Image description
পোশাক বিধিমালায় না থাকলেও ভারপ্রাপ্ত এডিরা পরছেন পোশাক । প্রশিক্ষণ না থাকলেও চালাচ্ছেন অভিযান, মামলা ও তদন্ত করছেন । বিধিমালার বাইরে এই সুযোগ নিয়ে আপত্তি অন্য কর্মকর্তাদের ।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালকের (এডি) ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব পাওয়া প্রশাসনিক কর্মকর্তারা নির্ধারিত পোশাকে অভিযানে যাচ্ছেন। তাঁরা অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণের জন্যও মনোনীত হয়েছেন। অধিদপ্তরের বিধিতে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের জন্য এমন সুযোগ না থাকায় এ নিয়ে প্রশ্ন ও আপত্তি তুলেছেন অন্য কর্মকর্তারা।

সূত্র বলেছে, পরিদর্শকদের পাশ কাটিয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের এডির ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দেওয়ায় অধিদপ্তরে অসন্তোষ রয়েছে। বর্তমানে ১৮ জন প্রশাসনিক কর্মকর্তা এডির ভারপ্রাপ্ত দায়িত্বে রয়েছেন।

আপত্তি তোলা কর্মকর্তারা বলছেন, অধিদপ্তরের মহাপরিচালকেরা (ডিজি) এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে কার্যত অন্ধকারে রেখেছেন। প্রশাসনিক কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এডির ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব পাওয়ার পর দুর্নীতিতে জড়ানোর অভিযোগ উঠেছে। কয়েকজনের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গণি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাকে এ বিষয়ে কেউ কখনো কিছু বলেনি। যদি সত্যিই এমন হয়ে থাকে, কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়া তাঁরা দায়িত্ব পালন করছেন, তাহলে সেটা ঠিক হয়নি। আমাকে না জানালে আমার পক্ষে সবকিছু জানা সম্ভব নয়। আমি বিষয়টি নিয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সঙ্গে আলোচনা করব।’

জানতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের নতুন মহাপরিচালক (ডিজি) মো. হাসান মারুফের সঙ্গে টানা তিন দিন যোগাযোগের চেষ্টা করে পাওয়া যায়নি। তাঁর সরকারি ও ব্যক্তিগত মোবাইলে একাধিকবার ফোন দিলে ধরেননি। মেসেজ পাঠানো হলেও সাড়া মেলেনি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, পোশাক বিধিমালা অনুযায়ী, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালকসহ মোট ৯টি পদের কর্মকর্তা-কর্মচারীর ইউনিফর্ম পরার সুযোগ রয়েছে। তাঁদের মধ্যে প্রশাসনিক কর্মকর্তারা নেই। তবে পদোন্নতির পর এডির ভারপ্রাপ্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তারা আভিযানিক প্রশিক্ষণ ছাড়া বর্তমানে ইউনিফর্ম পরে অভিযান পরিচালনা করছেন। অধিদপ্তরের যাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, তাঁদের মধ্যে এমন কর্মকর্তাদের সংখ্যা বেশি।

অধিদপ্তরের পদস্থ কর্মকর্তারা বলছেন, অধিদপ্তরের কাঠামো অনুযায়ী অপারেশন উইংয়ের জন্য আলাদা জনবল রয়েছে। সহকারী পরিচালক হিসেবে পূর্ণাঙ্গ প্রশিক্ষণ ছাড়া কেউ আভিযানিক দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সহকারী পরিচালকের ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব পেয়ে ইউনিফর্ম পরে অভিযান চালানো অধিদপ্তরের নীতিমালার পরিপন্থী।

অভিযোগের বিষয়ে এডির ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব পাওয়া প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দাবি, অভিযানে যেতে ইউনিফর্ম পরা জরুরি। পোশাক বিধিমালায় ভারপ্রাপ্ত দায়িত্বে থাকলে ইউনিফর্ম পরা যাবে না, এমন কোনো স্পষ্ট বিধান নেই।

জানা যায়, ২০১৫ সালের নতুন কাঠামোয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে ছয়টি পদ সৃজন করা হলেও স্থায়ী করা হয়নি। ২০১৭ সালে তৎকালীন ডিজি জামাল উদ্দিন এবং প্রশাসন বিভাগের পরিচালক আজিজুল ইসলাম ওই পদগুলো স্থায়ী না করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেন। সে সময় সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) মতামত দিয়েছিল, সৃজনকৃত পদ স্থায়ী করার পরই পদোন্নতি দেওয়া যাবে এবং সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা থাকা যাবে না। বিষয়গুলো নিয়ে সমালোচনা হলে আব্দুল মজিদ নামের একজন ভারপ্রাপ্ত এডিকে প্রসিকিউটর পদে নামিয়ে দেওয়া হয়।

অধিদপ্তরের সাবেক পরিদর্শক আজিজুল ইসলাম জানান, তিনি এবং পরিদর্শক নজরুল ইসলাম ২০১৭ সালে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে এ নিয়ে মামলা করেন। মামলা চলমান অবস্থায়ও পদোন্নতির প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা হয়। একইভাবে ২০১৯ সালে একই ধরনের পদ সৃষ্টি করে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেওয়া হয়; এ বিষয়ে উচ্চ আদালতে মামলা চলছে।

জামালপুর জেলা কার্যালয়ের পরিদর্শক নজরুল ইসলাম বলেন, প্রশাসনিক কর্মকর্তারা আদতে পোশাক পরা, অভিযান চালানো কিংবা গুলি চালানোর জন্য বৈধ নন।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দায়িত্ব পালনকারী পরিদর্শক দেওয়ান জিল্লুর রহমান বলেন, ‘মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের অস্ত্র দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অস্ত্র ব্যবহারের প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত করা হচ্ছে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের। এখন যদি তাঁরা মামলায় হেরে যান, তবে এই প্রশিক্ষণ কোন কাজে আসবে? মাঝখানে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা বঞ্চিত হচ্ছেন।’

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জের জেলা কার্যালয়ের রিফাত হোসেন বলেন, ‘আমাদের পক্ষে এ বিষয়ে কিছু বলার নেই। উচ্চ আদালত আমাদের পক্ষে রায় দিয়েছেন, আপিল বিভাগে বিষয়টি নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে। আশা করছি, রায় আমাদের পক্ষে যাবে।’

সদ্য ঢাকা থেকে সাময়িক বরখাস্ত ভারপ্রাপ্ত এডি এনায়েত হোসেন বলেন, ভারপ্রাপ্ত এডিরা চাইলেই নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরা নিতে পারেন না। অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুসরণ করেই দায়িত্ব পালন করেন। কাজের দিক দিয়ে শুধু পরিদর্শক নয়, নিয়মিত এডিদের তুলনায় ভারপ্রাপ্ত এডিদের কর্মদক্ষতা বেশি।

প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ভারপ্রাপ্ত এডির দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ নারকোটিকস কন্ট্রোল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবুল হোসেন বলেন, ‘এখানে আসলে কোনো নিয়ম-কানুন চলে না। যে যেভাবে পারছে চলছে। এটা প্রশাসনিক ও আদালতের বিষয়। খুব বেশি কিছু বলার সুযোগ নেই।’

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) মো. মাসুদ হোসেন বলেন, ভারপ্রাপ্ত সহকারী পরিচালকদের জন্য পোশাক-সংক্রান্ত কোনো নির্দেশনা পোশাক বিধিমালায় নেই। তবে দায়িত্ব পালনের স্বার্থে তাঁদের পোশাক পরতে বলা হয়েছে, যা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। প্রশিক্ষণ ছাড়া ভারপ্রাপ্ত এডিদের মাদকবিরোধী অভিযানে অংশগ্রহণ, মামলা ও তদন্ত করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাঁরা আসলে ধারণা থেকে এসব করেন, নিজের বিবেকবুদ্ধি খাটিয়ে অভিযান চালান। পরে তাঁদের প্রশিক্ষণে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।