Image description

মাহমুদুর রহমান

 

ফিলিস্তিনের জমি দখল করার আদি প্রক্রিয়া আজ পর্যন্ত অব্যাহত রেখেছে। এই অবৈধ বাসিন্দারা ইসরাইলি সেনাবাহিনীর সহায়তায় প্রতিদিন ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘরে হামলা চালাচ্ছে, জলপাই গাছের বাগান ধ্বংস করছে এবং সেখানকার চারণভূমিতে পশুহত্যা চালাচ্ছে। দখলদার সেনাবাহিনী ও অবৈধ ইহুদি অভিবাসী সন্ত্রাসীরা মিলে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে এ বছরের ১৬ জুলাই পর্যন্ত দখলীকৃত পশ্চিম তীরে ২০৪ জন শিশুসহ ৯৬৮ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে।

এই ৯৬৮ জন ফিলিস্তিনির মধ্যে পাঁচজন মার্কিন নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও ওয়াশিংটন প্রশাসন এ ব্যাপারে ইসরাইলের বিরুদ্ধে কোনোরকম ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। অর্থাৎ ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিকের প্রতিও তাদের কোনোরকম দায়িত্ববোধ নেই। এদের পুরোপুরি মার্কিন নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। বাংলাদেশের যেসব তরুণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকারের স্বর্গভূমি মনে করে সে দেশে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে, তাদের বাস্তবতা জানা উচিত।

বাস্তব বড় রূঢ়। প্রয়োজনীয় মানসিক প্রস্তুতি ছাড়া পশ্চিমে গেলে অনেকেই বড়সড় ‘সাংস্কৃতিক ধাক্কার’ মুখোমুখি হতে পারেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইসলামোফোবিয়া এতটাই বিস্তৃত এবং গ্রহণযোগ্য আচরণ যে, রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেট দল নির্বিশেষে জায়োনিস্ট কংগ্রেসম্যান ও সিনেটররা গাজায় চলমান গণহত্যায় মিডিয়ায় প্রকাশ্যে উল্লাস প্রকাশ করতে কোনোরকম সংকোচবোধ করেন না। এর জন্য তাদের কোনো তিরস্কারের মুখোমুখি হতে হয় না। সে দেশে সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্সের মতো রাজনীতিবিদরা একেবারেই ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের মধ্যকার ‘বিশেষ সম্পর্ক’ সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করে আজকের মন্তব্য প্রতিবেদন সমাপ্ত করব। আল জাজিরায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, নেতানিয়াহু ২০০১ সালে এ মন্তব্য করেছিলেন—“I know what America is. America is a thing you can move very easily, move it in the right direction. They won’t get in the way.” (আমি আমেরিকাকে জানি। আমেরিকাকে সহজেই সরানো যায়, তাদেরকে ঠিক দিকে পরিচালনা করা সম্ভব। তারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না।) Netanyahu: US easily manipulated, Al Jazeera, Jul 18, 2010. https://www.aljazeera.com

ভূরাজনীতির স্পর্শকাতর বিষয়টি নেতানিয়াহুর দম্ভোক্তির মতো এতখানি সরল না হলেও এটা সত্য যে, পুরো ইসরাইল প্রকৃতপক্ষে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক ঘাঁটি। ইসরাইলের চারপাশের প্রায় সব রাষ্ট্রেই জ্বালানির বিপুল মজুত রয়েছে। তারা সব ধনী দেশ। পার্শ্ববর্তী সব সমুদ্রপথও (সুয়েজ খাল, হরমুজ প্রণালি, লোহিত সাগর, আরব সাগর) বিশ্ব নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া ইসরাইলের প্রতিবেশী মুসলিম বিশ্বের ছোট-বড় রাষ্ট্রের মধ্যে অনেকগুলোতেই যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে।

বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী হেজেমনিক রাষ্ট্রের কৌশলগত চিন্তায় ইসরাইল তাই মধ্যপ্রাচ্যে তার অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক স্বার্থের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য পাহারাদার। বর্তমান ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ওয়াশিংটন ইসরাইলকে যুদ্ধে কিংবা কূটনীতিতে কোনো অবস্থাতেই পরাজিত হতে দেবে না। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মুসলিম বিশ্বের সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে সর্বদা ‘ইসরাইল ফ্যাক্টর’ বিবেচনায় রেখেই যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তবে মুসলিম বিশ্বের লজ্জাজনক অনৈক্য ও স্বার্থপরতা ইসরাইলের এই অপ্রতিরোধ্য দানব হয়ে ওঠার একটি অন্যতম কারণ বলেও আমি মনে করি। প্রশ্ন করতে পারেন—এই অবস্থার কি পরিবর্তন হবে না? প্রধানত স্বৈরতান্ত্রিক মুসলিম বিশ্বের কাছে আমার কোনো প্রত্যাশা নেই।

তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হওয়ার কারণে সে দেশের ইসরাইল-সংক্রান্ত নীতি পরিবর্তন কেবল তখনই সম্ভব, যখন অধিকাংশ জনগণ হঠকারী ও উদ্ধত ইসরাইলকে ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় সম্পদের পরিবর্তে বোঝা হিসেবে দেখবে। খুব ধীরে হলেও সেই দিকে জনমতের পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে।

মার্কিন সংবাদ সংস্থা সিএনএনের একটি সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, গাজায় গণহত্যার পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকার অধিকাংশ তরুণ দেরিতে হলেও জালিম ইসরাইলের তুলনায় মজলুম ফিলিস্তিনিদের প্রতি অধিক সহমর্মিতা বোধ করছে। ওই জরিপ অনুযায়ী, ৩৫ বছরের কম বয়স্ক মার্কিন তরুণদের মধ্যে ৭২ শতাংশ ইসরাইলকে প্রদত্ত বিপুল সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য হ্রাস অথবা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে। ইউরোপের জনমতও ক্রমেই ইসরাইলের বিপক্ষে চলে যাচ্ছে। সেখানকার শাসকশ্রেণি ইসরাইলের সব অপকর্মে চোখ বুজে থাকার নীতি গ্রহণ করলেও সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে মানবতাবোধ জাগ্রত হচ্ছে।

পশ্চিমা বিশ্বের জায়নবাদী সরকারগুলো শত চেষ্টা করেও এই ডিজিটাল যুগে ইসরাইলের মানবতাবিরোধী অপরাধ আর ঢেকে রাখতে পারছে না। ফলে পৃথিবীতে ইসরাইল ক্রমেই একঘরে হয়ে পড়ছে। ইউরোপে স্পেন, আয়ারল্যান্ড, নরওয়ে, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক ও স্লোভেনিয়া ইসরাইলের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করার জন্য ইইউ’র ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। জায়নবাদী ভাবধারা-নিয়ন্ত্রিত জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি ও হাঙ্গেরির বিরোধিতার কারণে নিষেধাজ্ঞা জারি করা না গেলেও আমি আশাবাদী, বিশ্ববিবেক জাগ্রত হতে আর বেশি দেরি নেই। ইনশাআল্লাহ ইসরাইলি জুলুমের অবসান ঘটবে এবং ফিলিস্তিনের নিপীড়িত জনগণ তাদের সার্বভৌম অধিকার আদায় করতে সক্ষম হবে।