Image description
মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি

মাইলস্টোন স্কুলের যেখানে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়েছিল, সেই ভবনের দেয়ালে এখনো পোড়া কালো ধোঁয়ার স্পষ্ট ক্ষত। সিঁড়ির করিডোরে বইখাতা, পানির বোতল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে ৯ দিন পরও। তালাবদ্ধ ভবনটির গ্রিলের ফাঁক গলে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দেয়ালের কোণে আধপোড়া একটি চেয়ারে চোখ আটকে গেল। সেখানে রাখা ফুলের দুটি তোড়া—একটি কালো কাগজে, অন্যটি সফেদ রঙের কাগজে মোড়ানো। আকাশ থেকে আছড়ে পড়া বিমানের আগুনের ঝাপটায় তারা হয়ে, ফুল হয়ে আকাশে চলে যাওয়া স্কুলশিশুদের জন্য এই ফুল, এই ভালোবাসা।

শিশুদের স্মরণে এখনো কোনো বেদি হয়নি; কিন্তু ক্ষত চেয়ারে বেদি তৈরি করে তাদের জন্য হৃদয় নিংড়ানো এই ভালোবাসা, এই স্মরণ আয়োজন কার—তা জানা গেল না। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে ঘটনাস্থল মাইলস্টোনের হায়দার আলী ভবনের সামনে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, দুই দিন আগে ভবনটি যখন খোলা ছিল, তখন কেউ কেউ এই ফুলের তোড়া দিয়ে প্রাণ হারানো শিক্ষার্থীদের স্মরণ করে গেছেন। এ অচেনা মানুষের ভালোবাসা।

ফুলের তোড়া রাখা চেয়ারের পাশেই হেলানো দেখা যায় ফায়ার এক্সটিংগুইশার। স্কুলের ছোট ছোট শিক্ষার্থী, শিক্ষক আর অভিভাবকদের প্রাণ কেড়ে নেওয়া আগুন যে সেদিন থামানো যায়নি, তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল অনেকটা অক্ষত অগ্নিনির্বাপক এই যন্ত্রটি দেখে। এর পাশেই পড়ে থাকা দুমড়েমুচড়ে যাওয়া সিলিং ফ্যান দেখে বোঝা যায়, সেদিন দুপুরে বিমান আছড়ে পড়ার ঝাপটাটা কত ভয়ংকর ছিল।

স্কুল শিক্ষক আর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২৬ শিশুশিক্ষার্থী আর শিক্ষক-অভিভাবকসহ ৩৫ জনকে হারানোর শোক বুকে নিয়েই তারা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। এত বড় ভয়াবহতার পর সব শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা আগের মতো স্বাভাবিক হতে পারছেন না। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম শুরুর আগেই তাদের মানসিক জোর ফিরিয়ে আনতে জোরালোভাবে কাউন্সেলিং কার্যক্রম চলছে। স্কুল কর্তৃপক্ষ চালু করেছে কাউন্সেলিং সেন্টার, যেখানে গতকাল পর্যন্ত ১৫২ জনকে কাউন্সেলিং করা হচ্ছে। তাদের মধ্যে ১১৩ জন শিক্ষার্থী। পাশাপাশি বিমানবাহিনীর পক্ষ থেকেও চিকিৎসা ক্যাম্প চালু করা হয়েছে।

কাউন্সেলিং সেন্টারের দায়িত্বরত একজন কর্মকর্তা জানান, তাদের এখন বড় কাজ হচ্ছে শিক্ষার্থীদের মনোবল ফিরিয়ে আনা। তারা সেই চেষ্টা করছেন। যারা সেদিন ঘটনাস্থলে ছিল, যেসব শিক্ষার্থী আটকে পড়েছিল, খুব কাছ থেকে বন্ধুদের মৃত্যু দেখেছে—তারা ট্রমায় রয়েছে। তাদের আতঙ্ক কাটানোর কাজ চলছে। পাশাপাশি হোস্টেলে থাকা এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা খুব কাছ থেকে দেখেছেন ঘটনাটা। তারাও মানসিকভাবে আহত। তাদেরও কাউন্সেলিং করা হচ্ছে। মাইলস্টোনের তিনজন মনোবিদ এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন মনোবিদ এই দায়িত্ব পালন করছেন।

ওই কর্মকর্তা জানান, বিমানবাহিনীর চিকিৎসা ক্যাম্পে শারীরিকভাবে আহতদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। সেখানে শারীরিক চিকিৎসা দেওয়ার সময়ে যদি কারও মধ্যে মানসিক সমস্যা দেখা দেয়, তাকে কাউন্সেলিং সেন্টারে পাঠানো হচ্ছে। একইভাবে কাউন্সেলিং নিতে আসা কারও যদি শারীরিক সমস্যা দেখা যায়, তাহলে তাকে বিমানবাহিনীর চিকিৎসা ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

ভয়াবহ ঘটনার ৯ দিন পর গতকাল ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, এখনো সেখানে বুকে শোক নিয়ে আসছেন সাবেক-বর্তমান শিক্ষার্থীরা, অভিভাবকরা। সাধারণ মানুষের ভিড়ও রয়েছে সেই ভবনের সামনে। কেউ চোখের পানি মুছছেন, কেউ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়েন। প্রত্যক্ষদর্শীদের কেউ কেউ এখনো নিজেদের মতো করে সেই ভয়াবহ ২১ জুলাই দুপুরের বিবরণ দেন।

সেদিন বিধ্বস্ত বিমানের আগুনের ঝাপটা লেগেছিল তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র আহসান হাবিবের শরীরেও। দুই বাহুতে পোড়া ক্ষত নিয়ে গতকাল সে বাবা মুজিবুল হক ও মা ফারিয়া সুলতানার সঙ্গে এসেছিল প্রিয় ক্যাম্পাসে। ঘটনাস্থল দেখে শিশুটি অনেকটা কুঁকড়ে যাচ্ছিল।

বাবা মুজিবুল হক জানান, সেদিনের পর সবকিছু ঠিকঠাক, তা বোঝাতে ছেলেকে নিয়ে ঘটনাস্থলে এসেছিলেন। কিন্তু সে এসে দেখাচ্ছিল কোন কক্ষটাতে আটকা পড়েছিল, কীভাবে উদ্ধার হলো। ওকে বাসায় বারবার বোঝানোর চেষ্টা করা হয়, কিচ্ছু হয়নি! কিন্তু ও তার বন্ধুদের কথা জানতে চায়।

সেদিন সপ্তম শ্রেণির ছাত্র আবদুল্লাহ আল মাহির ছিল পাশের ভবনেই। সে বলে, বিমানটা দেখলাম মাঠের নিচের দিকেই ঘুরছে। হঠাৎ করেই সেটি হায়দার আলী ভবনের সামনে পড়ে আগুন ধরে গেল! তাদের অনেকে দৌড়ে এলেও দাউদাউ আগুনের তাপে কেউ কাছে যেতেই পারছিল না। সেদিনের কথা মনে পড়লে ভয় লাগে।

২১ জুলাই বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান উত্তরার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের হায়দার আলী ভবন নামে স্কুল ভবনের গেটের সামনে আছড়ে পড়ে। এতে অনেক শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবক অগ্নিদগ্ধ হন। তাদের মধ্যে গতকাল পর্যন্ত ৩৫ জন মারা গেছেন। এ ছাড়া জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ৩৩ জন ভর্তি রয়েছে। যাদের মধ্যে ২৭ জনই শিশু। তাদের মধ্যে সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে ৩ জন। যাদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া সিভিয়ার ক্যাটাগরিতে রয়েছে ৯ জন।

এদিকে, ওই দুর্ঘটনায় নিহত শিক্ষার্থী সায়ান ইউছুপের কবর জিয়ারত ও শ্রদ্ধা জানিয়েছে বিমানবাহিনী। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার বশিকপুর ইউনিয়নের বশিকপুর গ্রামের সায়ানের বাড়িতে যায় বিমানবাহিনীর ১৩ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল। ওই সময় তারা নিহতের কবর জিয়ারত ও পুষ্পস্তবক অর্পণ করে সায়ানের আত্মার শান্তি কামনায় বিশেষ দোয়া করেন। পরে প্রতিনিধিদলটি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে।