
মানিকগঞ্জে আলোচিত-সমালোচিত মমতাজ বেগম। গানের জগতে জনপ্রিয়তা থাকলেও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে পদার্পণ করার পর থেকেই বিতর্কিত হয়ে পড়েন এই কণ্ঠশিল্পী। আওয়ামী লীগ সরকারের জামানায় জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে তার নির্বাচনী এলাকার সভা সমাবেশে শেখ হাসিনাকে নিয়ে গান এবং চাটুকারিতায় ব্যস্ত থাকতেন। এখন তার ঠিকানা কারাগারে। ১৬ বছরের তার নির্বাচনী এলাকায় একক রাজত্ব কায়েম করে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। নিজের গ্রাম থেকে শুরু করে রাজধানী ঢাকা এমনকি দেশের বাইরে কানাডার টেরন্টোতে রয়েছে বিলাসবাহুল বাড়ি-গাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মমতাজের ইশারাতেই চলতো তার নির্বাচনী এলাকা মানিকগঞ্জ-২ আসন অর্থাৎ সিংগাইর ও হরিরামপুর উপজেলার সবকিছু। দুই উপজেলাতেই ছিল তার নিজস্ব বাহিনী। তাদের হুকুমই ছিল সেখানকার আইন। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, দখলবাজি, চাকরি বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্য, দলীয় পদ বাণিজ্য, স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে দলীয় মনোনয়ন বাণিজ্য, পারিবারিকতন্ত্র, পদ্মা নদী থেকে অবৈধ বালু লুটসহ সব অপকর্মের সম্রাজ্ঞী ছিলেন মমতাজ। পুলিশ প্রশাসনও ছিল তার হাতের মুঠোয়। শুধু তাই নয় একের পর এক বিয়ে করাটাও ছিল তার নেশা। কাগজে-কলমে তিনটি বিয়ে করলেও কোনো স্বামীর সংসারই করতে পারেননি। এমনকি সর্বশেষ তার এপিএস জুয়েলের সঙ্গেও তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে যা সিংগাইরবাসীর কাছে অজানা নয়। মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার জয়মন্টপ ইউনিয়নের তার গ্রামের বাড়ি। এক সময়কার হতদরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা মমতাজ গানের জগত থেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে পদার্পণ করে চমক দেখান।
২০০৯ সালে সংরক্ষিত নারী আসনে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৪ ও ২০১৮ সালের বিতর্কিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সংসদ সদস্য হওয়ার পর থেকেই তার ভেতরে চলে আসে দাম্ভিকতা। টানা ১৬ বছর সিংগাইর ও হরিরামপুর উপজেলা শোষণ করেছেন এক হাতে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও তার কথায় উঠতেন-বসতেন। তার বিরুদ্ধাচারণ করলেই দলীয় পদ বঞ্চিত করা হতো নেতাকর্মীদের। মমতাজের অপকর্মের প্রধান খলিফা ছিলেন সিংগাইর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শহীদুর রহমান শহীদ। সম্পর্কে মমতাজের প্রথম স্বামী রশিদ সরকারের আপন ভাগ্নে। মমতাজ নিজেই সিংগাইর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদ দখলের পাশাপাশি তার কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক করেছেন পরিবারের সদস্য শহীদুর রহমান শহীদকে। এ নিয়ে দলের ভেতর চরম বিভক্তি বিরাজ করে আসছিল।
শহীদকে দিয়েই মূলত সব ধরনের অপকর্ম চালাতেন মমতাজ। এলাকায় তার ছিল হেলমেট বাহিনী।
সিংগাইর পৌরসভা এলাকায় একক আধিপত্য বিস্তারের জন্য মমতাজ তার সৎ ছেলে আবু নাঈম বাশারকে ভোট চুরির মাধ্যমে সিংগাইর পৌরসভার মেয়র বানিয়েছিলেন। উপজেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মমতাজের ছোট মেয়ে রাইসা রোজ ও নিজ ইউনিয়ন জয়মন্ডপ ছাত্রলীগের সভাপতি তার বড় ভাই এমারত হোসেনের ছেলে ফিরোজ কবির। তার এক সৎ বোন ইউপি সদস্য। শুধু তাই নয় উপজেলা আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের প্রত্যেকটা কমিটিতে মমতাজের আত্মীয়-স্বজন এবং নিজস্ব লোকজন দিয়ে গঠন করা হয় ।
সেখানে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীদের ওপর ভর করেই হরিরামপুর শাসন করতেন। টেন্ডার, চাঁদাবাজি, লুটপাট, পদ্মায় বালু দখল, সরকারি অফিসগুলোতে কমিশন বাণিজ্যসহ সব ধরনের অপকর্মের অন্যতম ছিলেন মমতাজের প্রধান খলিফা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি লুৎফর রহমান ও তার বাহিনী। তবে মমতাজের প্রধান শত্রু ছিল হরিরামপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান দেওয়ান সাইদুর রহমান। ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে এই দু’জনের মধ্যে সবসময়ই ঝামেলা লেগেই থাকতো।
সিংগাইরের ভাষা শহীদ রফিক সেতুর পাশে ধলেশ্বরী নদীর সরকারি ভূমি ভরাট করে তা নর্দান পাওয়ার প্লান্টের কাছে বিক্রির চেষ্টা করেন মমতাজ। নদী রক্ষা কমিশনের মামলায় জমি ফেরত দিতে বাধ্য হয় ক্রেতা প্রতিষ্ঠানটি । ছোট বড় এরকম হাজারো অভিযোগের ভাণ্ডার রয়েছে মমতাজের বিরুদ্ধে।
অনুসন্ধান এবং বিভিন্ন সূত্র মতে জানা গেছে, একসময় পথে প্রান্তরে মাজারে মাজারে ঘুরে পিতা মধু বয়াতির সঙ্গে গান গাইতেন। অর্থনৈতিক দৈন্যতায় বিপর্যস্ত মমতাজের দিন কাটে অর্ধাহারে অনাহারে। ইত্যাদিতে গান গেয়ে লাইমলাইটে আসেন। এরপর দ্বিতীয় স্বামী রমজানের হাত ধরে রাজনীতিতে নাম লেখান। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে সিংগাইরে মমতাজের পৈতৃক জমি ছিল মাত্র ৪৮ শতাংশ। পরে সংরক্ষিত মহিলা আসনে এমপি হওয়ার পর পরই তার হাতে চলে আসে আলাদিনের চেরাগ। সিংগাইরে ১৩শ শতাংশ জমির ওপর মমতাজ গড়ে তোলেন বিরাট বাংলো বাড়ি। সিংগাইর- হেমায়েতপুর আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে মধুর আড্ডা নামে একটি রেস্টুরেন্ট ও বৈঠকখানা বানিয়েছেন। ১৩ একর জমির মধ্যে মধু ও উজালা কোল্ড স্টোরেজ, মধুমেলা, দোতলা বাড়ি, বাউল কমপ্লেক্স, চারতলা ডুপ্লেক্স বাড়ি নির্মাণ করেন। সিংগাইরের পাশাপাশি রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বাইরে কানাডায় মমতাজের স্থাপনা রয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের টানা ৯ মাস আত্মগোপনে থাকার পর সোমবার রাতে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন তিনি। তার বিরুদ্ধে ঢাকা এবং মানিকগঞ্জে ৬টি মামলা রযেছে।