
সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার ইস্যুতে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে। পর্দার পেছনের কুশীলব এবং বড় অফিসারদের অদায়িত্বশীল আচরণের দায়ভার চাপানো হয়েছে জুনিয়র কয়েকজন পুলিশ সদস্যের ওপর, অথচ ওই জুনিয়র অফিসারদের এই ব্যাপারে কোনো দৃশ্যমান দায় আছে বলে এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে না। মানে আবদুল হামিদ চলে যাওয়ার পর সমালোচনা যেহেতু শুরু হয়েছে, তাই লোকদেখানো কিছু একটা করে আসল অপকর্মকারীদের আড়াল করার চেষ্টা আর কি!
আবদুল হামিদের দেশ ছাড়ার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় যোগসাজশ না থাকলে এটা সম্ভব হতো বলে মনে হয় না। চলুন দেখে নেই কীভাবে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে।
১. আবদুল হামিদ দেশ ছেড়েছেন কূটনৈতিক লাল পাসপোর্ট ব্যবহার করে। ৫ই আগস্ট পরবর্তী সময়ে তার কূটনীতিক পাসপোর্ট এতদিনও কীভাবে বহাল ছিল সেটা একটা প্রশ্নের জন্ম দেয়। উল্লেখ্য, আগস্ট মাসের ২২ তারিখে শেখ হাসিনাসহ বিগত সরকারের মন্ত্রী ও সব সংসদ সদস্যের কূটনৈতিক পাসপোর্ট বাতিল করে নির্দেশনা জারি করা হয়। যদিও একজন সাবেক রাষ্ট্রপতি আমৃত্যু বিচারপতির সমান মর্যাদা পান, প্রটোকল পান-তদুপরি গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে আবদুল হামিদের কূটনীতিক পাসপোর্ট কেন বহাল রইলো, এটা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে। একইসঙ্গে আবদুল হামিদ এয়ারপোর্টে ভিআইপি টার্মিনাল ব্যবহার করে বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত হয়েই দেশ ছেড়েছেন। রাষ্ট্রীয় সদিচ্ছা না থাকলে এই সুযোগ-সুবিধা তার পাওয়ার কথা ছিল না এবং এই কাজগুলো হয়েছে নিশ্চয়ই অনেক বড় ক্ষমতাসীনদের হাত ধরেই।
২. আবদুল হামিদকে নিরাপদে ভিআইপি ট্রিটমেন্ট দিয়ে দেশ ছাড়ার ব্যবস্থা করে দিয়ে পরবর্তীতে জনগণকে আইওয়াশ করার জন্য প্রত্যাহার করা হয়েছে আবদুল হামিদের নিজ এলাকা কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাছান চৌধুরীকে। ঢাকা বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনে নিয়োজিত একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তাহসিনা আরিফকে প্রত্যাহার করা হয়েছে, একইসঙ্গে পুলিশের এসআই এবং এএসআই পদমর্যাদার দু’জন কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। রাঘববোয়ালদের বাঁচাতে এই চারজন পুলিশ কর্মকর্তার ওপর স্রেফ অবিচার করা হচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে।

জানুয়ারি মাসের ২৬ তারিখেই কিশোরগঞ্জের এসপি হাছান চৌধুরী ঢাকার এসবি-কে (এসবি বা স্পেশাল ব্রাঞ্চ ইমিগ্রেশনের দায়িত্বে থাকে) একটা চিঠি পাঠায় মামলাধীন ওই সকল ব্যক্তিদের নামে, যাদের নামে মামলা আছে, যাতে করে ওই ব্যক্তিরা স্বাভাবিকভাবে বিদেশগমন না করতে পারে।
ওই তালিকার ৩৯ নাম্বার ব্যক্তিটি হলো আবদুল হামিদ।
তাহলে ওই এসপি তো তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছেন। তার ওই চিঠি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব ছিল এসবি ইমিগ্রেশন ডিআইজি’র। এখানে তো ওই কিশোরগঞ্জের এসপি’র কোনো দায় নাই। তাহলে তাকে প্রত্যাহার কেন করা হলো?
২.
এসবি’র ইমিগ্রেশনে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তাহসিনা আরিফও তার দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করেছেন। আবদুল হামিদ এয়ারপোর্টে পৌঁছার পর তিনি তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করেন এবং আবদুল হামিদের ব্যাপারে তাদের কাছে মতামত চান। তারা আবদুল হামিদের ব্যাপারে ক্লিয়ারেন্স দেন এবং তারপরই আবদুল হামিদ ইমিগ্রেশন অতিক্রম করেন।

এইখানে সুপেরিয়র অফিসার হিসেবে এসবি’র ডিআইজি (ইমিগ্রেশন) এবং এসবি চিফ পারমিশন দিয়েছেন। তাদের অনুমোদনেই আবদুল হামিদের দেশত্যাগ সম্পন্ন হয়েছে। জুনিয়র ওই অফিসারের দায় থাকতে পারতো, যদি উনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত না করতেন।
৩.
ব্যবস্থা যদি নিতে হয়, তাহলে সবার আগে ব্যবস্থা নেয়া উচিত এসবি’র ডিআইজি (ইমিগ্রেশন) মোয়াজ্জেম হোসেন এবং এসবি চিফের বিরুদ্ধে। এ ছাড়াও যারা এই অনুমোদন কর্মে জড়িত ছিল এজেন্সির সেই সব ব্যক্তির বিরুদ্ধেও স্টেপ নেয়া উচিত। কিন্তু এসবি’র ওই ডিআইজি (ইমিগ্রেশন) এবং চিফের বিরুদ্ধে কোনো স্টেপ না নিয়ে অযথাই অন্য চারজন জুনিয়রের ওপর স্টেপ নেয়া হয়েছে এবং জনগণকে দেখানো হচ্ছে সরকার (এক্ষেত্রে দায়িত্বশীল মন্ত্রনালয় হলো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) ব্যবস্থা নিয়েছে। সরকার খুব দায়িত্বশীল! মানে স্রেফ মুলা ঝুলিয়ে দেয়া আর কি!
উপরে উল্লিখিত তিনটি পয়েন্টের ভিত্তিতে আমার কনক্লুসিভ মন্তব্য হলো- স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচিত এই ধরনের আইওয়াশ কাজকর্ম বাদ দিয়ে প্রকৃত অপকর্মকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া এবং যেই চারজন কর্মকর্তাকে বিনা কারণে প্রত্যাহার/বরখাস্ত করা হয়েছে, তাদের কাছে দুঃখপ্রকাশ করে তাদের স্বপদে বহাল করা। অন্যথায় উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার এই নজির সরকারকে আরও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলতে পারে।