Image description

সর্ব উত্তর-পশ্চিমের জেলা ঠাকুরগাঁও মূলত বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের এলাকা হিসেবে পরিচিত। এখানে জাতীয়তাবাদী ভোটারও বেশি। কিন্তু দেড় যুগ ধরে রাজত্ব করেছে জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগ।

এর পেছনে ছিল প্রায় এক-তৃতীয়াংশ হিন্দু ধর্মাবলম্বীর সমর্থন। তাদের জুজুর ভয় দেখিয়ে ও ভুল বুঝিয়ে স্বার্থ উদ্ধার করেছে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ। তবে জুলাই বিপ্লবে তাদের মানসিকতায় ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। প্রথমদিকে গুজবে কান দিয়ে কিছু পরিবার ভারতে পালিয়ে গেলেও ধীরে ধীরে নতুন বাংলাদেশের প্রতি আস্থা রাখছে হিন্দুরা।

ঠাকুরগাঁওয়ের পাঁচ উপজেলা নিয়ে তিনটি সংসদীয় আসন গঠিত। আসনগুলোতে ইতোমধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আমেজ বিরাজ করছে। ভোটের মাঠে মুখ চেনাতে শুরু করেছেন বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), খেলাফত মজলিস, গণঅধিকার পরিষদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। মনোনয়নপ্রত্যাশীদের ছবিসংবলিত ব্যানার, পোস্টার ও ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে পুরো জেলা। মিছিল, সভা-সমাবেশসহ বিভিন্ন গণসংযোগে ব্যস্ত সময় পার করছেন প্রার্থীরা।

ঠাকুরগাঁও-১ (সদর)

এটি ভিআইপি আসন হিসেবে পরিচিত। এখানে চার রাজনীতিক এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। তাদের মধ্যে তিনজনই মন্ত্রিত্ব পেয়েছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরল ইসলাম আলমগীর। সবচেয়ে হেভিওয়েট নেতা হিসেবে দলে তার কোনো প্রতিন্দ্বন্দ্বীও নেই। ইতোমধ্যে তার পক্ষে নানাভাবে প্রচার চালিয়ে ভোটের মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন দলটির নেতাকর্মীরা। জনসমর্থনেও তিনি এগিয়ে থাকবেন বলে তৃণমূলের বিশ্বাস।

মির্জা ফখরুলকে আওয়ামী সরকারের আমলে কয়েকবার কারাবরণ করতে হয়েছে। জেলজুলুম-অত্যাচার ও শতাধিক মামলা কাঁধে নিয়ে দীর্ঘ ১৭ বছর ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন তিনি। অনেক ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও তার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ ছিলেন বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীরা। এবার তার পক্ষে ভোটের জোয়ার তৈরি করতে চান তারা। ইতোমধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন নানা কর্মসূচি নিয়ে। মির্জা ফখরুল জয়ী হয়ে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে গিয়ে এলাকায় উত্তরোত্তর উন্নয়ন করবেন বলে আশায় বুক বাঁধছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।

ধানের শীষের কান্ডারীর সঙ্গে ভোটযুদ্ধ হবে আরেক হেভিওয়েট প্রার্থীর। তিনি ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি, ঠাকুরগাঁও উন্নয়ন ফোরামের চেয়ারম্যান, জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সদস্য ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি দেলোয়ার হোসেন। তার পক্ষে ব্যাপক প্রচার চালাচ্ছেন দলের নেতাকর্মীরা। ব্যানার-পোস্টারের মাধ্যমে দিচ্ছেন বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি ও আশ্বাস।

ফ্যাসিবাদী আওয়ামী দুঃশাসনের অন্যতম ভুক্তভোগী দেলোয়ার হোসেন। তিনি ছাত্রশিবিরের সভাপতি থাকাকালে গ্রেপ্তার করে অমানবিক নির্যাতন করা হয়। থানায় থানায় নিয়ে পেটানো হয়েছিল কয়েক মাস ধরে। বছরের পর বছর রাখা হয় কারাগারে। অন্তত দেড়শ মামলা কাঁধে নিয়ে আদালত থেকে আদালতে ছুটেছেন অন্তত এক দশক।

দেলোয়ার হোসেন বলেন, আগে এইআসনে তিনটি দলের শাসন মানুষ দেখেছে। তারা কেউ সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, মাদক ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ উপহার দিতে পারেনি। এজন্য জনগণ সৎ, দক্ষ, দেশপ্রেমিক ও আল্লাভিরু প্রার্থীর অপেক্ষায় আছে। তাদের প্রত্যাশা পূরণে আমরা কাজ করছি।

এছাড়া অন্য দলের নেতাদের তেমন অবস্থান নেই। তাদের দু-একটি কর্মসূচি চোখে পড়লেও ভোটযুদ্ধে লড়তে কোনো নেতা তৈরি হয়েছেন বলে এখন পর্যন্ত জানান দিতে পারেননি।

আসন-২ (হরিপুর ও বালিয়াডাঙ্গী)

এ আসনে বিএনপি থেকে ধানের শীষ চাইছেন দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য ও জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মির্জা ফয়সাল আমিন, কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য ও সাবেক সংসদ সদস্য জুলফিকার জেড মর্তুজা চৌধুরী (তুলা), ড্যাবের সাবেক মহাসচিব ডা. আবদুস সালাম এবং জেলা বিএনপির সহসভাপতি ফয়জুল ইসলাম হিরু।

মির্জা ফখরুলের ভাই ও সাবেক মন্ত্রী মির্জা ফয়সাল এখানে অন্যতম শক্তিশালী মনোনয়নপ্রত্যাশী। অন্যরাও স্থানীয়ভাবে বেশ জনপ্রিয়। তারা সবাই নানা কর্মসূচির মাধ্যমে ভোটে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। জনগণের যাওয়া, নানা প্রতিশ্রুতি দেওয়া এবং বিভিন্ন সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে ব্যস্ত থাকছেন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত।

ফয়সাল আমিন বলেন, ‘স্থানীয় জনগণের প্রত্যাশা ও দলীয় সিদ্ধান্তের বিষয়সহ সবকিছু বিবেচনায় রেখে বলতে চাই, এ আসনে আমাকে মনোনয়ন দিলে এলাকা মানুষের জন্য কাজ করার সুযোগ পাব।’

জুলফিকার বলেন, ‘মাঠপর্যায়ে আমি পরীক্ষিত ও দুবারের এমপি। দলের আমার প্রতি আস্থা আছে। আশা করছি, আমি মননোয়ন পাব।’

ডা. সালাম বলেন, ‘দল যা সিদ্ধান্ত নেবে সেটা মেনে আমাদের এক হয়ে এ আসনে ধানের শীষের বিজয় ছিনিয়ে আনতে হবে।’

জামায়াত এখানে জেলা শাখার সাবেক আমির এবং দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁও আঞ্চলিক টিম সদস্য মাওলানা আবদুল হাকিমকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। তিনি ব্যাপক কর্মসূচির মাধ্যমে গণসংযোগ করছেন। বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে গিয়ে করছেন ভোটারদের মন জয়।

এছাড়া গণঅধিকার পরিষদ থেকে মনোনয়ন চাইছেন দলটির মুখপাত্র ফারুক হোসেন। তিনি এলাকায় বেশ জোরালোভাবে গণসংযোগ চালাচ্ছেন। অন্যদলের তেমন তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না।

ফারুক হোসেন বলেন, ‘এখন তরুণদের সময়, তাদের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনে আসনটি আমরা পাব বলে বিশ্বাস করি।’

ঠাকুরগাঁও-৩ (পীরগঞ্জ ও রানীশংকৈল)

আসনটি দলকে উপহার দিতে ধানের শীষ প্রত্যাশা করছেন পীরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য জাহিদুর রহমান, যুবদলের কেন্দ্রীয় নেতা কামাল আহম্মেদ আনোয়ার, জেলা বিএনপির সহসভাপতি ওবায়দুল্লাহ মাসুদ, পীরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জিয়াউর রহমান জিয়া, জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদিন এবং রানীশংকৈল উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আল ওয়াদুদ বিন নুর আলিফ।

জাহিদুর রহমান বলেন, ‘সবার আগে বাংলাদেশ। আগামীর নির্বাচন বাংলাদেশকে সাজানোর চ্যালেঞ্জিং নির্বাচন। ভোট দিতে জনগণ মুখিয়ে আছে। তাদের সমর্থন নিয়ে বিএনপি সরকার গঠন করবে। আর দলে আমার ত্যাগ ও অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে এবার ধানের শীষের নমিনি আমাকেই করা হবে বলে দৃঢ় বিশ্বাস আছে।’

জামায়াত এখানে রানীশংকৈল উপজেলা শাখার নায়েবে আমির ও উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে।

মিজানুর রহমান বলেন, ‘দেড় যুগ ধরে মানুষ ভোট দিতে পারছে না। তাদের প্রত্যাশা পূরণে ঘনিয়ে আসছে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন। এবার জনগণ চায় সত্যিকারের পরিবর্তন। চাঁদাবাজ, সন্ত্রাস ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে। এ কারণে সবার নজর জামায়াত প্রার্থীদের দিকে। তাদের সমর্থন নিয়ে দাঁড়িপাল্লার বিজয় হবে বলে আমরা মনে করছি।’

এছাড়া এনসিপির যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক ও রানীশংকৈলের সন্তান গোলাম মুর্তজা সেলিম, গণঅধিকার পরিষদের মামুনুর রশিদও নানাভাবে প্রচার চালাচ্ছেন।

গোলাম মুর্তজা বলেন, ‘আগামীর বাংলাদেশ তরুণনির্ভর হবে। এটা জনগণও চায়। সারা দেশে তরুণ্যের গণজোয়ার উঠেছে। তাদের প্রতিনিধিত্ব করার জন্যই প্রার্থী হয়েছি।’

[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন হরিপুর প্রতিনিধি কবিরুল ইসলাম কবির, বালিয়াডাঙ্গী প্রতিনিধি রমজান আলী, পীরগঞ্জ প্রতিনিধি জয়নাল আবেদিন বাবুল ও রানীশংকৈল প্রতিনিধি মোবারক আলী]