
তিস্তা সেচ প্রকল্পের ৮০০ কোটি টাকার কাজ বাকি রেখে উধাও হয়েছেন ১৬ ঠিকাদার । তাঁরা কাজ না করে আগেভাগে বিল তুলে ৫ আগস্টের পর থেকে পলাতক । ফলে রংপুর , নীলফামারী , গাইবান্ধা , দিনাজপুর , জয়পুরহাট এবং বগুড়ায় সেচের সুবিধার্থে নেওয়া এ প্রকল্পের তিনটি সেক্টরের মধ্যে একটির কাজ বন্ধ রয়েছে । বাকি দুই সেক্টরের ঠিকাদারেরা কাজ করলেও সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন অনিশ্চয়তায় পড়েছে । ৫ হাজার ৭৯১ কোটি টাকার আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়া চার লেন সড়ক প্রকল্পের কাজ এক বছর ধরে বন্ধ রয়েছে ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এফকনস ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড জুলাই অভ্যুত্থানের পর ভারতে ফিরে যাওয়ায় ।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলেছে , শুধু এই দুই প্রকল্পই নয় , চারটি মন্ত্রণালয়ের প্রায় ৬০ টি প্রকল্পের ঠিকাদারেরা বরাদ্দের টাকা তুলে নিয়ে কাজ না করে ৫ আগস্টের পর গা ঢাকা দিয়েছেন । এমন শতাধিক ঠিকাদার নিয়েছেন প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা । এই চার মন্ত্রণালয় হলো স্থানীয় সরকার , গৃহায়ণ গণপূর্ত , সড়ক ও সেতু এবং রেলপথ । এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ( সিপিডি ) বিশেষ ফেলো ড . দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আজকের পত্রিকাকে বলেন , বিগত সরকার ( আওয়ামী লীগ সরকার ) এমন ঠিকাদারদের প্রকল্প দিয়েছে , যাঁরা পেশাদার ঠিকাদার নন ।
দেখা যাবে, তাঁরা প্রকল্প নেওয়ার পর অর্থের বিনিময়ে হাতবদল করেছেন । তিনি বলেন , কাজ না করলেও ঠিকাদারদের প্রকল্প থেকে অর্থ দিয়ে যাঁরা অন্যায় করেছেন , তাঁদেরকেও শাস্তির আওতায় আনা উচিত । সূত্র বলেছে , দেশে ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প চলমান । প্রকল্পগুলোতে সরকারের ও বিদেশি অর্থায়ন রয়েছে ।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ ( আইএমইডি ) বলছে, এ প্রকল্পগুলোর মধ্যে ১০ টি মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পের অগ্রগতির পাশাপাশি প্রকল্পের সার্বিক বিষয় নিয়ে তারা কাজ করছে । এর মধ্যে চারটি মন্ত্রণালয়ের প্রায় ৬০ প্রকল্পের ঠিকাদারেরা প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা নিয়ে পালিয়েছেন । ঠিকাদার না থাকায় এসব প্রকল্পের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে । এতে একদিকে সরকারের অর্থের অপচয় হচ্ছে , অন্যদিকে জনগণের ভোগান্তি বাড়ছে ।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের ১০ টি প্রকল্পের ঠিকাদারেরা ৩৩০ কোটি টাকা তুলে লাপাত্তা । গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ১৪ টি প্রকল্পের ঠিকাদারেরা ৩২৯ কোটি ২৩ লাখ টাকা নিলেও কাজ করছেন না । সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক ও জনপথ বিভাগের ৬৭১ কোটি ৫২ লাখ এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের ১৬১ কোটি ২১ লাখ টাকা নিয়ে কাজ ফেলে উধাও ঠিকাদারেরা । এসব ঠিকাদার লাপাত্তা হওয়ায় প্রকল্পগুলোর কাজও স্থবির রয়েছে । কাজ বন্ধ থাকা প্রকল্পগুলোর ঠিকাদারদের মধ্যে বিদেশি ঠিকাদারও রয়েছেন । তাঁদের মধ্যে ভারতীয়ই বেশি । আবার লাপাত্তা থাকা দেশি ঠিকাদারদের মধ্যে আওয়ামী লীগের সমর্থক ও দলটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ঠিকাদারের সংখ্যা বেশি ।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ফাহিমুল ইসলাম বলেন, অনেক প্রকল্পের ঠিকাদারদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না । ফলে প্রকল্পের কাজ ব্যাহত হচ্ছে । স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা , পরিবীক্ষণ , মূল্যায়ন ও পরিদর্শন অনুবিভাগের মহাপরিচালক মাহমুদুল হাসান আজকের পত্রিকাকে বলেন , “ আমাদের মন্ত্রণালয়ের দুই শতাধিক প্রকল্প রয়েছে । ৫ আগস্ট- পরবর্তী সময়ে প্রথম দিকে ঠিকাদার পাওয়া যাচ্ছিল না । তবে ৩-৬ মাস পর অনেকে ফিরেছেন । আবার কেউ কেউ অন্য ঠিকাদারদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছেন । যাঁদের একান্তই পাওয়া যায়নি, তাঁদের বাদ দিয়ে নতুন করে দরপত্র দেওয়া হয়েছে । '
তিনি বলেন, ‘ আমাদের প্রকল্পগুলো বড় । এখানে অনেক ঠিকাদার রয়েছেন । তাঁদের কতজন পলাতক , সে তথ্য আমার কাছে নেই । ” পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আইএমইডির তথ্যমতে , ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রকল্পের কাজ পেয়েছে হাতে গোনা চার - পাঁচটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান । একইভাবে স্থানীয় সরকার , রেলপথ , আইসিটিসহ অধিকাংশ মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পে ঠিকাদার নিয়োগ পেয়েছেন নির্দিষ্ট ব্যক্তিরা । তাঁদের কেউ কেউ সরকারদলীয় রাজনীতিক হওয়ায় কার্যাদেশ পেয়ে টাকার বিনিময়ে কাজ বিক্রি করে দেন । আবার কিছু ঠিকাদার বেশি প্রকল্প বাগিয়ে নেওয়ায় সঠিক সময়ে কাজ শেষ করতে পারেননি । পটপরিবর্তনের পর কাজ অসমাপ্ত রেখেই লাপাত্তা হয়েছেন তাঁরা ।
আইএমইডির সচিব মো . কামাল উদ্দিন বলেন, নিয়মিত কার্যক্রম হিসেবে প্রকল্পগুলো পরিদর্শন করা হয়েছে । এর মধ্যে চারটি মন্ত্রণালয়ের বেশ কিছু প্রকল্পের ঠিকাদার কাজ ফেলে রেখে পালিয়েছেন । বাকিগুলোর তথ্য দ্রুত সংগ্রহ করা হচ্ছে । এগুলো পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়কে দেওয়া হবে । সূত্র বলেছে , ২০২৫-২৬ অর্থবছরের শুরু থেকে ঠিকাদার লাপাত্তা হওয়া প্রকল্পগুলোর কাজ আবার শুরুর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার ।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে , ঠিকাদার চলে যাওয়ায় বন্ধ প্রকল্পগুলোর জন্য আবার দরপত্র আহ্বান করতে হবে । কাজ বন্ধ থাকায় এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হবে না । এদিকে প্রকল্পগুলো নির্ধারিত সময়ে শেষ করার লক্ষ্যে গতকাল মঙ্গলবার ৫৮ টি মন্ত্রণালয়কে উধাও হওয়া ঠিকাদার ও প্রকল্প পরিচালকদের তথ্য জানাতে চিঠি দিয়েছে আইএমইডি । চিঠিতে আগামী ১০ কার্যদিবসের মধ্যে তথ্য জানাতে বলা হয়েছে । জানতে চাইলে অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড . ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন , ‘ প্রতিটি প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ করতে প্রধান উপদেষ্টা নির্দেশনা দিয়েছেন । আমরা সে নির্দেশনা পালন করছি । এর অংশ হিসেবে আইএমইডিকে দ্রুত সারা দেশে কী পরিমাণ প্রকল্পে ঠিকাদার নেই , তা জানানোর জন্য বলা হয়েছে । পলাতক ঠিকাদার ও প্রকল্প পরিচালকদের দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে । ’