
সরকারি মালিকানাধীন ও সরকারের শেয়ার রয়েছে এমন ৩৬টি প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করে সেগুলোর শেয়ার পুঁজিবাজারে ছাড়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ২০০৮ সালে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১০ সালের মধ্যে শেয়ার ছাড়ার আলটিমেটামও দিয়েছিলেন। শেষে যৌথ মালিকানাধীন বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর তালিকাভুক্তি নিয়ে জটিলতা দেখা দেওয়ায় ৩৪টির মধ্যে সরকারি ২৬টি কোম্পানিকে শেয়ার ছাড়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
গত ১৭ বছরে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে মাত্র পাঁচটি প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। বাকি ২১ প্রতিষ্ঠান নির্দেশনা মেনে পুঁজিবাজারে আসতে ব্যর্থ হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, দুর্নীতি, অনিয়মের কারণে সরকারি কিছু প্রতিষ্ঠান লোকসানে চলছে। মূলধন সংকটে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। কিন্তু শেয়ার অপলোডের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বছরের পর বছর ধরে গড়িমসি করেছে এসব কোম্পানিতে থাকা সরকারি আমলা ও পরিচালকরা। বিগত সরকারের আমলে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তি এড়াতে অনেক সময় কোম্পানিসংশ্লিষ্টরা অর্থ মন্ত্রণালয়কে পাশ কাটিয়ে ধরনা দেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও। তবে এবার খোদ সরকারপ্রধান নির্দেশনা দেওয়ায় আশার আলো দেখছেন বিনিয়োগকারীরা। ক্ষমতার শীর্ষ পর্যায় থেকে ঘোষণা আসায় বিনিয়োগকারীরা মনে করছেন, আমলাতন্ত্রের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে এসে সরকারি কোম্পানিগুলো এবার শেয়ার ছাড়তে বাধ্য হবে। বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)-এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সরকারি কর্মকর্তারা এসব প্রতিষ্ঠান থেকে কিছু সুবিধা পান বলে তারা বেসরকারি খাতে শেয়ার ছাড়তে চান না। এবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পুঁজিবাজার নিয়ে বৈঠক করে যেসব নির্দেশনা দিয়েছেন, তার মধ্যে সরকারি কোম্পানিগুলোর শেয়ার ছাড়ার বিষয়টি রয়েছে। খোদ সরকারপ্রধান নির্দেশনা দেওয়ায় কোম্পানিগুলোর শেয়ার পুঁজিবাজারে আসবে বলে আশা করা যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির সাবেক এই অধ্যাপক বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু নামকাওয়াস্তে শেয়ার ছাড়লে হবে না। অর্ধেকের বেশি, অন্ততপক্ষে ৫১ শতাংশ শেয়ার ছাড়লে বেসরকারি খাত এসব শেয়ার নিতে আগ্রহী হবে। কারণ অনেক কোম্পানির জমি ও অব্যবহৃত মেশিনারিজ রয়েছে- যা বেসরকারি খাত কাজে লাগাতে পারবে। এর ফলে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারের দামও বাড়বে। কিছু কোম্পানি আছে লোকসানি, সরকারি ভর্তুকিতে চলে-সেগুলোও লাভজনক হবে। আইসিবি থেকে সরকারি কোম্পানিগুলোর তালিকা এরই মধ্যে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি (বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন)-এ পাঠানো হয়েছে বলেও জানান তিনি। জানা গেছে, ২৬ কোম্পানির মধ্যে যে পাঁচটি কোম্পানি শেয়ার ছাড়তে পেরেছে সেগুলো হলো- যমুনা অয়েল কোম্পানি, মেঘনা পেট্রোলিয়াম, ইস্টার্ন লুব্রিকেন্টস, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন ও রূপালী ব্যাংক।
শেয়ার ছাড়ার জন্য নির্দেশিত বাকি ২১ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ১১টি; ডাক, তার ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের পাঁচটি, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের ৩টি এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের একটি করে কোম্পানি রয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো : প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসপি), এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড, টেলিটক বাংলাদেশ লিমিটেড, বিটিসিএল, বাংলাদেশ ক্যাবল শিল্প লিমিটেড, টেলিফোন শিল্প সংস্থা, সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানি লিমিটেড, বাংলাদেশ সার্ভিসেস লিমিটেড, হোটেল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, বিমান বাংলাদেশ লিমিটেড, ডেসকো, লিক্যুফাইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস লিমিটেড, বাখরাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড, গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড, জালালাবাদ গ্যাস টিএন্ডটি সিস্টেম লিমিটেড, পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড, সিলেট গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড, বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড, তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড। এর মধ্যে ৩টি কোম্পানি শেয়ার ছাড়ার প্রস্তুতি নিলেও বাকিগুলোর কোনো প্রস্তুতি নেই। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, সরকারি কোম্পানির শেয়ার ছাড়ার বিষয়ে এখনই কোনো টাইমলাইন দেওয়া যাবে না। কিছু বাস্তবতা আছে। প্রধান উপদেষ্টা চান অর্থপূর্ণ সংস্কার, যাতে যারা বিনিয়োগ করেছেন তাদের সবার স্বার্থ সুরক্ষিত হয়- সে লক্ষ্যেই পুঁজিবাজার সংস্কার হবে।