
এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় বিগত বছরগুলোর মতো জিপিএ ৫ পাওয়ার ‘ঢল’ এ বছর থামতে পারে। পরীক্ষার্থীদের মধ্যে যার যতটুকু প্রাপ্য, শিক্ষকদের ততটুকু নম্বরই দিতে বলা হয়েছে, এর বেশি নয়। উত্তর সঠিক না হলে নম্বর দেওয়া যাবে না। এভাবে খাতা দেখা ফিরছে আগের রীতিতে।
২০০১ সালে দেশে প্রথমবারের মতো এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় গ্রেডিং পদ্ধতিতে ফল প্রকাশ করা হয়। ওই বছর জিপিএ ৫ পেয়েছিল ৭৬ জন, পাসের হার ছিল ৩৫.৮১ শতাংশ। এরপর ২০০৭ সাল পর্যন্ত মোটামুটি গতিতে জিপিএ ৫ ও পাসের হার বাড়তে থাকে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পতিত আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৫ বছর তাদের নিজেদের সাফল্য দেখাতে শিক্ষার্থীদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে।
সূত্র জানায়, গত ১০ এপ্রিল থেকে ৮ মে পর্যন্ত এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। মাদরাসা বোর্ডের দাখিল পরীক্ষা শেষ হয় গত ১৫ মে। আগামীকাল বৃহস্পতিবার এসব পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হবে।
গত ২৬ জুন থেকে শুরু হয়েছে এইচএসসি পরীক্ষা। এ বছর থেকে জিপিএ ৫-এর উল্লম্ফন থামানোর উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও আন্ত শিক্ষা বোর্ড। খাতা দেখা ফিরছে আগের রীতিতে। এরই মধ্যে শিক্ষকদের এ ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। উদার হাতে নম্বর দেওয়া যাবে না। এতে পাসের হার ও জিপিএ ৫ উল্লেখযোগ্য হারে না কমলেও উল্লম্ফনের যে ধারা ছিল তা কমে আসবে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন।
আন্ত শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কমিটির আহবায়ক ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক এস এম কামাল উদ্দিন হায়দার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা শিক্ষকদের খাতা সরবরাহের আগে বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছি। তাঁদের বলেছি, একজন শিক্ষার্থী খাতায় যেভাবে লিখবে, সেভাবে মার্ক পাবে। অতিরিক্ত নম্বর বা কম নম্বর দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমরা খাতা খুব সাবধানে দেখতে বলেছি। শিক্ষার্থীরা যাতে কোনো ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকটায় লক্ষ রাখতে শিক্ষকদের বলেছি।’
শিক্ষা বোর্ড সূত্র জানায়, এসএসসিতে ২০০১ সালে পাসের হার ছিল ৩৫.২২ শতাংশ। ৭৬ জন শিক্ষার্থী প্রথমবারের মতো জিপিএ ৫ পায়। ২০০২ সালে জিপিএ ৫ পায় ৩২৭ জন, ২০০৩ সালে এক হাজার ৩৮৯ জন, ২০০৪ সালে আট হাজার ৫৯৭ জন, ২০০৫ সালে ১৫ হাজার ৬৪৯ জন, ২০০৬ সালে ২৪ হাজার ৩৮৪ জন, ২০০৭ সালে ২৫ হাজার ৭৩২ জন এবং ২০০৮ সালে পায় ৪১ হাজার ৯১৭ জন।
২০০৯ সালে এসএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়েছিল ৪৫ হাজার ৯৩৪ জন, ২০১০ সালে ৫২ হাজার ১৩৪ জন, ২০১১ সালে ৬২ হাজার ২৪৪ জন, ২০১২ সালে ৮২ হাজার ২১২ জন, ২০১৩ সালে ৯১ হাজার ১২২ জন, ২০১৪ সালে এক লাখ ৪২ হাজার ২৭৬ জন, ২০১৫ সালে এক লাখ ১১ হাজার ৯০১ জন, ২০১৬ সালে এক লাখ ৯ হাজার ৭৬১ জন, ২০১৭ সালে এক লাখ চার হাজার ৭৬১ জন, ২০১৮ সালে এক লাখ ১০ হাজার ৬২৯ জন, ২০১৯ সালে এক লাখ পাঁচ হাজার ৫৯৪ জন, ২০২০ সালে এক লাখ ৩৫ হাজার ৮৯৮ জন, ২০২১ সালে এক লাখ ৮৩ হাজার ৩৪০ জন, ২০২২ সালে দুই লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ জন এবং ২০২৩ সালে এক লাখ ৮৩ হাজার ৫৭৮ জন পরীক্ষার্থী।
জানা যায়, ২০০৩ সালে এইচএসসিতে গ্রেডিং পদ্ধতিতে ফল প্রকাশ শুরু হয়। ওই বছর প্রায় পাঁচ লাখ পরীক্ষার্থীর মধ্যে জিপিএ ৫ পায় মাত্র ২০ জন। পাসের হার ছিল ৩৮.৪৩ শতাংশ। এরপর ধারাবাহিকভাবে জিপিএ ৫ ও পাসের হার বাড়তে থাকে। ২০২০ সালে জিপিএ ৫ পায় এক লাখ ৬১ হাজার ১০৭ জন, ২০২১ সালে এক লাখ ৮৯ হাজার ১৬৯ জন, ২০২২ সালে এক লাখ ৭৬ হাজার ২৮২ জন। তবে ২০২৩ সালে তা কমে আসে ৯২ হাজারে। সর্বশেষ ২০২৪ সালে এইচএসসিতে অংশ নেয় ১৪ লাখ ৫০ হাজার ৭৯০ জন। পাসের হার ছিল ৭৭.৭৮ শতাংশ এবং জিপিএ ৫ পায় এক লাখ ৪৫ হাজার ৯১১ জন।
তবে প্রতিবছর জিপিএ ৫ বাড়লেও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষার প্রকৃত চিত্র বেরিয়ে আসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের ৯৪ শতাংশই ফেল করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা, আইন ও সামাজিক বিজ্ঞান ইউনিটেও ৯০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী ফেল করেছেন। এক হিসাবে দেখা যায়, এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়েও প্রায় সোয়া এক লাখ শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ১৫ বছর পরীক্ষার খাতা দেওয়ার সময় সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ সব পরীক্ষককে সহানুভূতির সঙ্গে খাতা দেখতে বলে দিত। ফেল করলে শিক্ষার্থীদের মনোবল ভেঙে যাবে। অনেকে পড়ালেখা বাদ দেবে। পরীক্ষকদের এ বিষয়টি মাথায় রাখতে বলা হতো।
জানা যায়, শিক্ষা বোর্ডগুলো পরীক্ষকদের কাছে খাতা বুঝিয়ে দেওয়ার পর প্রধান পরীক্ষকরা তাঁদের আরেক দফা উদারভাবে খাতা মূল্যায়নের জন্য চাপ দিতেন। শিক্ষার্থীরা ফেল করলে পরীক্ষকদের শাস্তি পেতে হবে বলেও হুমকি দেওয়া হতো। ফলে শিক্ষকরা উদার হস্তে নম্বর দিতেন।
জানা যায়, পরীক্ষক হতে না পারলে একজন শিক্ষকের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হয়। এতে তাঁর কোচিং-প্রাইভেটে প্রভাব পড়ে। ফলে সব শিক্ষকই পরীক্ষক হতে চান। এ ছাড়া বেতন-ভাতার বাইরে খাতা দেখা থেকেও পরীক্ষকরা অর্থ পান। ফলে বোর্ডের নির্দেশনা অনুসারে এত দিন উদারভাবে নম্বর দিতে বাধ্য হতেন পরীক্ষকরা।
কয়েকজন পরীক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নম্বর দেওয়ার ক্ষেত্রে এত দিন বেশ কিছু অলিখিত নিয়ম-কানুন ছিল। কোনো শিক্ষার্থী ২০ নম্বরের বেশি পেলে তাকে পাস করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। ৬০-এর বেশি পেলে তাকে ৭০ বানিয়ে ‘এ’ গ্রেড, ৫০-এর বেশি পেলে তা ৬০ বানিয়ে ‘এ মাইনাস’, ৪০-এর বেশি পেলে ৫০ বানিয়ে ‘বি’ গ্রেড এবং ৩০-এর বেশি পেলে ৪০ বানিয়ে ‘সি’ গ্রেড করা হয়েছে। আর ৭০-এর বেশি নম্বর পেলে সব সময় চেষ্টা থাকে তাকে জিপিএ ৫, অর্থাৎ ৮০ নম্বর দেওয়ার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মনিনুর রশিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রতিটি সরকার চায় পাসের হার ও জিপিএ ৫ বাড়াতে। এ জন্য ওভারমার্কিং করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। বাচ্চারা যা লিখবে তাতেই নম্বর দিতে বলা হয়। ফলে যে এ প্লাস পাওয়ার যোগ্য নয় সে-ও পেয়ে যায়। গত ১৫ বছর এটা বেশি হয়েছে। শিক্ষার্থীরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসে তখন ৯০ শতাংশই পাস করে না। এতে মার্কিংয়ের গলদ বোঝা যায়। অথচ সরকার এই পাসের হার বাড়ানোকে তাদের সফলতা মনে করে। আসলে এটা একটা আত্মঘাতী কাজ, বুমেরাং আইডিয়া। এর লাগাম টানা দরকার।’
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মনিনুর রশিদ বলেন, ‘এখন আমাদের কাজ শিক্ষার মান নিশ্চিত করা। তবে প্রথমে ক্লাসে পড়ালেখা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু আমাদের শিক্ষকরা কম বেতন পান। ফলে তাঁরা ক্লাসে না পড়িয়ে প্রাইভেট-কোচিংয়ে পড়ান। আমাদের ভালো শিক্ষক নিতে হবে। কিন্তু তাঁরা তো কম বেতনে আসবেন না। এ জন্য শিক্ষকদের বেতন বাড়াতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষকদের জবাবদিহিও নিশ্চিত করতে হবে।’