
মুন্সীগঞ্জ থেকে গত বৃহস্পতিবার অন্তঃসত্ত্বা নারীসহ ১০ জন যাত্রী নিয়ে একটি অ্যাম্বুল্যান্স যাচ্ছিল ঢাকায়। নিমতলা এলাকায় ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে পেছন থেকে যাত্রীবাহী গাড়ির ধাক্কায় চালকসহ অ্যাম্বুল্যান্সের পাঁচজন প্রাণ হারান। হাঁসাড়া হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ওসি আব্দুল কাদের জিলানী গতকাল এ তথ্য দেন। আরেকটি ঘটনা রাজধানীর মগবাজার ওয়্যারলেস রেলগেট এলাকার।
গত বুধবার দুপুর ১২টার দিকে রেললাইন পার হওয়ার সময় ট্রেনের ধাক্কায় লোকমান প্রধানিয়া (৬৫) নামের এক ব্যক্তি প্রাণ হারান। এভাবে সারা দেশে সড়ক ও রেললাইনে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। পুলিশ, বিআরটিএ, বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি ও রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত গত ১৬ মাসের তথ্য অনুযায়ী এ সময় দেশে ১১ হাজার ৬৪৬ জন সড়ক ও রেললাইনে নিহত হয়েছে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন বলছে, যানবাহনের অতিরিক্ত গতি, সড়ক ব্যবস্থাপনায় নানা অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, মহাসড়কের থ্রি-হুইলার জাতীয় যানবাহনের চলাচল বৃদ্ধি, চালকদের অদক্ষতা, আনফিট যানবাহন চলাচল, সড়ক অবকাঠামোর দুর্বলতাসহ বিভিন্ন কারণে ধারাবাহিকভাবে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে পুলিশের তথ্য মতে, প্রতিবছর গড়ে ট্রেনে কাটা পড়ে এক হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়। এর অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে রেললাইনে হাঁটা, রেললাইনে দাঁড়িয়ে এয়ারফোন ব্যবহার, অসতর্কভাবে রেলওয়ে ক্রসিং পারাপারের চেষ্টা, রেললাইনে বসে গল্প করা, ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে মৃত্যু। এ ছাড়া রেললাইনে আত্মহত্যার ঘটনাও রয়েছে।
সড়ক দুর্ঘটনা : যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য মতে, এপ্রিলে সড়কে ৫৮৩ জন নিহত হয়। এ সময়ে এক হাজার ২০২ জন আহত হয়। মোটরসাইকেলে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এর বাইরে জানুয়ারিতে ৬৫৯ দুর্ঘটনায় ৬৭৭ নিহত, এক হাজার ২৭১ আহত; ফেব্রুয়ারিতে ৫৯৬ সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৭৮ নিহত ও এক হাজার ৩২৭ আহত; মার্চে ৫৯৩ সড়ক দুর্ঘটনায় ৬১২ জন নিহত ও এক হাজার ২৪৬ জন আহত হয়।
গত বছর ডিসেম্বরে ৫০৪টি দুর্ঘটনায় ৫৩৯ নিহত ও ৭৪৬ আহত; নভেম্বরে ৪১৫ দুর্ঘটনায় ৪৯৭ নিহত ও ৭৪৭ আহত; অক্টোবরে ৪৫২ দুর্ঘটনায় ৪৭৫ নিহত ৮১৫ আহত; সেপ্টেম্বরে ৪৯৩ দুর্ঘটনায় ৪৯৮ নিহত ও ৯৭৮ আহত এবং আগস্টে ৪৬৭ দুর্ঘটনায় ৪৭৬ নিহত ও ৯৮৫ জন আহত হয়েছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সূত্র বলছে, গত ঈদুল ফিতরের ছুটিতে আগে ও পরে সারা দেশে আট দিনে ১১০টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১৩২ জন নিহত হয়। আহত হয় ২০৮ জন।
এ বিষয়ে বেসরকারি সংস্থা ঢাকা আহছানিয়া মিশনের পরিচালক ইকবাল মাসুদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রোডক্র্যাশ এড়াতে ঈদের মতো বড় উৎসবসহ সব সময় সড়কে নিরাপদ গতি নির্ধারণ করতে হবে। দ্রুত গতি নির্ধারণ ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত গাইডলাইন প্রণয়ন করতে হবে। চালকদের কর্মঘণ্টা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। যাতে চালকরা পর্যাপ্ত বিশ্রাম পায়, ঈদ যাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও মহাসড়কে নছিমন, করিমন, টেম্পোসহ সব ধরনের ব্যাটারিচলিত যানবাহন ও ভটভটি চলাচল বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি অন্যান্য সড়কে ধীরগতির যান ও দ্রুতগতির যানের জন্য আলাদা লেনের ব্যবস্থা করতে হবে। পরিবহনের পাশাপাশি পথচারী পারাপার ও তাদের নিরাপদে চলাচলে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, দেশে ২০২৪ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ২১ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে, যা জিডিপির ১.৫ শতাংশের বেশি হতে পারে। যানবাহনের অতিরিক্ত গতি, সড়ক ব্যবস্থাপনায় নানা অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, মহাসড়কের থ্রি-হুইলার জাতীয় যানবাহনের চলাচল বৃদ্ধি, চালকদের অদক্ষতা, আনফিট যানবাহন, সড়ক অবকাঠামোর দুর্বলতাসহ বিভিন্ন কারণে ধারাবাহিকভাবে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে বলে মনে করছে সংস্থাটি।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন. মোট দুর্ঘটনার ৩৭.৯১ শতাংশই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা জানিয়ে তিনি বলেন, যা নিহতের ৩৯.২৭ শতাংশ।
এপ্রিলে সবচেয়ে চট্টগ্রাম বিভাগে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে জানিয়ে তিনি বলেন, সেখানে ১৩৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১৩৬ জন নিহত হয়। সবচেয়ে কম দুর্ঘটনা ঘটেছে সিলেট বিভাগে, ২৮টি।
রেললাইনে দুর্ঘটনা : যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য বলছে, রেললাইনে দুর্ঘটনায় গত ৯ মাসে ৩৫৫ জন নিহত হয়। গত এপ্রিলে রেলপথে ৩৫টি দুর্ঘটনায় ৩৫ জন নিহত।
চলতি বছর জানুয়ারিতে ৫৭ দুর্ঘটনায় ৫৯ নিহত ও ২৩ আহত হয়; ফেব্রুয়ারিতে ১৪ দুর্ঘটনায় ১৩ নিহত ও ছয় আহত; মার্চে ৪০ দুর্ঘটনায় ৩৪ নিহত ও ছয় আহত; এপ্রিল মাসে ৩৫টি দুর্ঘটনায় ৩৫ জন নিহত ও পাঁচজন আহত হয়। গত বছর ডিসেম্বরে ১৯ দুর্ঘটনায় ১৪ নিহত ও পাঁচজন আহত; নভেম্বরে ৬৪ দুর্ঘটনায় ৭৯ নিহত ও ৪৩ আহত; অক্টোবরে ৬৩ দুর্ঘটনায় ৭৬ নিহত ও ২৪ আহত; সেপ্টেম্বরে ৪০ দুর্ঘটনায় ৩৭ নিহত ও চার আহত এবং আগস্টে ১০ দুর্ঘটনায় আটজন নিহত ও দুজন আহত হয়েছে।
সরেজমিনে জানা গেছে, রেললাইনে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ কুড়িল বিশ্বরোড, খিলক্ষেত, মগবাজার মোড়, তেজগাঁও ও মালিবাগ লেভেলক্রসিং এলাকা। সম্প্রতি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ট্রেনের সামনে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের চিন্তাভাবনা করেছে।
রেলওয়ে পুলিশের তথ্য বলছে, গত বছর ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর ঘটনায় মোট ৯৯৮টি মামলা হয়। চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি) রেললাইন থেকে ১৬৮টি লাশ উদ্ধার করা হয়।
রেলওয়ে পুলিশের সদর দপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে জানা যায়, রেললাইন থেকে ২০২৪ সালে এক হাজার ১৭টি লাশ উদ্ধার করে রেলওয়ে পুলিশ। সে হিসাবে প্রতি মাসে রেললাইন থেকে ৮৫টি লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। সেসব লাশের বিপরীতে মামলা হয় ৯৯৮টি।
রেলওয়ে পুুলিশের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২৪ সালের মোট মৃত্যুর মধ্যে ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে ২৩ জন, কানে এয়ারফোন থাকায় ও অন্যান্য কারণে ট্রেনের শব্দ শুনতে না পারায় ৭৬ জন এবং স্বাভাবিক, অসুস্থতাজনিত, বার্ধক্যজনিত, আত্মহত্যা ও মানসিক প্রতিবন্ধিতাজনিত কারণে ১৪২ জনের মৃত্যু হয়। এ ছাড়া ৯৯৮টি অপমৃত্যুর মামলার মধ্যে ছয়টি খুনের মামলায় রূপান্তরিত হয়।
রেলওয়ে পুলিশের প্রধান ও অতিরিক্ত আইজিপি সরদার তমিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, রেললাইন থেকে উদ্ধার করা প্রতিটি লাশেরই ময়নাতদন্ত হয়। যদি ময়নাতদন্তে হত্যাকাণ্ডের ইঙ্গিত পাওয়া যায়, তাহলে হত্যা মামলা হয় এবং তদন্ত চলে।