
বিচার বিভাগের পদ সৃজনের ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতির নেতৃত্বাধীন কমিটির হাতে ন্যস্ত করে বিধিমালা জারি করা হয়েছে। কমিটিতে জনপ্রশাসন, অর্থ ও আইন মন্ত্রণালয়ের সচিবকে প্রতিনিধি রাখতে হবে। এ ছাড়া জুডিসিয়াল সার্ভিস গঠন বিধিমালা-২০২৫ নামে জারি করা এই বিধিমালায় জুডিসিয়াল সার্ভিসের বিচারিক ও প্রশাসনিক পদগুলোকে ‘ক্যাডার’ পদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। পাশাপাশি সার্ভিসের পদগুলোকে রাজস্ব খাতে স্থায়ীভাবে সৃজনেরও বিধান করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আগে যে কোনো বিচারকি পদ সৃজন হতো প্রাথমিকভাবে তিন বছরের জন্য। পরে তা ধীরে ধীরে জনপ্রশাসনসহ অন্যদের অনুমোদনের ভিত্তিতে স্থায়ী হতো। কিন্তু এখন বিচারকদের যে কোনো পদ সৃজন হবে স্থায়ীভাবে। ফলে বিচারকদের পদ সৃজনের জন্য এখন থেকে বিচার বিভাগকে আর প্রশাসনের দ্বারস্থ হতে হবে না। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে আইন ও বিচার বিভাগ থেকে গত সোমবার রাতে এই বিধিমালা জারি করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিচার বিভাগকে পৃথককরণ সংক্রান্ত ঐতিহাসিক মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে এই বিধিমালা জারি করা হয়েছে। ওই রায়ে বিচারকর্ম বিভাগকে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে অন্তর্ভুক্ত করাকে সংবিধান পরিপন্থি ঘোষণা করা হয়। রায়ে জুডিসিয়াল সার্ভিসকে একটি স্বতন্ত্র সার্ভিস হিসেবে গড়ে তোলার নির্দেশনা দেওয়া হয়। পাশাপাশি দেশে ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় জুডিসিয়াল সার্ভিসকে রাষ্ট্রের অন্যান্য সার্ভিস থেকে উন্নত হিসেবে গড়ে তোলারও বিধান রয়েছে ঐতিহাসিক ওই রায়ে। রায়ে বলা হয়, ‘তেল জলে যেমন মেশে না, তেমনি বিচার বিভাগকে প্রশাসনের সঙ্গে মেশানো যাবে না।’ এ ছাড়া সংবিধানের ১১৫ অনুচ্ছেদে বিচার বিভাগে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের বিষয়ে পৃথক বিধিমালা তৈরির ক্ষমতা রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া হয়েছে। মাসদার হোসেন মামলার রায় ও সংবিধানের আলোকে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস গঠন বিধিমালা-২০২৫ জারি করা হয়েছে।
বিধিমালার ৫ বিধিতে এই সার্ভিসের পদ সৃজন বিষয়ে বলা হয়েছে। ৫(১) উপবিধি অনুসারে, বিচারিক পদ সৃজনের ক্ষেত্রে আপিল বিভাগের কর্মে জ্যেষ্ঠ বিচারপতির সভাপতিত্বে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন, হাইকোর্ট বিভাগের দুজন বিচারপতি, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, অর্থ বিভাগ এবং আইন ও বিচার বিভাগের সচিব/সিনিয়র সচিবদের সমন্বয়ে বিচারিক পদ সৃজন কমিটি গঠিত হবে। ওই পদ সৃজনের ক্ষেত্রে কমিটির সুপারিশ চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। ৫(২) উপবিধিতে বলা হয়েছে, সার্ভিসের পদ সৃজনের ক্ষেত্রে বিচারিক পদ সৃজনের ক্ষেত্রে বিচারিক পদ সৃজন কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নে আইন ও বিচার বিভাগ রাষ্ট্রপতির কাছে সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করবে এবং অনুমোদিত সারসংক্ষেপ অনুযায়ী চূড়ান্ত আদেশ জারি করবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আগে বিচার বিভাগের পদ সৃজনের জন্য প্রথমে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হতো। জনপ্রশাসনের অনুমোদনের পর তা অর্থ মন্ত্রণালয়ে এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর তা সচিব কমিটির অনুমোদনের প্রয়োজন হতো। সচিব কমিটির অনুমোদনের পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হয়ে এটি চূড়ান্ত হতো। আর এই দীর্ঘ প্রক্রিয়া পার হতে মাসের পর মাস এমনকি বছর পেরিয়ে যেত। ফলে বিচারক শূন্যতায় বিচার কাজ ব্যাহত হতো। এ ছাড়া প্রশাসনের হাতে পদ সৃজনের ক্ষমতা থাকায় কোনো আদালতের জন্য পদ সৃজনের প্রয়োজন, কতটি পদ সৃজনের প্রয়োজন তা নির্ধারণ কঠিন ছিল। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন বিচারপতির নেতৃত্বাধীন কমিটির হাতে এই ক্ষমতা আসায় এসব সমস্যা দূর হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিধিমালার ৩ ধারায় জুডিসিয়াল সার্ভিস গঠনের ব্যাপারে বলা হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, সংবিধানের স্বীকৃতমতে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস নামে একটি স্বতন্ত্র সার্ভিস গঠন করা হবে। ৩ ধারার (৩) উপধারায় বলা হয়েছে, এই সার্ভিস নিম্নবর্ণিত ব্যক্তিগণের সমন্বয়ে গঠিত হবে, যথা—(ক) বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস (সার্ভিস গঠন, সার্ভিস পদে নিয়োগ এবং সাময়িক বরখাস্তকরণ, বরখাস্তকরণ ও অপসারণ) বিধিমালা, ২০০৭-এর অধীন গঠিত বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিসে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ; এবং (খ) যারা সার্ভিসে নিযুক্ত হবেন। বিধিমালার ৪ ধারায় সার্ভিসে অন্তর্ভুক্ত পদগুলোর ব্যাপারে বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, তপশিলে উল্লিখিত পদ হবে সার্ভিসে ক্যাডারের পদ। (২) সার্ভিসের পদগুলো রাজস্ব খাতে স্থায়ীভাবে সৃজন করা হবে। বিধিমালার সঙ্গে যুক্ত করা তপশিলে জুডিসিয়াল সার্ভিসে বর্তমানে কর্মরত ১৮১৯টি বিচারিক পদ এবং ১২০টি প্রশাসনিক পদ রয়েছে। বিধিমালায় এগুলোকে ক্যাডার পদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিচার বিভাগের সংশ্লিষ্টরা জানান, এর আগে জুডিসিয়াল সার্ভিসের সদস্যরা বিসিএস ক্যাডারভুক্ত ছিলেন। ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর বিচার বিভাগ পৃথককরণের পর তৈরি করা জুডিসিয়াল সার্ভিস বিধিমালায় ক্যাডার শব্দ বাদ পড়ে যায়। শুধু জুডিসিয়াল সার্ভিসের সদস্য উল্লেখ থাকায় বিচারকরা বিদেশে স্কলারশিপ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছিলেন। এ ছাড়া মাসদার হোসেন মামলার রায়ে জুডিসিয়াল সার্ভিসকে উন্নত সার্ভিস হিসেবে গড়ে তোলার কথা বলা হলেও ক্যাডার শব্দ না থাকায় দুর্বল সার্ভিস হিসেবে বিবেচিত হচ্ছিল। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল জুডিসিয়াল (কন্ডিশন অব সার্ভিস) রুলস-২০০৪-এ বিচারকদের ক্ষেত্রে ক্যাডার শব্দের ব্যবহার করা হয়েছে। এজন্য বিধিমালায় জুডিসিয়াল সার্ভিস সদস্যদের ক্যাডার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্যাডারপদ স্থায়ীভাবে সৃজন করা হয়েছে। এতে করে জুডিসিয়াল সার্ভিসের বিভিন্ন পদ সৃজন এখন থেকে আর অস্থায়ীভাবে হবে না। এ ছাড়া আগে বিচারকদের বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে প্রেষণে নিয়োগ করা হতো। কিন্তু প্রশাসনিক পদগুলো এখন বিচার বিভাগের জন্য নির্দিষ্ট পদ হিসেবে বিধিমালায় উল্লেখ করায় বিচারকদের আর প্রেষণে নিয়োগ করতে হবে না বলেও জানা গেছে।
‘আইন ও বিচার বিভাগে পদায়ন বিধিমালা-২০২৫’
গত সোমবার রাতে আইন ও বিচার বিভাগে পদায়ন বিধিমালা নামে আরও একটি বিধিমালা জারি করা হয়েছে। এতে আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের বিভিন্ন পদে নিয়োগে বিচারকদের মধ্য থেকে ৭৫ ভাগ নিয়োগের বিধান করা হয়েছে। বিধিমালার ৪ ধারায় আইন ও বিচার বিভাগে নিয়োগের পদ্ধতি উল্লেখ করা হয়েছে। ৪ বিধির (১) উপধারায় বলা হয়েছে, এই বিধিমালার তপশিলে বর্ণিত নিয়োগ পদ্ধতি অনুসরণে এবং প্রয়োজনীয় যোগ্যতার ভিত্তিতে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিসের সদস্যদের আইন ও বিচার বিভাগের বিভিন্ন পদে নিয়োগ করতে হবে। (২) উপবিধি (১)-এর বিধান সত্ত্বেও সহকারী সচিব, সিনিয়র সহকারী সচিব, উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিবের ২৫ শতাংশ পদে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিসের সদস্যবহির্ভূত সহকারী সচিব, সিনিয়র সহকারী সচিব, উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিবদের মধ্য হতে নিয়োগ করা যাবে: তবে শর্ত থাকে যে, উপবিধি (২)-এর অধীন নিয়োগের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কর্তৃক আদেশ জারির পূর্বে আইন ও বিচার বিভাগের সম্মতি গ্রহণ করতে হবে।
৫ ধারায় নিয়োগের আদেশ জারির ব্যাপারে বলা হয়েছে। উপধারা (১)-এ বলা হয়েছে, এই বিধিমালা অনুসারে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিসের সদস্যদের মধ্য থেকে সহকারী সচিব, সিনিয়র সহকারী সচিব, উপসচিব, উপসলিসিটর, যুগ্ম সচিব, সলিসিটর পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে আইন ও বিচার বিভাগ, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং প্রয়োজনীয় আদেশ জারি করবে। উপধারা (২)-এ বলা হয়েছে, অতিরিক্ত সচিব এবং সচিব পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনক্রমে আইন ও বিচার বিভাগ প্রয়োজনীয় আদেশ জারি করবে। এতে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রথম শ্রেণির পদে নিয়োগের নীতিমালা, ২০০১ রহিত করা হয়েছে।
জানা গেছে, প্রথম শ্রেণির পদে নিয়োগের নীতিমালা, ২০০১ বাতিল করে ২০০৭ সালের ২৯ নভেম্বর প্রজ্ঞাপন জারি করে। এতে করে বিচারকদের আইন মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পাওয়ার পথ বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। তখন জেলা জজ মো. আফতাব উদ্দিন ২০০১ সালের ওই নীতিমালা বাতিলের দাবিতে হাইকোর্টে রিট করেন। এ রিট মামলায় প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, ২০০১ সালের ওই নীতিমালায় আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব পদসহ আইন ও বিচার বিভাগের প্রথম শ্রেণির সব পদের মধ্যে ৭৫ শতাংশ পদ বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের জন্য সংরক্ষণ করা হয়। কিন্তু সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা কাজী হাবিবুল আউয়াল আইন সচিব থাকাবস্থায় ২০০১ সালের ওই নীতিমালা বাতিল করেন। হাইকোর্ট নীতিমালাটি বিশেষ উদ্দেশ্যে বাতিল করা হয়েছে মর্মে রায় দিয়ে নীতিমালাটি বহাল করেন। পরে আপিল বিভাগ ২০০৯ সালে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন। একই সঙ্গে নীতিমালার আলোকে একটি আইন করার কথা বলেন। আইন না হওয়া পর্যন্ত নীতিমালাটি বহাল রাখা হয়। রায়ের ওই পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী সোমবার এই পদায়ন বিধিমালা জারি করেছে বলে সূত্র জানায়।
এ বিষয়ে জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক মহাসচিব, সাবেক সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মো. শাহজাহান সাজু বলেন, বিচার বিভাগের পদ সৃজনের ক্ষমতা বিচার বিভাগের হাতে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে পদ সৃজনের স্বাধীনতাসহ আরও অনেক ক্ষেত্রে স্বাধীনতা থাকার কথা। কিন্তু বিচার বিভাগ আজও সবক্ষেত্রে স্বাধীন হয়নি। ধীরে হলেও পদসৃজনের স্বাধীনতা সুপ্রিম কোর্টের হাতে এসেছে। এতে করে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে পদ সৃজন করতে পারবে, বিচার বিভাগের কাজে গতি আসবে। সরকারের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। এ বিষয়ে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের বর্তমান মহাসচিব মুহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘বিচারিক পদ সৃজনের ক্ষেত্রে কমিটি গঠন বিধিমালাটির অন্যতম উল্লেখযোগ্য একটি দিক। অধস্তন আদালতের বিচারিক পদ সৃজনের ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক যে জটিলতা ছিল, তা এই বিধিমালার মাধ্যমে দূর হবে বলে মনে করি। জুডিসিয়াল সার্ভিস গঠন বিধিমালা ২০২৫ বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক উৎকর্ষে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে।’