
পুলিশ বাহিনীর ওপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগ নতুন নয়। নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি থেকে শুরু করে নানা ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবের অভিযোগ থাকলেও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি এত দিন। এবার সেই কাঠামো ভাঙতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করতে যাচ্ছে ‘স্বাধীন পুলিশ কমিশন’, যা নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে ৩৩টি রাজনৈতিক দল।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ডাকে আয়োজিত দ্বিতীয় দফার সংলাপের ১৯তম দিনে কমিশনের সদস্য, বিশিষ্ট নাগরিক ও রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা এ বিষয়ে একমত হন।
আইনি কাঠামোর প্রশ্নে সংবিধিবদ্ধ কমিশনের পক্ষে মত : বর্তমানে দেশে তিন ধরনের কমিশন বিদ্যমান—সাংবিধানিক, সংবিধিবদ্ধ ও সরকারি। পাবলিক সার্ভিস কমিশন, নির্বাচন কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠান সাংবিধানিক কমিশন হিসেবে বিবেচিত।
বিশেষজ্ঞদের মত, প্রস্তাবিত পুলিশ কমিশনটি সংবিধিবদ্ধ কমিশন হিসেবেই গঠন করা উচিত। এতে আইন প্রণয়ন করে কমিশনের স্বাধীনতা ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করা যাবে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কামাল উদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘আইনের মাধ্যমে স্বশাসিত, স্বাধীন ও জবাবদিহিমূলক কমিশন গঠন জরুরি। এতে পুলিশের পেশাদারি বাড়বে এবং জনগণের আস্থা ফিরে আসবে।
রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের সংস্কৃতি ভাঙতে হবে : বর্তমান ব্যবস্থায় পুলিশে নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব সুস্পষ্ট। অনেক সময় জেলায় এসপি হিসেবে কাকে নিয়োগ দেওয়া হবে, তা রাজনৈতিক নেতাদের ‘পরামর্শে’ নির্ধারিত হয়। এতে দক্ষ, সৎ ও পেশাদার কর্মকর্তারা পিছিয়ে পড়েন। এ প্রসঙ্গে কয়েকজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থাকায় পুলিশকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে না পারার চাপ সহ্য করতে হয়। এর প্রভাব পড়ে জনগণের ওপর।
সাবেক ডিআইজি ড. মো. মতিয়ার রহমান বলেন, ‘পুলিশের প্রতি জনগণের আস্থা অনেকটা নড়বড়ে হয়ে গেছে। এ বাহিনীর কাজের প্রতি নিরপেক্ষ নজরদারি নিশ্চিত করতে স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে।’
পুলিশ সদর দপ্তরের প্রস্তাবে কী আছে
পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পাঠানো প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ১১ সদস্যের একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের মাধ্যমে পুলিশ বাহিনীর শীর্ষ পদগুলোতে নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ও অভিযোগ নিষ্পত্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব কমিশনের হাতে ন্যস্ত করা হবে।
কমিশনের সদস্যদের মধ্যে থাকবেন চারজন সংসদ সদস্য (সরকারি ও বিরোধী পক্ষ থেকে মনোনীত); একজন আইন বিশেষজ্ঞ; একজন মানবাধিকারকর্মী; একজন সমাজবিজ্ঞানী বা পুলিশিং বিশেষজ্ঞ; একজন অবসরপ্রাপ্ত আইজিপি; স্বরাষ্ট্রসচিব (পদাধিকারবলে) ও আইজিপি (সদস্যসচিব)।
এই কমিশনের কাজ হবে নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে নীতিমালা প্রণয়ন; পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত ও নিষ্পত্তি; শৃঙ্খলা ও আচরণবিধির কার্যকর প্রয়োগ; দুর্নীতি প্রতিরোধে জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ; বার্ষিক প্রতিবেদন সংসদে উপস্থাপন এবং আইন ও নীতির সংস্কারে পরামর্শ প্রদান।
ঐকমত্য কমিশনের বিকল্প প্রস্তাব
ঐকমত্য কমিশনও একটি বিস্তারিত প্রস্তাব দিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, পুলিশ যেন নিরপেক্ষ, স্বাধীন ও মানবাধিকারের প্রতি প্রতিশ্রুতিশীল থাকে তা নিশ্চিত করাই এই কমিশনের মূল লক্ষ্য। প্রস্তাব অনুযায়ী, কমিশনের চেয়ারম্যান হবেন আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি বা একজন সাবেক আইজিপি। প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী নেতার পরামর্শে সংসদ সদস্যদের মনোনয়ন দেবেন স্পিকার।
কমিশনের বিশেষজ্ঞ সদস্যদের মধ্যে একজন নারী থাকা বাধ্যতামূলক। বাছাই কমিটি এই সদস্যদের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করবে। এই কমিটিতে থাকবেন প্রধান বিচারপতি (অথবা মনোনীত বিচারপতি), দুদক, মহা হিসাব নিরীক্ষক, মানবাধিকার কমিশনের প্রধান এবং একজন অবসরপ্রাপ্ত সচিব বা আইজিপি।
এই প্রস্তাবে আইজিপি নিয়োগের জন্য কমিশন রাষ্ট্রপতির কাছে তিনজনের একটি প্যানেল দেবে। আইজিপির কার্যকাল হবে দুই থেকে তিন বছর এবং প্রয়োজনে কমিশনের সুপারিশে তাঁকে অপসারণ করাও সম্ভব হবে। একইভাবে ডিআইজি, মেট্রোপলিটন কমিশনার, এসপি—সব গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী হবে।
প্রস্তাব অনুযায়ী, প্রতিটি নিয়োগ দুই বছরের জন্য হবে এবং পুনর্নিয়োগ বা বদলি কমিশনের অনুমোদন সাপেক্ষে হতে হবে। এ ছাড়া পুলিশসংক্রান্ত আইন ও নীতিমালাও কমিশন প্রণয়ন করবে।
অভিযোগ ব্যবস্থাপনা ও প্রতিকার কাঠামো
প্রস্তাবে পৃথক দুটি কমিটি গঠনের কথাও বলা হয়েছে—একটি পুলিশবিরোধী অভিযোগের আপিল শুনানির জন্য এবং অন্যটি পুলিশ সদস্যদের অভিযোগ প্রতিকারের জন্য। এতে পুলিশ বাহিনীর ভেতরে ও বাইরে দুই দিক থেকেই জবাবদিহির পরিবেশ তৈরি হবে।
আইজিপি বাহারুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন হলে পুলিশের স্বাধীনতা, পেশাদারি ও জনসেবার মান আরো বাড়বে। এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।’
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রধান ড. আলী রীয়াজ বলেন, ‘পুলিশ সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে ঐকমত্য তৈরি হয়েছে, তা অত্যন্ত ইতিবাচক। এখন প্রয়োজন দ্রুত আইন পাস করে বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যাওয়া।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই কমিশন যদি সত্যিকারের স্বাধীনতা ও কার্যকারিতা নিয়ে গঠিত হয়, তবে তা হবে দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠার এক নতুন মাইলফলক।