
নির্বাচনি ট্রেনের যাত্রা শুরু হয়ে গেছে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই এখন রাজনীতি আবর্তিত। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত এখন নির্বাচনের আলোচনাই প্রাধান্য পাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখন প্রার্থীতা নিয়ে চলছে জোর তৎপরতা। পাশাপাশি দলগুলো কার সঙ্গে কে জোট করবে সেই তৎপরতাও চালাচ্ছে। সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিজ নিজ আসন নিশ্চিত করার জন্য দলগুলোর উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের অফিসে ও বাড়িতে দৌড়ঝাঁপ করছেন। দলগুলোর পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনের ব্যস্ততাও এখন আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেড়ে গেছে। কারণ নির্বাচনে মূল কাজটা নির্বাচন কমিশনই করবে। প্রশাসন বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও নির্বাচনের বিষয়টিকেই তাদের অগ্রাধিকারের মধ্যে রেখেছে। নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায় ৮ লাখ সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন। এর মধ্যে সেনাবাহিনীর সদস্য থাকবে ৬০ হাজার। আরো বেশি সদস্য প্রয়োজন হলে সরকার তারও ব্যবস্থা করবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রোববার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, পুলিশের জন্য ৪০ হাজার বডিইন ক্যামেরা বা বডিক্যাম ক্রয় করবে। ভোটকেন্দ্রগুলোতে সিসি ক্যামেরাও থাকবে।
অর্ন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবসে গত ৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে ভাষণে নির্বাচনের সময়সীমা আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ঘোষণা করে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশন বরাবর চিঠি দেন। চিঠি পেয়ে নির্বাচন কমিশন তাদের তৎপরতা শুরু করে দিয়েছে। সিইসি এএমএম নাসির উদ্দীন দেশব্যাপী তার সফর শুরু করেছেন। রংপুরে সফরে গিয়ে তিনি বলেছেন, আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন হবে। কমিশন ডিসেম্বরে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করবে। সেখানে সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরো বলেছেন, আগামী নির্বাচনের বড় চ্যালেঞ্জ হবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। তবে আগের চেয়ে অবস্থা এখন ভালো।
আগামীতে আরো ভালো অবস্থা আমরা দেখতে চাই। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রিসাইডিং অফিসার, সবাই মিলে সুষ্ঠু একটি নির্বাচনি পরিবেশ তৈরি করতে হবে। বিগত তিনটি ভুয়া নির্বাচনের ফলে মানুষ ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার অভ্যাস ভুলে গেছে। মানুষকে নির্বাচনের কেন্দ্রমুখী করতে হবে। এই চ্যালেঞ্জ সবাইকে নিয়েই মোকাবিলা করতে হবে। নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে হালনাগাদ খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করেছে। এই তালিকায় ৩০ জুন পর্যন্ত ভোটার সংখ্যা ১২ কোটি ৬১ লাখ ৭০ হাজার ৯০০ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৬ কোটি ৪০ লাখ ৬ হাজার ৯১৬ জন এবং নারী ভোটার ৬ কোটি ২১ লাখ ৬২ হাজার ৭৬০ জন।
এর আগে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণেও ড. মুহাম্মদ ইউনূস সুষ্ঠু, সুন্দর নির্বাচনের জন্য করণীয় সম্পর্কে সংশ্লিষ্টদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ফেব্রুয়ারিতে রোজার আগেই ভোট হবে। ঘোষণাপত্র, জুলাই সনদ, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত হত্যার বিচার, সংস্কারসহ বিভিন্ন প্রেক্ষাপট তিনি তার ভাষণে তুলে ধরে বলেন, এবার আমাদের সর্বশেষ দায়িত্ব পালনের পালা। সেটা হলো নির্বাচন অনুষ্ঠান। এ নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা একটা নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু করবো। সুন্দরভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান করে এদেশের সব নাগরিক যেন ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার কাজে সফলভাবে এগিয়ে যেতে পারে সে চেষ্টা করতে হবে। এই নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ এবং উৎসবমুখরভাবে অনুষ্ঠিত হতে পারে সে জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সাহায্য-সহযোগিতার কথাও বলেন তিনি। ড. ইউনূস এ ব্যাপারে সতর্কও করেন যে, একটি গোষ্ঠী নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার জন্য উন্মুখ। তাদের সেই অপচেষ্টা ভণ্ডুল করে দিতে হবে সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায়।
প্রধান উপদেষ্টার নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণাকে বিএনপিসহ বিভিন্ন দল স্বাগত জানিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে বিএনপি নির্বাচনি সড়কে ওঠার আনুষ্ঠানিক বার্তাও দিয়েছে ভোটারদের কাছে। তবে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও ইসলামী আন্দোলন জুলাই ঘোষণাপত্র ও নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণা সংক্রান্ত কিছু বিষয়ে মনঃক্ষুণ্ণতা প্রকাশ করেছে। দল তিনটি ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের ঘোষিত সময়সীমা নিয়ে আপত্তি করেনি।
চব্বিশের গণআন্দোলন পরবর্তী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই তিনটি দল বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। তারা সুষ্ঠু নির্বাচনে সবার জন্য ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরির জোর দাবি জানাচ্ছে। দলগুলো জুলাই সনদ এবং সাংবিধানিক কিছু বিষয় নিয়েই বেশি তৎপর। সংস্কারের যে বিষয়গুলো ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই সনদে সন্নিবেশিত করা হবে, সেগুলো এখন থেকেই বাস্তবায়নের দাবি জানাচ্ছে তারা। এর আগে প্রস্তাব করা হয়েছিল নির্বাচিত সরকার দুই বছরের মধ্যে সংস্কারগুলো সম্পন্ন করবে। ঐকমত্য কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তৃতীয় দফার আলোচনা হবে। সেই আলোচনায় চূড়ান্ত হবে জুলাই সনদ।
জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছে, জুলাই সনদ কার্যকর করতে হবে নির্বাচনের শুরু থেকে। এর ভিত্তিতে নির্বাচন হবে এবং এর ভিত্তিতেই নির্বাচিত সরকার পরিচালিত হবে। তবে প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে সংবিধান সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে। নতুন সংসদ না আসা পর্যন্ত এবং সংবিধান সংশোধন করে এগুলো সংবিধানে সংযোজন না করা পর্যন্ত তো জুলাই সনদ কার্যকর করা যাবে না।
নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে এ বিষয়টিই অস্বস্তিকর মনে হচ্ছে। কারণ এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ঘোষণা করেছেন, জুলাই সনদ সঠিকভাবে প্রণীত না হলে তারা এ সনদে স্বাক্ষর করবেন না এবং নির্বাচনও করবেন না। জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানের সফল বাইপাস সার্জারি হয়েছে। হাসপাতাল থেকে তিনি কিছুদিনের মধ্যেই রাজনৈতিক অঙ্গনে ফিরে আসবেন। এ সংকটের সমাধান কীভাবে হবে সেটা তখনই বোঝা যাবে।
তবে শেষ পর্যন্ত সবকিছুই ভালোয় ভালোয় হবে বলে রাজনৈতিক দলগুলো আশা করে। তাদের বক্তব্য, রাষ্ট্র সংস্কার বিষয়ে অন্তত ১৯টি মৌলিক বিষয়ে যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হতে পেরেছে, সেখানে আর দু-একটি বিষয়েও একমত হতে পারবে। সেই ঐকমত্য অবশ্যই হবে, এমন আশা করেছেন ঐকমত্য কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেছেন, জুলাই সনদের বাস্তবায়ন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ মত নেওয়া হবে। সবার সম্মতিতে জুলাই সনদ স্বাক্ষর হয়ে গেলে আশা করা যায় নির্বাচনি ট্রেনের যাত্রা কেউ থামিয়ে দিতে পারবে না।
নির্বাচনের সময় ঘোষণা ইতোমধ্যে রাজনীতিতে একধরনের স্বস্তি এনেছে। রাজনৈতিক দলগুলো যেহেতু নির্বাচনী রোড ম্যাপ পেয়ে গেছে, এখন তাদের কাজ হবে নিজ নিজ এজেন্ডা নিয়ে মাঠে নামা। জুলাই সনদ স্বাক্ষরের পর তারা তাদের ইশতেহারে জনগণের চাওয়া কতোটা তুলে ধরতে পারবে সেটা দেখার বিষয়। আগেই বলেছি, রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য মৌলিক কতগুলো বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। জনগণের চাওয়া হচ্ছে, দলগুলো তাদের ইশতেহারে সেগুলো তুলে ধরবে। দেশে বিপুল সংখ্যক শিক্ষিত তরুণ এখন বেকার। এই বেকার তরুণদের কর্মসংস্থানের জন্য কী ধরনের কর্মসূচি দলগুলো নেবে সেই কথা ইশতেহারে তুলে ধরলে জনগণ বুঝতে পারবে ইশতেহার জনবান্ধব কতোটা। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অর্ন্তবর্তী সরকার গত ৮ আগস্ট তাদের এক বছর পূর্ণ করেছে। এই এক বছরে তারা কী কী করেছে তার একটি বিবরণ প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে প্রতিফলিত হয়েছে। তেমনি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবও সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, সরকার কী করছে। এখন রাজনৈতিক দলগুলোর পালা। তারা কী ধরনের নির্বাচন করবে এবং কীভাবে দেশ পরিচালনা করবে সেটা দেখার পালা।
বিএনপি বড় দল। সব রাজনৈতিক দলকে আস্থায় নিয়ে কীভাবে নির্বাচনি বৈতরণী পার করবে তা জনগণ লক্ষ করবে। অবশ্য বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্যে মানুষ আশান্বিত। ইতোমধ্যে তিনি তার দলের নেতাদের উদ্দেশে বলেছেন, এমন বক্তব্য দেবেন না যাতে একে অপরের মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়। তিনি অনেকগুলো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সিরিজ বৈঠক করেছেন। এসব বৈঠকে তিনি গণতন্ত্রে উত্তরণ এবং দেশের ভালো অর্থাৎ সুন্দর বাংলাদেশ নির্মাণের জন্য সবাইকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠনের কথা ঘোষণা করেছেন। এই বক্তব্যে সর্বত্র আশার সঞ্চার হয়েছে। নির্বাচনি ট্রেনের যাত্রা বাধাহীনভাবেই এগিয়ে যাবে—এর লক্ষণ ফুটে উঠেছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ইতিহাসসেরা নির্বাচনটির দিকে তাকিয়ে আছে সারা দেশ।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, আমার দেশ