Image description

রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল ভবনে প্রশিক্ষণ বিমানের মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ৩১ জনে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে ২৫ জনই শিক্ষার্থী। গতকাল এক বেদনাবিধুর পরিবেশে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তাদের অনেককে দাফন করা হয়।

 

এই করুণ মৃত্যুতে দেশজুড়েই ছিল শোকের মাতম। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাস শুরুর আগে তাদের জন্য শোক প্রকাশ ও দোয়া করা হয়। বিভিন্ন শ্রেণি- পেশার মানুষ শোকসভার আয়োজন করে নিহতদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানায়।

সরেজমিন ওই স্কুলে আরো দেখা যায়, বিধ্বস্ত ভবনের সামনে নিহতদের স্মরণ করে দুটি ব্যানার টাঙানো হয়েছে। একটি স্কুলের পক্ষ থেকে, আরেকটি বেসরকারি সংস্থার পক্ষ থেকে। বিধ্বস্ত ভবনে কালো ধোঁয়ার দাগ লেগে আছে। বিমানের আঘাতে দেয়াল এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গেছে। আঘাতের স্থানটিতে সিঁড়ি ছিল বলে শিক্ষার্থীরা জানিয়েছে। শিক্ষার্থীরা শোকে বিহ্বল। তাদের কোনো ক্লাস হয়নি। স্কুলটি বন্ধ রয়েছে। অনেক শিক্ষক স্কুল ভবনের সামনে বসেছিলেন। কেউ কেউ স্কুলের আঙিনায় ঘুরে ধ্বংসস্তূপ দেখছিলেন। সেখানে কোনো কোনো শিক্ষার্থীকে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা যায়। এলাকাবাসীকে বাসার ছাদ থেকে মাইলস্টোন কলেজ মাঠের বিক্ষোভ পর্যবেক্ষণ করতে দেখা গেছে। ছাত্রদের বিক্ষোভ থেকে ছয় দফা দাবি জানানো হয়। স্কুল পরিদর্শনে আসা দুই উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল ও ড. সি আর আবরার এ দাবি মেনে নেওয়ার কথা বললেও তাদের অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। প্রায় ৯ ঘণ্টা পর তারা রাতে সেখান থেকে ফেরেন। তাদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবও ছিলেন।

নিখোঁজ নেই, সাতজনের পোড়া লাশ চিহ্নিত হয়নি

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী নিখোঁজ রয়েছে বলে কেউ কেউ পোস্ট দিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে স্কুলের শিক্ষার্থীরাও চিন্তিত। তারা দাবি করেছেন, তাদের কোনো শিক্ষার্থী নিখোঁজ থাকলে তাদের খুঁজে বের করা হোক। তবে এ বিষয়ে স্কুলের অধ্যক্ষ রেজাউল করীম আমার দেশকে জানিয়েছেন, তার জানামতে কোনো শিক্ষার্থী নিখোঁজ নেই। যারা আহত হয়েছে, তাদের খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সাতজনের পোড়া লাশ রাখা আছে। তাদের পরিচয় এখনো নিশ্চিত হয়নি। ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে তাদের পরিচয় শনাক্ত করা হবে। বিমান বাহিনীপ্রধান জানিয়েছেন, দুর্ঘটনা নিয়ে লুকানোর বা গোপন করার কিছু নেই।

মৃত্যুগুলো বেদনার

মাইলস্টোন স্কুল থেকে কিছুটা দূরেই দিয়াবাড়ীর তারারটেক মসজিদ। সেখানে পরিবারের সঙ্গে বসবাস করত ১০ বছরের শিশু আরিয়ান এবং ৯ বছরের বাপ্পি ও হোমায়ের। দুর্ঘটনায় তিনজনই প্রাণ হারিয়েছেন। স্কুল থেকে দুজনকে জীবিত উদ্ধার করা হলেও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাদের মৃত্যু হয়। পাশাপাশি তাদের কবর দেওয়া হয়েছে। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বাংলা ভার্সনের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষিকা মাসুকা বেগম নিপু। দুর্ঘটনার সময় তিনি সেখানে অবস্থান করছিলেন। গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে নেওয়া হলে সোমবার গভীর রাতে তার মৃত্যু হয়। তার লাশ আশুগঞ্জের সোহাগপুরে নেওয়া হয় দাফনের জন্য। ছেলেকে স্কুল থেকে আনতে গিয়ে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান মা রজনী ইসলাম। তার দাফনের পর ছেলেমেয়েরা অঝোরে কাঁদছে।

বার্ন ইউনিট থেকে শিশু সায়ানের কফিন গেছে নিজের গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর। মা কাঁদছেন ‘আমার সোনার পুতুলটারে আর কোনো দিন দেখতে পাব না।’

নিহত-আহতদের সম্পর্কে আইএসপিআর

আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, উত্তরায় বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৩১ জন মারা গেছে। আহত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ১৬৫ জন। এর মধ্যে কুয়েত-মৈত্রী হাসপাতালে আহত ৮, জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে আহত ৪৬, নিহত ১০; ঢাকা মেডিকেলে আহত ৩, নিহত ১; ঢাকা সিএমএইচে আহত ২৮, নিহত ১৬; উত্তরার লুবনা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড কার্ডিয়াক সেন্টারে আহত ১৩, নিহত ২; উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে আহত ৬০, নিহত ১; উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে আহত একজন, শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আহত একজন, ইউনাইটেড হাসপাতালে আহত দুজন, নিহত ১ এবং কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে আহত তিনজন।

কুর্মিটোলায় ফিউনারেল প্যারেডে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকিরের শেষ বিদায়

ঢাকার দিয়াবাড়ীতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বাহিনীর বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহত বৈমানিক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলামকে শেষ বিদায় জানানো হয়েছে ফিউনারেল প্যারেডে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুর ১টায় রাজধানীর কুর্মিটোলা বিএফ বাশার ঘাঁটিতে ফিউনারেল প্যারেডের পর তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান ও ভারপ্রাপ্ত নৌবাহিনী প্রধানসহ নিহতের পরিবারের সদস্যারা উপস্থিত ছিলেন। ঢাকার জানাজার পর তৌকিরের লাশ বিমান বাহিনীর একটি বিমানে করে দাফনের জন্য রাজশাহীতে তার বাড়ি নেওয়া হয়।

গুজব ছড়িয়ে দেশের সার্বভৌমত্বের স্তম্ভকে দুর্বল করবেন না

বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান দেশবাসীকে অনুরোধ করে বলেছেন, দয়া করে দেশের এই বিপদের সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন গুজব ও মিস ইনফরমেশনে কান দেবেন না। একটি শক্তিশালী বিমান বাহিনী দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য অপরিহার্য। দয়া করে গুজব ছড়িয়ে দেশের সার্বভৌমত্বের স্তম্ভকে দুর্বল করে দেবেন না। গতকাল কুর্মিটোলা বিমানঘাঁটিতে বিমান বিধ্বস্তে নিহত ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলামের শেষ শ্রদ্ধা অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।

বিমান বাহিনী প্রধান বলেন, এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় আপনাদের সবার মতো আমারও হৃদয় ভেঙেছে। আপনারা জানেন, আমি একটি সরকারি জরুরি সফরে মাত্র বেরিয়েছিলাম। আমি ওই বিমানবন্দর থেকেই আজ সকালেই আবার দেশে ফিরে এসেছি।

তিনি বলেন, দুর্ঘটনাস্থলে যত দ্রুত সম্ভব হেলিকপ্টার ব্যবহার করে উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় এরই মধ্যে একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। অতিশিগগির তদন্ত কমিটি বের করবে কী ধরনের ত্রুটি ছিল। তিনি আরো বলেন, সরকারের পাশাপাশি বিমান বাহিনীও সব সময় হতাহতদের পাশে থাকবে। আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে যা যা করণীয়, সব ধরনের ব্যবস্থা করা হবে।

সিএমএইচে আসে ১৫ লাশ, চিকিৎসাধীন ২৩

রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ২৮ জন আহত ব্যক্তি আসেন। তাদের মধ্যে পাঁচজন চিকিৎসা নিয়ে চলে গেছেন। ভর্তি আছেন ২৩ জন। তাদের মধ্যে ছয়জন আগুনে দগ্ধ। সিএমএইচের কমান্ড্যান্ট ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এসএম সোলায়মান মঙ্গলবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান।

তিনি বলেন, ‘আহতদের চিকিৎসায় আজ (মঙ্গলবার) রাতেই সিঙ্গাপুর থেকে মেডিকেল টিম আসছে। এ ঘটনায় সিএমএইচে মোট ১৫টি লাশ আসে। ঘটনাস্থল থেকে আসে ১২টি। এ ছাড়া কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল থেকে দুটি ও উত্তরা আধুনিক হাসপাতাল থেকে একজনের লাশ সিএমএইচে আনা হয়।

তিনি আরো বলেন, ‘যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর শুরুতে ঘটনাস্থল থেকে আটটি লাশ সিএমএইচে আনা হয়। পরে আরো তিনটি লাশ আসে ঘটনাস্থল থেকে। সর্বশেষ ঘটনাস্থল থেকে ওই যুদ্ধবিমানের পাইলটকে আনা হয়। পাইলটের বিষয়ে হোপ ছিল। বিভিন্ন পরীক্ষা করে দেখা যায়, সাইন অব লাইফ নেই। ৪০ মিনিট সময় নেওয়া হয়। পরে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।’

তিনি আরো বলেন, স্বাস্থ্য সচিব আর প্রধান উপদেষ্টার স্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষ সহকারীর সঙ্গে কথা বলে এটা তিনি জেনেছেন। এই টিম জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে যাবে। সেখানে রোগীদের দেখবে। তার আগেই মঙ্গলবার বিকালে সিএমএইচ থেকে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে রোগী পাঠানো হবে।

এদিকে আইএসপিআরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা আটজনের লাশ অভিভাবকদের কাছে হস্তান্তর করেছে। তারা হলোÑফাতেমা আক্তার (৯), পিতা গনি শেখ, জেলা বাগেরহাট; সামিউল করিম (৯), জেলা বরিশাল; রজনী ইসলাম (৩৭), জেলা কুষ্টিয়া; মেহনাজ আফরিন হুরায়রা (৯), জেলা টাঙ্গাইল; শারিয়া আক্তার (১৩), জেলা ঢাকা; নুসরাত জাহান আনিকা (১০), জেলা ঢাকা; সাদ সালাউদ্দিন (৯), পিতা মুকুল সালাউদ্দিন, মিরপুর, ঢাকা; সায়মা আক্তার (১৯), পিতা শাহ আলাম, জেলা গাজীপুর।

সব আদালতে এক মিনিট নীরবতা পালন

প্রশিক্ষণে ব্যবহৃত যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় হতাহতের ঘটনাকে স্মরণ করে গতকাল এক মিনিট নীরবতা পালন করেছে দেশের সব আদালত। গতকাল সকালে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির আপিল বিভাগ তাদের বিচারিক কার্যক্রম শুরুর আগে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করে। হাইকোর্ট বিভাগের বিচারিক কার্যক্রম শুরুর আগেও এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় নিহতদের স্মরণ ও তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দেশের সব অধস্তন আদালতেও এক মিনিট নীরবতাসহ শোক পালন করা হয়।

ঐকমত্য কমিশনের শোক প্রস্তাব

বিমান দুর্ঘটনায় শোক প্রস্তাব গ্রহণ করেছে ঐকমত্য কমিশন। সংলাপে অংশ নেওয়া ৩০টি রাজনৈতিক দলের নেতারা শোক প্রস্তাবে স্বাক্ষর করেন। গতকাল জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকের শুরুতে মাইলস্টোন ট্র্যাজেডির ওপর শোক প্রস্তাব পাঠ করা হয়। কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার শোক প্রস্তাবটি পাঠ করেন। এতে স্কুল ভবনের ওপর বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করা হয়। মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনায় নিহত শিক্ষার্থীসহ সব নিহতের আত্মার মাগফিরাত কামনা করা হয়। দুর্ঘটনায় নিহত ও আহদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ এবং আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করা হয়। শোক প্রস্তাবে বিমান দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে যথাযথ তদন্ত এবং এ ধরনের দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যও সরকারের প্রতি দাবি জানানো হয়।

ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ গভীর সমবেদনা জানিয়ে বলেন, গত বছর এই সময় আমরা ভয়াবহ একটি পরিস্থিতির মধ্যে ছিলাম। এক বছর পর আজ মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় শোকে মুহ্যমান হয়ে আছে পুরো জাতি। তিনি নিজ নিজ অবস্থান থেকে সর্বস্তরের মানুষকে শোকসন্তপ্ত পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।

শোক জানালেন পাকিস্তানের ক্রিকেটারা

মাইলস্টোন স্কুলে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনায় ছুঁয়ে গেছে বাংলাদেশ সফরে আসা পাকিস্তানি ক্রিকেটারদেরও। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শোক ও সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশ সফরের টিমে না থাকলেও পাকিস্তানে বসেই শোক জানিয়েছেন কেউ কেউ। শাহিন আফ্রিদি নিজের এক্স হ্যান্ডলে লেখেন-‘হৃদয়বিদারক এবং মর্মান্তিক। বাংলাদেশে বিমান দুর্ঘটনায় হতাহতদের জন্য প্রার্থনা। পরিবারগুলো যেন শক্তি ফিরে পায়।’

পাকিস্তানের পেসার হাসান আলী ফেসবুক পোস্টে লেখেনÑ‘ঢাকার মর্মান্তিক খবরে শোকাহত। অনেকগুলো নিষ্পাপ প্রাণ অকালে ঝরল। হতাহত এবং তাদের পরিবারের সঙ্গে আছে আমার হৃদয়। সৃষ্টিকর্তা সবাইকে ধৈর্য দিন। আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করছি।’

নাসিম শাহ তার পোস্টে লেখেনÑ‘বাংলাদেশ থেকে মর্মান্তিক খবর পেলাম। যে দেশটি আমার হৃদয়ের খুব কাছে। এই বিধ্বংসী দুর্ঘটনায় হতাহত এবং তাদের পরিবার ও আরো যারা আক্রান্ত হয়েছেন সবার জন্য দোয়া করছি। এই কঠিন সময়ে তারা শক্তি ও শান্তি ফিরে পাক।’

ফখর জামান তার এক্স হ্যান্ডলে গতকাল লেখেনÑ‘ঢাকার মর্মান্তিক ঘটনায় খুব খারাপ লাগছে। যেসব পরিবার এ ঘটনার ভুক্তভোগী এবং যারা আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের সবার জন্য দোয়া রইল।’

সামিউলের শরীরে এসে পড়ে বিমানের জ্বলন্ত অংশ

উত্তরায় বিমান বিধ্বস্ত হয়ে নিহত মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সামিউল করিমের (১১) মৃত্যুতে পুরো পরিবার শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়েছে। সামিউল বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ পৌরসভার খারকি এলাকার রেজাউল করিমের ছেলে। তার দুই ছেলেমেয়ের মধ্যে সামিউল ছোট। গতকাল মঙ্গলবার সকালে সামিউলের লাশ ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ) থেকে মেহেন্দীগঞ্জে গ্রামের বাড়িতে আনা হয়। বাবার চোখের সামনেই সে মারা যায়। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তার বাবা রেজাউল করিম জানান, স্কুল ছুটি হয়েছে। সামিউল কাঁধে ব্যাগ নিয়ে সামনে আসছিল। আমি পাঁচ ফুট দূরত্বে। তখন বিধ্বস্ত বিমানের একটি জ্বলন্ত অংশ সামিউলের পেছনে পড়ে। দৌড়ে গিয়ে ঝলসে যাওয়া ছেলেকে বুকের মধ্যে জাপটে ধরি। কিছুক্ষণ পর একটি সামরিক হেলিকপ্টার সেখানে আসে এবং ছেলেকে সিএমএইচে নিয়ে যায়। পরে সেখানে সে মারা যায়। তিনি আরো জানান, আমার ছেলেটি জ্বলছিল, আমি কিছুই করতে পারিনি। এমন দৃশ্য মনে করেই সারা জীবন বাঁচব। আমি তো আর জীবনে ঘুমাতে পারব না, সব শেষ হয়ে গেল।

চোখের জলে মাইলস্টোন কলেজ শিক্ষার্থীর বিদায়

উত্তরার দিয়াবাড়ীতে বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহত মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র আব্দুল্লাহ আল শামীমের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার ভেদরগঞ্জ উপজেলার সখিপুর থানার ডিএমখালী ইউনিয়নের মাঝিকান্দি গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে বাবার কবরের পাশে তার দাফন সম্পন্ন হয়। এর আগে ডিএমখালীর চরভয়রা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

নিহতের চাচা ডিএমখালী শহীদ সিরাজ সিকদার কলেজের শিক্ষক মো. মোতালেব হোসেন মাঝি জানান, সদাহাস্যোজ্জ্বল মেধাবী শামীম ছিল তিন ভাইবোনের মধ্যে সাবার ছোট। তার বাবা মরহুম কালিম উদ্দিন মাঝি সৌদি আরব প্রবাসী ছিলেন। সাত মাস হলো তিনি মারা গেছেন। দুই ভাই, এক বোন নিয়ে তারা মায়ের সঙ্গে রাজধানীর উত্তরায় বসবাস করত।

সায়ানের জন্য কাঁদছে পরিবার ও গ্রামবাসী

বিমান দুর্ঘটনায় দগ্ধ সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সায়ান ইউসুফ (১৪) গত সোমবার রাত সাড়ে ৩টার দিকে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। তার মৃত্যুতে গ্রামের বাড়িতে শোকের মাতম চলছে। নিহত সায়ান লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার বশিকপুর ইউনিয়নের বশিকপুর গ্রামের পালেরবাড়ির সন্তান। তার বাবা এএফএম ইউসুফ মাইলস্টোন কলেজ শাখার রসায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং মা শামীমা শাম্মীও মাইলস্টোন স্কুল শাখার রসায়নের শিক্ষক। তারা উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টরে ভাড়া থাকত। তার বোন পারিশা মাইলস্টোন স্কুলের ৩য় শ্রেণির শিক্ষার্থী। গতকাল মঙ্গলবার দুপুর পৌনে ১টার দিকে সায়ানের লাশ বশিকপুরের গ্রামের বাড়িতে আনা হয়। বেলা ৩টায় বশিকপুরের গ্রামের বাড়িতে জানাজা শেষে সায়ানের দাফনকাজ সম্পন্ন হয়।

মারমা পরিবারে শোকের মাতম

উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় রাঙামাটির রাজস্থলী উপজেলার উক্যচিং মারমা (১৪) নামের এক শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে। উক্যচিং মারমা ওই স্কুলের ইংলিশ মিডিয়ামের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। মারাত্মক অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় সে ঢাকার জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল আনুমানিক রাত ২টার দিকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। সে রাজস্থলী উপজেলার বাঙ্গালহালিয়া ইউনিয়নের কলেজপাড়া গ্রামের উসাইমং মারমার ছেলে। তিনি রাজস্থলী উপজাতীয় আবাসিক উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। ছেলের মৃত্যুতে ওই পরিবারে শোকের মাতম চলছে।

মাইলস্টোন স্কুল থেকে কিছুটা দূরেই দিয়াবাড়ীর তারারটেক মসজিদ। সেখানে পরিবারের সঙ্গে বসবাস করত ১০ বছরের শিশু আরিয়ান এবং ৯ বছরের বাপ্পি ও হোমায়ের। দুর্ঘটনায় তিনজনই প্রাণ হারিয়েছে। স্কুল থেকে দুজনকে জীবিত উদ্ধার করা হলেও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাদের মৃত্যু হয়। পাশাপাশি তাদের কবর দেওয়া হয়েছে।

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বাংলা ভার্সনের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষিকা মাসুকা বেগম নিপু। দুর্ঘটনার সময় তিনি সেখানে অবস্থান করছিলেন। গুরুতর আহতাবস্থায় উদ্ধার করে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে নেওয়া হলে সোমবার গভীর রাতে তার মৃত্যু হয়। তার লাশ আশুগঞ্জের সোহাগপুরে নেওয়া হয় দাফনের জন্য। ছেলেকে স্কুল থেকে আনতে গিয়ে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান মা রজনী ইসলাম। তার দাফনের পর ছেলেমেয়েরা অঝোরে কাঁদছে।

বার্ন ইনস্টিটিউট থেকে শিশু সায়ানের কফিন গেছে নিজের গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুরে। মা কাঁদছেন ‘আমার সোনার পুতুলটারে আর কোনোদিন দেখতে পাব না।’