
এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট আর পরীক্ষার চাপে কাটানো দিনগুলোর অবসান ঘটিয়ে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে চেয়েছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ৫ শিক্ষার্থী। সদ্য শেষ হওয়া প্রথম বর্ষের পরীক্ষা শেষে প্রকৃতির ছোঁয়া পেতে ছুটেছিলেন কক্সবাজারের নীল জলরেখার দিকে—প্রশান্তি আর মুক্তির আশায়। কিন্তু সেই আনন্দযাত্রা পরিণত হলো গভীর বিষাদে।
আজ মঙ্গলবার (৮ জুলাই) সকালে কক্সবাজারের হিমছড়ি সমুদ্র সৈকতে ঘুরতে গিয়েছিলেন চবির ৫ শিক্ষার্থী। তারা সমুদ্রে গোছলে নামেন। তাদের মধ্যে তিনজন সমুদ্রে হারিয়ে যান। ওই তিনজনই চবির ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। তাদের একজনের লাশ খুঁজে পাওয়া গেছে। বাকি দুজন এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। ধারনা করা হচ্ছে, তারাও মারা গেছেন।
নিহত শিক্ষার্থী কে এম সাদমান রহমান সাবাব, বাড়ি ঢাকার মিরপুরে। নিখোঁজ দুজন—অরিত্র হাসান ও আসিফ আহমেদ। উভয়ের বাড়ি বগুড়ায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মো. ফরহাদ হোসেন হলের একই কক্ষে থাকতেন তারা।
পাঁচ বন্ধুর একজন আরবি বিভাগের শিক্ষার্থী রিয়াদ মিয়া জানান, আজ মঙ্গলবার ভোর সাড়ে ৫টার দিকে তারা হিমছড়ি জাদুঘর সংলগ্ন সমুদ্র সৈকতে যান। সেখানেই ঘটে দুর্ঘটনা। রিয়াদ মিয়া বলেন, “ছবি তোলার সময় বৃষ্টি শুরু হলে আমরা দুইজন দৌড়ে ছাতার নিচে চলে আসলেও বাকি তিনজন সাগরে থেকে যায়। বারবার তাদের ডাকার পরও তারা ‘আসছি, আসছি’ বলতে থাকে।”
“এমনকি মাছ ধরতে থাকা মাঝিরাও তাদের উঠে যেতে বলে। একপর্যায়ে তারা পানিতে তলিয়ে যায়। কিছু সময় পর সাবাবের লাশ তীরে ভেসে আসে। অন্য দুইজনকে আর পাওয়া যায়নি”, বলেন রিয়াদ।
সঙ্গে থাকা আরেক সহপাঠী ফারহান জানান, “আমরা খুব খুশি ছিলাম। পরীক্ষার পর একটু ঘুরতে এসেছিলাম। মূলত বান্দরবনে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল, পরে হঠাৎ কক্সবাজারে আসার সিদ্ধান্ত নিই। সমুদ্রে নামার কোনো পরিকল্পনা ছিল না। কিন্তু হঠাৎ সাবাব নেমে পড়ে, পরে অরিত্র আর আসিফও। তখন ঢেউ তেমন ছিল না, কিন্তু হঠাৎ বড় বড় ঢেউ আসতে থাকে। ওরা উঠতে চাচ্ছিল, কিন্তু পারছিল না। সেই মুহূর্ত এখনো চোখের সামনে ভাসছে। অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকা, ঢেউয়ের ধাক্কা—সবকিছুই আজীবনের দুঃসহ স্মৃতি হয়ে রইল।”
উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন বলেন, “এটি একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা। পুরো বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার শোকাহত। আমরা খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটি গাড়ি পাঠিয়েছি এবং স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তারা পরীক্ষা শেষে নিজেরাই বেড়াতে গিয়েছিল। আমি শিক্ষার্থীদের অনুরোধ করব, এমন ভ্রমণে গেলে সতর্কতা অবলম্বন করতে।”
ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক ও সহকারী প্রক্টর সাঈদ বিন কামাল চৌধুরী বলেন, “তারা ব্যক্তিগতভাবে কক্সবাজার ঘুরতে গিয়েছিল। সাবাবের মরদেহ স্থানীয় জেলেরা উদ্ধার করেছে। বাকি দুজনকে উদ্ধারে কাজ করছে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস। তারা খুবই প্রাণবন্ত, হাসিখুশি ছেলে ছিল। তাদের ক্লাসে আর দেখা যাবে না—ভাবতেই কষ্ট হয়।”
চবির সবুজ প্রকৃতি, সরগরম করিডোর, ছাত্রাবাসের ব্যস্ততা—সব যেন থমকে গেছে। ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের করিডোরে শোক, শূন্যতা আর হতবিহ্বলতার ছাপ স্পষ্ট। স্বপ্ন ছিল, সম্ভাবনা ছিল, ছিল অদম্য উদ্যম—সবকিছু ডুবিয়ে দিল একটি হঠাৎ আসা ঢেউ।
এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত (বিকাল ৪টা) নিখোঁজ দুজনের খোঁজে উদ্ধারকাজ চলছে। সমুদ্রের প্রবল উত্তাল অবস্থার কারণে তা ব্যাহত হচ্ছে। নিহত সাবাবের মরদেহ মর্গে পাঠানো হয়েছে।