Image description

আমি মাহেরীনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি তোমার নিজের দুই সন্তানের কথা একবারও ভাবলে না! সে বলেছিল, ওরাও তো আমার সন্তান। ওদের একা রেখে আমি কী করে চলে আসি? অনেক মায়ের সন্তানকে বাঁচিয়ে চলে গেলেন মাহেরীন, ঘরে রইল তার মা-হারা দুই সন্তান। নিহত শিক্ষিকা মাহেরীন চৌধুরীর স্বামী মনসুর হেলাল একবুক কষ্ট নিয়ে এ কথাগুলোই বলছিলেন। ভাই মুনাফ চৌধুরী জানান, ওখানে যারা ছিলেন, তারা আমাদের বলেছেন, মাহেরীন ইচ্ছা করলে বের হতে পারতেন, কিন্তু হননি। উনি বাচ্চাদের আগে বের করার চেষ্টা করেন।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, এত ক্ষিপ্র গতিতে বিমানটি আছড়ে পড়ে যে, আশপাশের এলাকাও কেঁপে ওঠে।

সোমবার দুপুরের এ বিভীষিকায় মুহূর্তেই প্রাণ হারায় অনেক শিশু। তাদের সঙ্গে মারা যান তাদেরই প্রিয় শিক্ষিকা মাহেরীন চৌধুরী, যিনি মাইলস্টোনের ওই শাখায় সমন্বয়ক ছিলেন। সেখানে থাকা এবং পরে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া ব্যক্তিরা বলেন, শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে গিয়ে মাহেরীন নিজে বের হতে দেরি করেন।

ভাই মুনাফ জানান, তার বোনের মনের জোর ছিল অনেক। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, দুর্ঘটনার কিছুক্ষণ পর ঠিক কে যেন ফোনে কল করেছিল বলতে পারব না। ফোনে আমাদের পরিবারের একজনকে বলল, ওনার অবস্থা গুরুতর। ওনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমাদের সেখানে যেতে বলেন। কল পাওয়ার পরেই আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে সবাইকে নিয়ে হাসপাতালে যান মুনাফ। তিনি বলেন, জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে তারা যাওয়ার পরও জীবিত ছিলেন তার বোন। কথাও বলছিলেন। তবে তার অবস্থা খুবই খারাপ ছিল।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে মুনাফ বলছিলেন, আগে বের হওয়ার সুযোগ থাকলেও মাহেরীন বের হননি। ওখানে যারা ছিলেন, তারা আমাদের বলেছেন, তিনি তো আসলে আগে বের হতে পারতেন। তিনি আগে বের হননি। তার শিক্ষার্থী যারা ছিল, তিনি তাদের আগে বের করার জন্য চেষ্টা করেছেন।

তিনি বলেন, এতে যেটা হয়েছে, তিনি এত বেশি ধোঁয়া আর আগুনে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিলেন যে, তার শ্বাসনালি পুরোপুরি পুড়ে গিয়েছিল। পরে আইসিউতে নেওয়ার পর নিশ্চিত হতে পারি যে, তার শ্বাসনালি পুড়ে গেছে।

দগ্ধ হওয়ার পর তাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকরা জানান, তার শরীরের শতভাগই দগ্ধ হয়েছিল। আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছিলেন তিনি। সোমবার রাত ১০টা ১০ মিনিটে আইসিউতেই মৃত্যুকে বরণ করে নেন মাহেরীন। পরদিন মঙ্গলবার বিকাল ৩টা ২৫ মিনিটে গ্রামের বাড়ি নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার বগুলাগাড়িতে তার লাশ নিয়ে যান স্বজনরা। বিকাল সাড়ে ৩টায় বগুলাগাড়ি স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে শোকার্ত মানুষ তাকে শেষ বিদায় জানান। জনাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে বাবার কবরের পাশে তার লাশ দাফন করা হয়। এর আগে ঢাকা থেকে লাশ গ্রামের বাড়িতে আসার পর তাকে একনজর দেখতে লোকজন ভিড় করেন। এদিকে জানাজা শুরু হওয়ার আগে তার স্বামী উপস্থিত শোকার্ত মানুষের উদ্দেশে জানান, তার স্ত্রী গ্রামে শিক্ষাবিস্তারে কাজ করছিলেন এবং বগুলাগাড়ি স্কুল অ্যান্ড কলেজের সভাপতি হয়েছিলেন। তার জন্য দোয়া চেয়ে তিনি বলেন, আমার স্ত্রী আপনাদের অনেক ভালোবাসত। আজ আপনাদের এই উপস্থিতি তারই প্রমাণ। এই কঠিন সময়ে আমার পরিবারের পাশে যারা আছেন, তাদের সবার কাছে আমি ও আমার পরিবার কৃতজ্ঞ।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জায়িদ ইমরুল মোজাক্কিন বলেন, মাহেরীন চৌধুরী একজন আলোকিত মানুষ ছিলেন। কারও প্রতি কখনো অন্যায় করেননি এবং অন্যায় কাজে জড়াননি। গ্রামে শিক্ষাবিস্তারে তিনি কাজ করছিলেন।

সোমবার দুপুরে উত্তরার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান দুর্ঘটনায় আহত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান মাহেরীন চৌধুরী। তিনি বগুলাগাড়ি চৌধুরী পরিবারের সন্তান এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাতিজি।