রতীকে (ট্রাক) তিনশ আসনে প্রার্থী দিয়ে নিজেদের জনপ্রিয়তা যাচাই এবং দলকে শক্তিশালী ও নেতৃত্ব তৈরি করতে চাই।

আগামী নির্বাচনে বিএনপি থেকে মনোনয়ন (ধানের শীষ) নিশ্চিত হলে নুরুল হক নুরের বিএনপিবিরোধী বর্তমান অবস্থানও পাল্টে যাবে—রাজনীতিতে এমন আলোচনা প্রসঙ্গে নুর বলেন, এটা একেবারেই অবাস্তব। কারণ, আমরা বিশেষ কোনো দলের বিরুদ্ধে কথা বলছি না। আমরা চাঁদাবাজি, দখল-বাণিজ্য তথা দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির বিরুদ্ধে কথা বলছি। এ ব্যাপারে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের সময়ও আমি সোচ্চার ছিলাম।

নুরুল হক নুর বলেন, নির্বাচনের পর বিএনপির জাতীয় সরকার গঠনের অঙ্গীকার রয়েছে। সেখানে আমাদের মতো গণঅভ্যুত্থানের গুরুত্বপূর্ণ স্টেকহোল্ডারদের বাদ দিয়ে বিএনপি সেই জাতীয় সরকার করলে সেটি কি গ্রহণযোগ্য হবে? এই পরিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ মাস্টারমাইন্ড তো আমরাই।

দলটির সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান কালবেলাকে বলেন, শেখ হাসিনার পতনের লক্ষ্যে তারা বিএনপির সঙ্গে রাজপথে দীর্ঘ আন্দোলনে ছিলেন। যুগপৎ কিংবা ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন তারা একই সঙ্গে করেছেন। সুতরাং আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিএনপির সঙ্গে তাদের এক ধরনের সম্পর্ক আছে। অনুরূপভাবে ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াই করতে গিয়ে জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও একটা সম্পর্ক রয়েছে। কারও সঙ্গেই তাদের বৈরিতা নেই। তবে কার সঙ্গে নির্বাচনী জোট হবে বা হবে না, নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পরই তারা মূলত সেই সিদ্ধান্ত নেবেন। যেহেতু এখন পর্যন্ত নির্বাচনী অনিশ্চয়তাই দূর হয়নি, নির্বাচনী জোট গঠন নিয়েও কারও সঙ্গে তাদের আনুষ্ঠানিক কোনো আলোচনা হয়নি। ৩০০ আসনেই তাদের নির্বাচনী প্রস্তুতি রয়েছে। সে লক্ষ্যে তারা কাজ করছেন। এর অংশ হিসেবে সম্প্রতি ৩৬ আসনে সম্ভাব্য দলীয় প্রার্থী নামও ঘোষণা করা হয়েছে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কোনো দলের প্রোগ্রামে যাওয়া মানেই তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক কিংবা নির্বাচনী জোট হয়ে গেছে, ব্যাপারটা এরকম না। জামায়াত তাদের প্রোগ্রামে (সমাবেশ) দাওয়াত দিয়েছে, ইসলামী আন্দোলনও দাওয়াত দিয়েছে। আমাদের প্রতিনিধি সেখানে গিয়েছে। তার মানে এই নয় যে, জামায়াত কিংবা ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে ‘নির্বাচনী জোট’ করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়েছে।

অন্য এক প্রশ্নের জবাবে রাশেদ খান বলেন, জামায়াতের সঙ্গে আমাদের দলের একটি প্রতিনিধিদল সম্প্রতি বৈঠক করেছিল। এরপর জামায়াত বিবৃতি দিয়ে বলেছিল যে, জামায়াত ও গণঅধিকার পরিষদ একসঙ্গে নির্বাচনী জোট গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এরপর আমাদের পক্ষ থেকে বিষয়টি জানালে জামায়াত ফের সংশোধিত বিবৃতি দেয়। সেখানে বলা হয়, ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে আগামী নির্বাচনে জোট গঠন নিয়ে গণঅধিকার পরিষদ ও জামায়াতের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। সুতরাং এটা নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির কিছু নেই।