Image description

কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) কতিপয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকার নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। প্রধান উপদেষ্টা, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে দেওয়া অভিযোগে বলা হয় অভিযুক্তরা কিছু কিছু প্রার্থীর কাছে মোটা অংকের বিনিময়ে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছেন। লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করিয়ে কয়েকজন প্রার্থীকে পাশও করিয়েছেন। 

 
 

জানা গেছে, ২০২২ সালের ১২ ডিসেম্বর রাজস্ব খাতের বিভিন্ন পদে ৯০ জনবল নিয়োগের একটি বিজ্ঞপ্তি নিজস্ব ওয়েবসাইট, স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশ করে কেজিডিসিএল। সবশেষ সোমবার (১২ মে) জানা গেছে, সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন শেষে ৮৩জনকে নিয়োগের সুপারিশ করেছে নিয়োগ কমিটি। রহস্যজনক কারণে গত আড়াইবছরে দফায় দফায় লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার তারিখ পরিবর্তন  করেছে কর্তৃপক্ষ। কেজিডিসিএল ভিত্তিক একটি চক্র প্রার্থীর কাছ থেকে ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। 

 

যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সরকারি বিভিন্ন সংস্থায় অভিযোগ করা হয়েছে তারা হলেন কেজিডিসিএল’র আইটি অ্যান্ড প্রি-পেইড মিটার বিভাগের মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মৌসুমী পাল, বিতরণ (উত্তর) বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. রফিক খান, সংস্থাপন বিভাগের পার্সোনাল শাখার ব্যবস্থাপক সুলতান আহম্মেদ, বিক্রয় (দক্ষিণ) বিভাগের সহকারী শ্রমিক ইউনিয়নের বর্তমান সভাপতি শরীফুল ইসলাম, বিক্রয় (উত্তর) বিভাগের সার্ভেয়ার এবং বর্তমান শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন। এর মধ্যে শরীফুল সদ্য নিষিদ্ধঘোষিত বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলের ভাতিজা। 

এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকার নিয়োগ বাণিজ্য, প্রশ্নপত্র ফাঁস করার অভিযোগ প্রসঙ্গে কেজিডিসিএল’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. সালাউদ্দিন সোমবার (১২ মে) বিকেল সাড়ে চারটার দিকে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘রাজস্ব খাতে কিছু জনবল নিয়োগ সংক্রান্তে কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্ণীতির অভিযোগ উঠার বিষয়টি আমি শুনেছি। অভিযোগের বিষয়টি আমি খতিয়ে দেখছি।’ এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন চট্টগ্রাম-১ এর উপসহকারী পরিচালক হামিদ রেজা রিফাত বলেন, ‘কেজিডিসিএল এল কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকের সদর দপ্তরে অভিযোগ জমা পড়েছে।’ 

অভিযোগ প্রসঙ্গে বিতরণ (উত্তর) বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. রফিক খান সোমবার বিকেলে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি কারিগরী ক্যাডারের সদস্য। দ্বিতীয়বার যখন প্রার্থীদের ভাইবা পরীক্ষা হয় তখন আমি অংশ নিয়েছিলাম। আমাকে জড়িয়ে যেসব অভিযোগ করা হচ্ছে তা মিথ্যা।’ অভিযোগ প্রসঙ্গে সংস্থাপন বিভাগের পার্সোনাল শাখার ব্যবস্থাপক সুলতান আহম্মেদ বলেন, ‘আমি শুধু নিয়োগ কমিটির কাজে সহযোগীতা করেছি। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কার্য সম্পাদন করেছে নিয়োগ কমিটি। যেসব অভিযোগ আমি বা আমাদের বিরুদ্ধে আনা হয়েছে এর সত্যতা নেই।’

 

জানা গেছে, ২০২২ সালের ১২ ডিসেম্বর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের কিছুদিন পর অদৃশ্য কারণে তা সাময়িকভাবে স্থগিত করে কেজিডিসিএল। ৭ মাস পর ২০২৩ সালের ২০ আগস্ট ওয়েবসাইট, স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় পুনঃনিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে কেজিডিসিএল। ২০২৪ সালের ১৭ মে সকল পদের লিখিত পরীক্ষা ‘বি এ এফ শাহীন কলেজ’ ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়। লিখিত পরীক্ষায় উর্ত্তীণ প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। 

৩০ মে মৌখিক পরীক্ষা নেওয়ার একপর্যায়ে হঠাৎ নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত করে কেজিডিসিএল। নিয়োগ বাণিজ্যের সিন্ডিকেটের চাপে গত বছরের ২৪  অক্টোবর পুনঃরায় মৌখিক পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করে সংস্থাটি। ‘অনিবার্য কারণ’ দেখিয়ে গতবছরের ১৮ আক্টোবর নিয়োগ কার্যক্রম স্থগিত করে কেজিডিসিএল। মৌখিক পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করে চলতি বছরের ৬ মার্চ ওয়েবসাইটে তা বাতিল করে সংস্থাটি। তবু থেমে থাকেনি নিয়োগ বাণিজ্য সিন্ডিকেটের অপতৎপরতা। মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রভাবশালী লোকের মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ করে বাতিল হওয়া মৌখিক পরীক্ষা চলতি বছরের ১৩ মার্চ গ্রহণের জন্য পুনঃরায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে কর্তৃপক্ষ।

 

কেজিডিসিএল’র এক কর্মকর্তা অভিযোগ করে বলেন, ‘আওয়ামীলীগ সরকার আমলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ প্রক্রিয়া বর্তমান অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার বাতিল করে পুনঃনিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। অথচ তিন বছর আগের নিয়োগ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের উঠে পড়ে লেগেছে কেজিডিসিএল এ ঘাপটি মেরে থাকা ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসররা।’ 

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, আইটি অ্যান্ড প্রি-পেইড মিটারিং ডিভিশনের মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মৌসুমী পালকে উক্ত নিয়োগের প্রশ্নপত্র তৈরি ও নিয়োগ কার্যক্রম সম্পাদনের বিভিন্ন দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরিকল্পনা বিভাগের উপ-মহাব্যবস্থাপক তুষার মধুর কাছ থেকে মোটা অংকের ঘুষ নিয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে লিখিত পরীক্ষায় পাশ করিয়ে দেন তিনি। শুধু তাই না, মৌসুমী পালের ব্যক্তিগত গাড়িচালক মো. জাবেদ ‘প্লান্ট অপারেটর’ পদের একজন প্রার্থী ছিলেন। তার কাছেও প্রশ্নপত্র ফাঁস করেন প্রকৌশলী মৌসুমী। 

জানা গেছে, গাড়িচালক জাবেদ নিজের মাসিক ওভারটাইম শিট ও মাস্টারলক বই এন্ট্রি পর্যন্ত লিপিবদ্ধ করতে পারেন না। আরেকজনের সাহায্য নিতে হয়। সেখানে মো. জাবেদ কিভাবে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন? সেই প্রশ্ন থেকে যায়। মোটা অংকের ঘুষ নিয়ে ব্যক্তিগত গাড়ি চালকের কাছে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসসহ নানা অভিযোগ প্রসঙ্গে বক্তব্য জানতে সোমবার বিকেল ৪টা ২৩ মিনিটে মোবাইলে কল করলে রিসিভ করে মৌসুমী পাল বলেন, ‘আমি মিটিংয়ে আছি। এক ঘণ্টা পরে কল করুন।’ এরপর বিকেল ৫টা ৪৩ মিনিটে পুনরায় কল করলেও সাড়া দেননি তিনি।  

 

শ্রমিক ইউনিয়নের (২৭৭০) বর্তমান সভাপতি সিবিএ নেতা শরীফুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে সংশ্লিষ্টরা জানান, কেজিডিসিএল-এ এর ‘দাদাভাই’ নামে পরিচিত। তার গ্রামের বাড়ি নওগাঁ জেলায়।  এই শরিফুল পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকারে বাল্যবন্ধু পরিচয় দিয়ে কেজিডিসিএল-এ কর্মকর্তার মাঝে ভয়ভীতির সঞ্চার করেন।

প্রশাসন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক মোজাহের আলীকে নিয়ে ‘দাদাভাই’ শরীফুল কেজিডিসিএল’র নিয়োগ, বদলি বাণিজ্য এবং অবৈধ গ্যাস সংযোগ প্রদানের সিন্ডিকেট করেছেন। রাজস্ব খাতে কর্মচারী নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করিয়ে প্ল্যান্ট অপারেটর পদে (রোল: ২৭০০০৪৮১) মো. রুহুল আমীন নামে এক প্রার্থীকে পরীক্ষায় পাশ করানোর অভিযোগ আছে শরীফুলের বিরুদ্ধে।

অভিযোগ আছে, রুহুল আমীন গত বছরের ১৭ মে ঢাকার বিএএফ শাহীন কলেজে অনুষ্ঠিত নিয়োগ পরীক্ষায় প্রার্থী হিসেবে স্বশরীরে পরীক্ষার হলে উপস্থিত ছিলেন না। পরীক্ষার দিনের বিএএফ শাহীন কলেজ এরিয়ায় ও হল রুমে থাকা সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করলে সত্য বেরিয়ে আসবে বলে অভিমত সংশ্লিষ্টদের। অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে শরীফুল ইসলামের মোবাইলে সোমবার বিকেলে একাধিকবার কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি।