Image description

আসছে বাজেটের ঘাটতি মেটাতে সরকার ব্যাংক ঋণ নির্ভরতার ওপর ঝুঁকছে। চলতি অর্থবছরের মতো আগামী অর্থবছরে সরকার বিপুল পরিমাণ ব্যাংক ঋণ করার পরিকল্পনা ঠিক করছে। যা ঘাটতির ৫০ শতাংশ এবং মোট বাজেটের ১৫ শতাংশ। তবে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম।

 

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার হতে পারে ৭ লাখ ৯০ হাজার টাকা। বিশাল অঙ্কের এ বাজেটের ঘাটতি ধরা হচ্ছে দুই লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। এ ঘাটতি পূরণে দেশি-বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নেওয়া হবে। এর ধারাবাহিকতায় বিশাল ঘাটতি পূরণে প্রধান ভরসাস্থল হিসেবে এবারও ব্যাংক ঋণ করবে বলে ঠিক করেছে সরকার।

বাজেট প্রণয়নের দায়িত্বে থাকা অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আগামী বাজেটে এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার। এই অঙ্ক চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা কম।

 

চলতি অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে এক লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছিল সরকার; তবে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রায় এটি কমিয়ে ৯৯ হাজার কোটি টাকা ঠিক করা হয়েছে। যদিও চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে সরকার ব্যাংক খাত থেকে ৫৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে।

 

কর, শুল্ক ও ভ্যাট খাতে যত পরিবর্তন হতে পারে

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, সবসময় দেখা যায় অর্থবছরের শেষ দিকে সরকারের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বেড়ে যায়। কারণ এই সময়ে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প ও বাজেট বাস্তবায়নের জন্য বেশি টাকার প্রয়োজন হয়। তবে চলমান অর্থবছরে এখন পর্যন্ত সরকার যত ঋণ নিয়েছে, তা আগে থেকে ঠিক করা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন সরকারের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে সতর্ক করেছেন। এ বিষয় ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেছেন, আগামী অর্থবছরে সরকার ব্যাংক থেকে যে পরিমাণ ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে তা বর্তমান বছরের তুলনায় বেশি হবে। কারণ, এখন পর্যন্ত সরকার ব্যাংক থেকে ৫৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে এবং বছরের শেষে আরও ২০-৩০ হাজার কোটি টাকা নিতে পারে। কিন্তু আগামী বছরের লক্ষ্যমাত্রা এর চেয়ে বেশি হওয়ায় সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।

হিসাব বিশ্লেষণ করে ড. হোসেন জানান, গত ১২ মাসে ব্যাংকিং খাতে আমানত বেড়েছে প্রায় এক লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। সরকার যদি এর মধ্যে থেকে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে নেয়, তাহলে বেসরকারি খাতের জন্য মাত্র ২৫ হাজার কোটি টাকা অবশিষ্ট থাকবে। এই পরিমাণ অর্থ বেসরকারি খাতের জন্য অত্যন্ত অপ্রতুল।

 

তিনি আরও উল্লেখ করেন, সরকার ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছে। কিন্তু বাস্তবে রাজস্ব আয় ৫ লাখ কোটি টাকার বেশি হবে না। বৈদেশিক সহায়তা এক লাখ কোটি টাকা এবং ব্যাংক ঋণ এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা ধরা হলে প্রকৃত বাজেট ৭ লাখ ২০-৩০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত। এর বেশি বাজেট করলে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না।

ড. জাহিদ হোসেন স্পষ্ট করে বলেন, সরকার যখন ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নেয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমে যায়। বিশেষ করে যখন সরকারি ঋণের সুদের হার ১১-১২ শতাংশ, যা ব্যাংকগুলোর জন্য ঝুঁকিহীন ও লাভজনক। ফলে ব্যাংকগুলো স্বভাবতই বেসরকারি খাতের চেয়ে সরকারি খাতে ঋণ দিতে বেশি আগ্রহী হয়। এ অবস্থায় সরকারের উচিত সতর্কতার সঙ্গে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা এবং অর্থনীতিতে এর প্রভাব বিবেচনা করা।

চলতি অর্থবছরে সরকারের ঋণ সংগ্রহের জন্য মোট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে ২ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিদেশি ঋণ থেকে অর্থ জোগানের পরিকল্পনা ৯০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। আর দেশের ভেতর থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করা আছে প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এই অভ্যন্তরীণ ঋণের মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশ আসবে ব্যাংকিং খাত থেকে, যার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। বাকি টাকা সরকার সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য উৎস থেকে সংগ্রহ করার কথা রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকে বড় রদবদল

আগামী অর্থবছরের জন্য মোট ঋণের লক্ষ্যমাত্রায় পরিবর্তন আসছে

বিদেশি ঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা ধরা হচ্ছে, যা বর্তমান লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। অন্যদিকে দেশি ঋণের পরিমাণ হবে প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। এই অভ্যন্তরীণ ঋণের সিংহভাগই আসবে ব্যাংকিং খাত থেকে, যেখানে সর্বোচ্চ এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হচ্ছে। আর সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য খাত থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা নেওয়ার কথা ভাবছে সরকার। এর মধ্যে সঞ্চয়পত্রের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ১২ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাত থেকে ৮ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের কথা চিন্তা করছে। যদিও চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের পরিকল্পনা ঠিক করা আছে সরকারের।  

সরকারের ব্যাংক ঋণ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ব্যাংক খাত থেকে সরকার কত টাকা ঋণ নেবে, এটা তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ ক্ষেত্রে পরামর্শ দিয়ে থাকে, এবারও দেবে।

মুখপাত্র জানান, দেশে সম্প্রতি একটা সফল বিনিয়োগ সম্মেলন হয়েছে। এটি এখন বাস্তবায়নের সময় আসছে। বিদেশি বিনিয়োগকারী আসলে এ দেশের একটি প্রতিনিধি থাকে যাদের মাধ্যমে তারা ব্যবসা করে। এখন দেশীয় উদ্যোক্তারা যদি বিনিয়োগের সময় পর্যাপ্ত ঋণ না পান তাহলে এই প্রক্রিয়াটা ব্যাহত হবে। এমন পরিস্থিতিতে প্রত্যাশা থাকবে সরকার এমন মাত্রায় ঋণ নেবেন না, যেটা বেসরকারি খাতে পর্যাপ্ত অর্থ সরবরাহে বাধা সৃষ্টি করে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ে ৫৪ নিয়োগ, আবেদন করা যাবে এইচএসসি পাসেই

আগামী ২ জুন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট পেশ করতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। এই বাজেটে সরকারের ব্যয় কমিয়ে আনা হবে এবং নতুন কোনো বড় প্রকল্প নেওয়া হবে না বলে জানা গেছে। মূল লক্ষ্য থাকবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও রাজস্ব ঘাটতি কমানো।

 

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আসন্ন বাজেটে নিত্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখা এবং সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা রক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ টেলিভিশন ভাষণে বাজেট উপস্থাপন করবেন।

প্রসঙ্গত, বর্তমানে দেশে মূল্যস্ফীতি ৯ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে অবস্থান করছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি কমাতে নীতিহার সুদ বাড়ানো, আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা এবং রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করার মতো পদক্ষেপ নিয়েছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, এসব ব্যবস্থার প্রভাবে মূল্যস্ফীতির চাপ কমতে শুরু করেছে।

আসন্ন বাজেটে সরকার দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এবার বয়স্ক ভাতা, বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা নারীদের ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতাসহ বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির অর্থপ্রদানের পরিমাণ কিছুটা বাড়াবে সরকার। পাশাপাশি নতুন করে আরও বেশি সংখ্যক মানুষকে এসব ভাতার আওতায় আনা হবে।