
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সচিব ফখরুল ইসলামের পিএইচডি থিসিসের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তার বিরুদ্ধে প্লেজিয়ারিজম বা চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ তোলা হয়েছে।
অভিযোগে বলা হয়েছে, ফখরুল ইসলাম বিভিন্ন সূত্র থেকে কপি করে গবেষণাপত্র বানিয়েছেন। এক উইকিপিডিয়া থেকেই তিনি ১৮ শতাংশ তথ্য নিয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও শিক্ষা উপদেষ্টা বরাবর ফখরুল ইসলামের নামে অভিযোগ দিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মতিউর রহমান।
২০১৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করেন ফখরুল ইসলাম। তার বিষয় ছিল উনিশ শতকে বাংলা নাটকে শেক্সপিয়রের প্রভাব।
প্লেজিয়ারিজম (চৌর্যবৃত্তি) চেকার টার্নিটিন ব্যবহার করে দেখা গেছে, ফখরুল ইসলামের মোট তথ্যের ৯৬ শতাংশই অন্য লেখার সঙ্গে মিল পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৭৬ শতাংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব প্রকাশনার সঙ্গে মিল রয়েছে। এ ছাড়া ১৮ শতাংশ নেওয়া হয়েছে উইকিপিডিয়া থেকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গবেষণাপত্রে এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্লেজিয়ারিজম চেকের কাজ করেন এমন এক উপ-গ্রন্থাগারিক জানিয়েছেন, যেহেতু এটি ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয়েছে, ফলে পরে চেক করা হলে তার নিজের প্রকাশিত লেখাই আগের লেখার সঙ্গে মিল ধরা হবে।
তবে উইকিপিডিয়া থেকে নেওয়া ১৮ শতাংশ সমস্যাজনক বলে উল্লেখ করেন তিনি। তিনি বলেন, আমরা ওভারঅল ২০ পর্যন্ত শতাংশ পর্যন্ত অনুমতি দিই। প্রত্যেকটি সোর্স থেকে ১ থেকে ২ শতাংশ পর্যন্ত অনুমোদন দিই। এভাবে ওভারঅল ২০ শতাংশ হয়ে যায়। কিন্তু উইকিপিডিয়া থেকে ১৮ শতাংশ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
তিনি আরও বলেন, একটি সোর্স থেকে এত বেশি নিয়ে কোনোভাবেই প্রকাশ করা যায় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৭ সালে প্লেজিয়ারিজম চেক করা শুরু হয়। ২০১৩ সালে প্লেজিয়ারিজম ধরার কোনো ব্যবস্থা ছিল না বলেই তা প্রকাশ করতে পেরেছে।
পরীক্ষায় ২০ শতাংশের বেশি উদ্ধৃতিহীন লেখা পেলে কী করা হয়- জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি পুনরায় লেখকের কাছে পাঠানো হয়। তিনি তা ঠিক করেন। কয়েকবার করে ফেরত পাঠানোর নজিরও আছে।
ফখরুল ইসলামের ‘ইমপ্যাক্ট অব শেক্সপিয়র অন দ্য রাইস অব মর্ডান বাংলা প্লেইস নাইনটিন্থ সেঞ্চুরি’ শিরোনামে পিএইচডি থিসিসের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম।
গত মার্চে তার এই লেখার মান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মতিউর রহমান। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও শিক্ষা উপদেষ্টা বরাবর ফখরুল ইসলামের নামে অভিযোগ করেন।
অভিযোগে তিনি বলেন, প্লেজিয়ারিজম চেকার টুল টার্নিটিন ব্যবহার করে দেখা যায়, গবেষণার ৯৬ শতাংশই চুরি করা। এরমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব রিসোর্স থেকে ৭৮ শতাংশ নেওয়া হয়েছে। এই পিএইচডি ডিগ্রি দেখিয়ে সচিব ফখরুল নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন। অতিরিক্ত পরিচালক ও পরিচালক পদে দুই দফায় পদোন্নতিসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন তিনি, যা সুস্পষ্টভাবে বিধি লঙ্ঘন বলে দায়ের করা অভিযোগে উল্লেখ করেন অধ্যাপক মতিউর রহমান।
অভিযোগে তিনি আরও উল্লেখ করেন, সচিব ফখরুল ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের ক্ষমতাধর কর্মকর্তা হিসেবে নিজেকে জাহির করেছেন ইউজিসিতে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ফখরুল ইসলাম বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব নিয়ম-নীতি ও বিধি-বিধান যথাযথভাবে অনুসরণ করে আমি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছি। আমি ডিগ্রি অর্জন করি ২০১৩ সালে। ডিগ্রি অর্জনের এত বছর পর টার্নিটিন ব্যবহার করে যে অসত্য, বানোয়াট ও দুরভিসন্ধিমূলক বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে তা আমার বোধগম্য নয়।
তিনি বলেন, ডোমেইনে প্রকাশিত প্রবন্ধ, নিবন্ধ, গবেষণার কর্মকাণ্ডের সফটকপি যুক্ত হচ্ছে। এর ফলে একই রকম শব্দ, প্রেসেস, ব্যাখ্যা ও কোটেশন ইত্যাদির অবিরাম সংযোজন ঘটছে। এর ওপর ভিত্তি করে কোনোভাবেই বলা যায় না যে, এই পিএইচডি থিসিসে চৌর্যবৃত্তি ঘটেছে। বরং রেফারেন্সিং, সাইটেশন ও ইনডেক্সিং নিয়মমাফিক করা হয়েছে কিনা, তা বিশেষজ্ঞ দ্বারা পর্যালোচনার বিষয়।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ইউজিসিতে পরিচালক হিসেবে তার চেয়ে জ্যেষ্ঠ পরিচালক ড. শামসুল আরেফিন ও ড. সুলতান মাহমুদ ভূঁইয়ার মতো কর্মকর্তাদের ডিঙিয়ে ভোল পাল্টে সচিবের মতো বড় পদ বাগিয়ে নেন ফখরুল। শুধু তাই নয়, সচিব হিসেবে পদ বাগিয়ে নিজস্ব বলয় সুদৃঢ় করার জন্য নিজের অনুসারী এক ডজন কর্মকর্তার পদোন্নতি নিশ্চিত করেছেন। সমালোচিত এই পদোন্নতি নিয়ে ইউজিসিতে অসন্তোষ সৃষ্টির পাশাপাশি শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর থেকে অনিয়ম সংক্রান্ত অডিট আপত্তি দেওয়া হয়েছে। সেখানে সরকারের কয়েক কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
ইউজিসি সূত্র জানায়, পতিত সরকারের সুবিধাভোগী সচিব ফখরুল ইসলাম ভোল পাল্টে এখন ফ্যাসিস্টবিরোধী সোচ্চার কর্মকর্তা। পুরস্কার হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকার তাকে সচিব হিসেবে পদোন্নতি দিয়েছে।
ইউজিসি সূত্র আরও জানায়, একটু পেছনে গেলেই দেখা যায়, ফ্যাসিস্টের দোসর হয়ে সবসময়েই সামনের সারিতে থেকেছেন ফখরুল। পতিত আওয়ামী লীগের দিবস কেন্দ্রিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সামনের কাতারে থেকে রাজনৈতিক দলের নেতার মতো কর্মসূচি পালন করেছেন। শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম ও মৃত্যু দিবসে বঙ্গবন্ধু ভবন ও টুঙ্গিপাড়ায় মুজিবের সমাধিসৌধে ফুল নিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে যেতেন। একজন সরকারি চাকরিজীবী হয়েও রাজনৈতিক দলের কর্মীর মতো কর্মসূচি পালন করেছেন তিনি। সে সময়ের ছবিই তার সব প্রমাণ।
ইউজিসির কর্মকর্তা ও কর্মচারী সূত্র আরও জানায়, গত সরকারের সময়ে সচিব ফখরুল ইউজিসিতে চাকরি করেছেন যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশের বন্ধু পরিচয়ে। দোর্দণ্ড প্রতাপ খাটিয়েছেন তিনি। সেই তিনিই এক প্রসঙ্গে বাংলানিউজকে বলেন, ‘এখানের যত অনিয়ম সবই ফ্যাসিস্ট সরকারের সময়ের। আমরা সেসব জঞ্জাল সাফ করছি। ’
খোঁজ নিয়ে আরও দেখা যায়, পতিত সরকারের সুবিধাভোগী এ সচিব গত বছরের মধ্য জুলাইয়ে দেশের মূলধারার একাধিক পত্রিকায় ফ্যাসিস্ট সরকারের গুণগান গেয়ে কলাম লেখেন। ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রশংসায় ভাসাতেন। একটি কলামের শিরোনাম দেখা গেছে, ‘উচ্চ শিক্ষা গবেষণা ও প্রযুক্তি উন্নয়নে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক। ’ গত ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১ সালে বণিক বার্তায় কলাম লেখেন এ শিরোনামে- ‘মানসম্মত শিক্ষা ও টেকসই উন্নয়ন ভাবনা’। সেখানেও গত সরকারের গুণগান গেয়েছেন এ কর্মকর্তা।
বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যদি এমন ঘোরতর অভিযোগ ওঠে তাহলে শিক্ষা ব্যবস্থার পরিণতি কী হতে পারে সে সম্পর্কে বলার অবকাশ থাকে না বলে মন্তব্য করেন প্রতিষ্ঠানের একাধিক পরিচালক।