
আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসনামলে দোর্দণ্ড প্রতাপে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ এবাদুল করিম। তার প্রতিষ্ঠান বিকন ফার্মাসিউটিক্যালের ওষুধ রপ্তানির আড়ালে পাচার হয়েছে শত শত কোটি টাকা। পাচারকাণ্ড নির্বিঘ্ন করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই দুবাই ও হংকংয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনটি কোম্পানি। এতকিছুর পর এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে ফ্যাসিস্টের এই দোসর। ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতার পটপরিবর্তন হলেও এবাদুলের দুর্নীতি চলছে আগের মতোই। যুগান্তরের অনুসন্ধানে তার অর্থ পাচার, বিদেশে কোম্পানি প্রতিষ্ঠা, চোরাকারবার, ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতি ও পুঁজিবাজারে কারসাজির মতো ভয়াবহ দুর্নীতির দালিলিক প্রমাণ পাওয়া গেছে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১৬ সালের আগস্টে হংকংয়ের কলুন শহরে বিকন এশিয়া প্যাসিফিক লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি খোলেন এবাদুল করিম। কোম্পানির ঠিকানা-ফ্ল্যাট নম্বর ২০০৪, ২০/এফ, বেল হাউস, ব্লক-এ, ৫২৫-৫৪৩, নাথান রোড, ইউ মা টি, কলুন হংকং। এই কোম্পানির নামে বাংলাদেশ থেকে বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা হংকংয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া সেখানে বিকন মেডিকেয়ার লিমিটেড নামে আরেকটি কোম্পানি রয়েছে তার। সংশ্লিষ্টরা জানান, এই কোম্পানির নামেই মূলত হংকংয়ে ওষুধ রপ্তানির আড়ালে গড়ে তুলেছেন চোরাকারবারের নেটওয়ার্ক। রপ্তানি করা ওষুধের অর্থ দেশে না এনে তিনি সেখানকার বিভিন্ন শহরে কোটি কোটি টাকার সম্পদ কিনেছেন। দেশ থেকে রপ্তানি পণ্যের অর্থ বাংলাদেশের কোনো ব্যাংকের হিসাবে নয়, জমা হয়েছে হংকংয়ের বিকন মেডিকেয়ার লিমিটেডের ব্যাংক হিসাবে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি ছাড়াই হংকংয়ে বিকন মেডিকেয়ার নামে কোম্পানিটি খোলা হয়েছে। বিকন মেডিকেয়ারের টাকা দিয়ে হংকংয়ের বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট, দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়েছেন এবাদুল করিম। এছাড়া আইটি খাতে তার প্রায় ১৭ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের তথ্য পাওয়া গেছে। বিকন ফার্মাসিউটিক্যালসের একটি সূত্রে জানা গেছে, এই প্রতিষ্ঠান থেকে শতকরা ৪০ ভাগ কম দামে ওষুধ কেনে হংকংয়ে এবাদুল করিমের প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি বিকন মেডিকেয়ার লিমিটেড। পরে তারা হংকং থেকে ওই ওষুধ কম্বোডিয়া, লাওস, উজবেকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে চড়া দামে রপ্তানি করে। আবার অনেক ওষুধ চোরাইপথেও বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয়।
আরও জানা গেছে, হংকংয়ে বিকন ফার্মার রপ্তানি করা ওষুধের শতকরা ২৫ ভাগই ট্রানজিট হয়ে বিদেশে যায়। বৈধ উপায়ে ২৫ শতাংশ ওষুধ রপ্তানি করা হলেও শতকরা ৭৫ ভাগই বিভিন্ন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে হংকংয়ে পাঠানো হয়। বিকন মেডিকেয়ার ওই ওষুধ গ্রহণ করে বাজারজাত করে। হংকং থেকে অনলাইনের মাধ্যমেও বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ওষুধ বিক্রি করা হয়। আর এ কাজের মাধ্যমে পণ্য ও অর্থ দুটিই পাচার হচ্ছে।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যানসারসহ বিভিন্ন রোগ নিরাময়ে ২০০টির বেশি জেনেরিক ওষুধ ও ৬৫টি অনকোলজি পণ্য তৈরি করে বিকন। বিকন বাংলাদেশের প্রথম কোম্পানি যারা বিদেশে ক্যানসারের ওষুধ রপ্তানি শুরু করে। ২০১৩ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিপুল পরিমাণ ওষুধ ও ওষুধ তৈরির কাঁচামাল রপ্তানি করে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু রপ্তানি আয়ের ওই অর্থ দেশে না এনে তা দুবাই ও হংকংয়ের আবাসনসহ বিভিন্ন ব্যবসা খাতে বিনিয়োগ করা হয়। রপ্তানি পণ্যের অর্থ গ্রহণ করেছে হংকংয়ের বিকন মেডিকেয়ার লিমিটেড, বিকন এশিয়া প্যাসিফিক লিমিটেড ও দুবাইয়ের বিকন গ্লোবাল অপারেশন্স (এফজেডসি)। এবাদুল করিমের মালিকানায় কোম্পানিগুলো প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। যদিও এক্ষেত্রে বিকনের সঙ্গে যেসব শেয়ারহোল্ডার আছেন, তাদের জালিয়াতির মাধ্যমে ডেভিডেন্ড বা লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিকন মেডিকেয়ার লিমিটেড ওষুধ রপ্তানি করে যে লাভ করে, তা কোম্পানির পরিচালকের মধ্যে বণ্টন করা হয়। পরিচালকরা সবাই এবাদুল করিম পরিবারের সদস্য। কোম্পানির রপ্তানি ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে তা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। হংকংয়ের বিকন মেডিকেয়ার লিমিটেড নামে কোম্পানিটি জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে নিবন্ধিত হয়েছে। এতে এবাদুল করিম ও পরিবারের অন্য সদস্যদের পরিচালক বানিয়েছেন। এই কোম্পানি থেকেও বিপুল পরিমাণ পণ্য রপ্তানি হয়। তবে সেখান থেকে অর্জিত লাভ শুধু এমডি ও পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ভাগ হয়। এখানেও শেয়ারহোল্ডারদের বঞ্চিত রাখা হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিকনের এক কর্মকর্তা বলেছেন, বিকন ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি সরাসরি অর্থ পাচার ও রপ্তানি বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত। বিকন ফার্মাসিউটিক্যালস একটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি। তারা এটা করতে পারে না। তারা উৎপাদিত পণ্য রপ্তানিও করতে পারে না। কারণ ৮ হাজার ৩২২ জন শেয়ারহোল্ডার এই কোম্পানির মালিকানায় আছেন। তাদের মোট শেয়ারের পরিমাণ ২৩ কোটি ১০ লাখের অধিক। অথচ রপ্তানিবিষয়ক কোম্পানিটির মালিকানা শুধু এবাদুল করিম ও তার পরিবারের সদস্যরা। দুবাই ও হংকংয়ে এবাদুলের একটি কোম্পানি ফুড সাপ্লিমেন্ট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। সেখানে তাদের একটি ক্লিনিক ও একটি পুনর্বাসন কেন্দ্রও আছে। বাকিগুলো বিভিন্ন খাতের ব্যবসা । বিকন এশিয়া প্যাসিফিক লিমিটেড নামের কোম্পানি আসলে চোরাকারবার ও অর্থ পাচারের উদ্দেশেই খোলা হয়েছে। হংকংয়ের এইচএসবিসি ব্যাংকে খোলা কোম্পানির আর্থিক লেনদেনের বিবরণী থেকেও চোরাচালান ও অর্থ পাচারের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
প্রাপ্ত নথিপত্রে দেখা গেছে, সংযুক্ত আরব আমিরাতের ব্যয়বহুল শহর দুবাইয়ে আরেকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলেছেন এবাদুল করিম। বিকন গ্লোবাল অপারেশন্স (এফজেডসি) নামে এই কোম্পানিটি দুবাই মেরিনাতে হোটেল ব্যবসায় বিপুল অঙ্কের অর্থ বিনিয়োাগ করেছে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) দুবাইয়ের মাশরেক ব্যাংকে চিঠি পাঠালে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে এবাদুলের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টও রয়েছে। ২০১৮ সালের রাতের ভোটে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন এবাদুল।
এসব বিষয়ে জানতে মোহাম্মদ এবাদুল করিমের মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। বক্তব্য জানতে এবাদুলের ছেলে ও বিকন ফার্মাসিউটিক্যালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা উলফাত করিমের মোবাইল ফোনে কল করা হলে তিনি রিসিভ করে এ প্রতিবেদকের পরিচয় পেয়ে বলেন, নেটওয়ার্ক সমস্যায় আপনার কথা ভালো শুনতে পাচ্ছি না। হ্যালো, হ্যালো বলতে বলতে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। এ প্রতিবেদক পুনরায় একাধিকবার কল করলেও তিনি আর রিসিভ করেননি। তার একই নম্বরে কথা বলার সময় চেয়ে খুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি কোনো জবাব দেননি।