
বাংলাদেশের সব রপ্তানি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আগামী ১ আগস্ট থেকে মার্কিন বাজারে রপ্তানি হওয়া পণ্যের ওপর এই বাড়তি শুল্ক কার্যকর হবে। সোমবার নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে এ কথা জানিয়েছেন ট্রাম্প। নতুন শুল্ক হার ঘোষণা করে তিনি বাংলাদেশসহ ১৪টি দেশকে চিঠি দিয়েছেন।
সর্ববৃহৎ একক বাজারে বড় ঝুঁকি
বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রপ্তানি বাজার হলো যুক্তরাষ্ট্র।
গত ৩ এপ্রিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছিলেন ট্রাম্প।
অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাবে আশঙ্কা
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতা ব্যর্থ হলে উচ্চ শুল্কের সরাসরি প্রভাব পড়তে পারে বহু কারখানার ওপর; বিশেষ করে যেগুলো মার্কিন ক্রেতার ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের পণ্যগুলো আরো বেশি অপ্রতিযোগিতামূলক হয়ে পড়তে পারে, যার ফলে রপ্তানি আয় কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এ ছাড়া তৈরি পোশাক খাতের সহায়ক শিল্প যেমন—প্যাকেজিং, পরিবহন এবং এর সঙ্গে যুক্ত স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও এই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারেন।
বাংলাদেশ পাল্টা ব্যবস্থা নিলে শুল্ক বাড়ানোর হুমকি
যদি এই শুল্ক আরোপের প্রভাবে বাংলাদেশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করে তাহলে যে ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, সেটির সঙ্গে আরো শুল্ক আরোপ করা হবে বলে জানিয়েছেন ট্রাম্প।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে লেখা এক চিঠিতে ট্রাম্প বলেছেন, ‘২০২৫ সালের ১ আগস্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো সব বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক বসবে। এটি খাতভিত্তিক শুল্কের সঙ্গে আলাদাভাবে যোগ হবে। উচ্চ শুল্ক এড়াতে যদি কোনো পণ্য ঘুরপথে যুক্তরাষ্ট্রে আনা হয়, তাহলে সেই পণ্যের ওপরও উচ্চ শুল্কই আরোপ করা হবে।’
চিঠিতে আরো বলা হয়েছে, ‘দয়া করে বুঝুন, ৩৫ শতাংশ শুল্ক আমাদের দেশের সঙ্গে আপনার দেশের যে বড় বাণিজ্যঘাটতি রয়েছে, তা দূর করার জন্য যথেষ্ট নয়—এই হার আসলে তার চেয়ে অনেক কম। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, যদি বাংলাদেশ বা বাংলাদেশের কোনো কম্পানি যুক্তরাষ্ট্রে কারখানা গড়ে পণ্য উৎপাদন করে, তাহলে সেই পণ্যের ওপর কোনো শুল্ক থাকবে না। বরং আমরা দ্রুত, পেশাদারভাবে এবং নিয়ম মেনে সব অনুমোদন দেওয়ার জন্য সর্বোচ্চ সহযোগিতা করব, অর্থাৎ কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।’
শুল্কের সময়সীমা ‘শতভাগ চূড়ান্ত নয়’
আগামী ১ আগস্ট থেকে শুল্ক কার্যকরের কথা বলা হলেও এই তিন সপ্তাহের মধ্যেও দর-কষাকষির সুযোগ থাকবে বলে জানিয়েছেন ট্রাম্প। ট্রাম্প বলেছেন, ‘এই সিদ্ধান্তই বহাল থাকবে, তবে তা ১০০ শতাংশ চূড়ান্ত নয়। কোনো দেশ যদি আমাকে ফোন করে ভিন্ন কোনো চুক্তির প্রস্তাব দেয় এবং সেটা আমার পছন্দ হয়, তবে চুক্তি করব।’
আলোচনা সফল হয়নি, তবু সমাধানের আশা সরকারের
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সেক্রেটারি শফিকুল আলম গতকাল মঙ্গলবার এক ফেসবুক পোস্টে জানান, শুল্ক নিয়ে আলোচনা এখনো চলমান। বাংলাদেশের বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন ওয়াশিংটন ডিসিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য আলোচনায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমানও এই প্রতিনিধিদলে রয়েছেন।
শফিকুল আলম আরো বলেন, ‘বাংলাদেশ দল মার্কিন পক্ষের সঙ্গে কয়েক দফা আলোচনা করেছে। ৯ জুলাই আরেক দফা আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে। ঢাকা ওয়াশিংটন ডিসির সঙ্গে একটি শুল্কচুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে, যা উভয় দেশের জন্য লাভজনক হবে বলে আমরা আশা করি।’
যুক্তরাষ্ট্রের পারস্পরিক শুল্ক (রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ) আরোপ হওয়ার পর বাংলাদেশ যত দ্রুত প্রস্তুতি নিয়ে ওয়াশিংটনে চিঠি পাঠিয়েছিল। কিন্তু শুল্ক কার্যকর তিন মাস স্থগিত করার পর কয়েক দফা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বাণিজ্য দপ্তরের সঙ্গে বৈঠকও হয়।
চুক্তি স্বাক্ষর নিয়ে আলোচনা চলাকালে ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে আমাদের চিঠি দেওয়া হতাশাজনক বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘নতুন ডকুমেন্টসে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের সামরিক সরঞ্জাম, বোয়িং, এলএনজি, গমসহ কৃষিপণ্য ও তুলা আমদানি আরো সহজ করার কথা বলেছে। আমরা এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম, তুলা ও এলএনজি আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছি। উড়োজাহাজ কেনার উদ্যোগও আছে।’
শুল্ক নিয়ে আলোচনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন। বাণিজ্য উপদেষ্টা জানিয়েছেন, বুধবার মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধির সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিতীয় দফায় বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। ওই বৈঠক থেকে শুল্ক নিয়ে ভালো ফল পাওয়ার আশা করছেন তিনি।
ভিয়েতনামের পণ্যে পাল্টা শুল্ক ১৫% কম, দ্বিতীয় স্থান ধরে রাখা নিয়ে শঙ্কা
ভিয়েতনামের ওপর ২০ শতাংশ, মায়ানমার ও লাওসের ওপর ৪০ শতাংশ, মালয়েশিয়া ও তিউনিশিয়ার ওপর ২৫ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ার ওপর ৩২ শতাংশ এবং কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ডের ওপর ৩৬ শতাংশ করে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
ভিয়েতনামের পর ভারতও যদি ট্রাম্পের সঙ্গে চুক্তি সেরে ফেলতে পারে, সে ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশের পোশাক পণ্যের দাম বেশি বাড়বে। আর তাতে ভিয়েতনাম ও ভারতের মতো প্রতিযোগী দেশ বেশি সুবিধা পাবে।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি পণ্য রপ্তানি হয় পোশাক। প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ভিয়েতনামও যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি পোশাক রপ্তানি করে। এমনকি বিশ্ববাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ রয়েছে দ্বিতীয় স্থানে, আর ভিয়েতনাম তৃতীয় স্থানে। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক আরোপে সবচেয়ে বড় এই বাজারে এগিয়ে যাবে ভিয়েতনাম।
গত এপ্রিলে ভিয়েতনামের পণ্যে ৪৬ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছিলেন ট্রাম্প। কিন্তু চুক্তির মাধ্যমে ভিয়েতনাম পাল্টা শুল্ক কমিয়ে ২০ শতাংশে নিয়ে আসে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের চেয়ে ১৫ শতাংশ কম পাল্টা শুল্ক দিতে হবে ভিয়েতনামকে। এতে মার্কিন বাজারে পণ্য রপ্তানিতে প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনামের চেয়ে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন রপ্তানিকারকরা।
২০২৪ সালে ভিয়েতনামের মোট পণ্য রপ্তানির ৩০ শতাংশই গেছে যুক্তরাষ্ট্রে। এই বিশাল বাজারে এখন বাংলাদেশের চেয়ে দেশটির আরো এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হলো।
দর-কষাকষিতে সম্পৃক্ত না করার অভিযোগ
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তৈরি পোশাক শিল্পে বাড়তি শুল্কের প্রভাব হবে ভয়াবহ। পণ্য রপ্তানি কমে যাবে। যেসব কারখানার মোট তৈরি পোশাক রপ্তানির ৫০ শতাংশ বা তার বেশি যুক্তরাষ্ট্রে যায়, সেসব প্রতিষ্ঠান বেশি বিপদে পড়বে। আবার যেসব কারখানা দেশটিতে কম রপ্তানি করে, সেগুলো কম ঝুঁকিতে থাকবে।
তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের একক বড় বাজার। সে জন্য আমরা শুরু থেকে সরকারকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর-কষাকষির অনুরোধ জানিয়েছি। তবে পাল্টা শুল্কে দর-কষাকষি নিয়ে ব্যবসায়ীদের অন্ধকারে রাখা হয়েছে। বিদেশি ক্রেতারা অভিযোগ করে বলছেন, পাল্টা শুল্ক নিয়ে আমরা সিরিয়াস নই। আমরা ব্যবসায়ী মহল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করছি।’
নিট পোশাক মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শুল্ক নিয়ে দর-কষাকষির পুরো প্রক্রিয়ায় বেসরকারি খাতকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছে। এটা খুবই দুঃখজনক। দর-কষাকষির জন্য দেশটিতে বাংলাদেশ সরকারের একটি প্রতিনিধিদল রয়েছে। অথচ ওই দলে বেসরকারি খাতের কোনো প্রতিনিধি নেই। এই প্রক্রিয়ায় বেসরকারি খাতের একজন প্রতিনিধি অবশ্যই থাকা উচিত ছিল। বেসরকারি খাত এখানে একটি বড় স্টেকহোল্ডার। আলটিমেটলি ব্যবসা তো বেসরকারি খাতই করবে। এ জন্য প্রথম ধাক্কাটা তো তাদেরই পেতে হবে। ভিয়েতনামের সঙ্গে আমি এমনিই পারছি না, এরপর যদি ভিয়েতনাম আমাদের থেকে ১৫ শতাংশ সুবিধায় থাকে তখন কোন পাগলে ভিয়েতনাম রেখে বাংলাদেশে অর্ডার দেবে? এই অবস্থা থেকে যদি আমরা উত্তরণ না ঘটাতে পারি তাহলে রপ্তানি খাতে বিপর্যয় দেখা দেবে—এটা নিয়ে কোনো গবেষণা করার দরকার নেই। যারা যুক্তরাষ্ট্রে বাজার হারাবে তারা আবার আমাদের সঙ্গে ইউরোপের বাজারে এসে মারামারিতে যোগ দেবে।’
শুল্ক বাড়লে দামও বাড়বে
যুক্তরাষ্ট্রের গার্মেন্টস আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত কম দাম, স্থিতিশীল সরবরাহ ও মানের কারণে বাংলাদেশমুখী। ট্রাম্পের ঘোষিত ৩৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হলে একই পণ্যের দাম গড়ে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। এই পরিস্থিতিতে মার্কিন ক্রেতারা বাংলাদেশের পরিবর্তে ভারত, ভিয়েতনাম বা মেক্সিকোর মতো বিকল্প দেশে ঝুঁকতে পারেন।
কোন পথে সমাধান?
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এখনই কিছু বিকল্প উদ্যোগ নিতে হবে : যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য আলোচনার গতি বাড়াতে হবে, শুল্ক সুবিধা পুনরায় পেতে জোরালো কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে, বিকল্প বাজার (চীন, রাশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা) তৈরি করতে হবে, উচ্চমূল্যের পণ্য এবং ব্র্যান্ডভিত্তিক উৎপাদনে মনোযোগ দিতে হবে, পণ্যের বৈচিত্র্য এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নের দিকে মনোযোগ জরুরি।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা শুল্কের কারণে আমাদের রপ্তানিতে অবধারিতভাবে প্রভাব পড়বে। এখন ভিয়েতনামের সঙ্গে আমাদের ১৫ শতাংশ শুল্কের পার্থক্য। স্বাভাবিকভাবেই তারা ভালো করবে। যদি ভারত, পাকিস্তান ও চীনও শুল্কের পরিমাণ কমানোর সুযোগ পায় তবে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হব। রপ্তানি একদম শূন্যের কোঠায় চলে যাবে না, তবে রপ্তানির বাজারে যে ঊর্ধ্বগতি ছিল তা হারাতে হবে। অনেক বড় বড় কারখানার মালিক যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের ওপর নির্ভর করে বিশাল অঙ্কের পুঁজি বিনিয়োগ করেছেন। তাঁরা এখন বিপদে পড়বেন।’