Image description

চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা করতে যাওয়ার আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। এই শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগই প্রযুক্তি, চিকিৎসা, ব্যবসা বিষয়ে পড়তে যায়। আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিংয়ে চীনের বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় স্থান করে নেওয়ার পাশাপাশি তুলনামূলক কম খরচে মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করা যায় বলে এই আগ্রহ আরো বাড়ছে। যশোরের মো. মাহমুদুল হাসান (রাজু)। চীন সরকারের বৃত্তি নিয়ে ২০১৮ সালে চীনের জিয়াংসু প্রদেশের ইয়াংঝু বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক ব্যবসা বিষয়ে পড়ালেখা করতে যান। ২০২২ সালে তিনি অনার্স কোর্স শেষ করেন। এরপর জীবিকার প্রয়োজনে ভিয়েতনাম সীমান্তের গুয়াংশি প্রদেশের নান্নিং শহরে একটি ট্রেডিং কম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন।

মাহমুদুল হাসান কালের কণ্ঠকে জানান, বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক তাঁকে চীনে পড়ালেখা করতে আগ্রহী করে তোলে। বাণিজ্যে নিজের মেধা কাজে লাগাতে তিনি আন্তর্জাতিক ব্যবসা বিষয়ে পড়ালেখা করেন। বর্তমানে নিজেই একটি কম্পানি প্রতিষ্ঠা করে সেমফ স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে তাঁর  কম্পানি ব্যবসা করছে।

তিনি আরো জানান, বর্তমানে জিয়াংসু রাজ্যের ৮ থেকে ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক হাজার বাংলাদেশি ছাত্র-ছাত্রী পড়ালেখা করছেন। বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা শেষ করে সহজে চাকরি ছাড়াও উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন। বাংলাদেশে চীনের বাণিজ্য বৃদ্ধির কারণে ওখানকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনেক বাংলাদেশির প্রয়োজনও হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে চীনে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীরা অগ্রাধিকার পাচ্ছেন। আর যাঁরা চীনা ভাষা ভালো জানেন, তাঁরা দ্রুত এসব সুযোগ কাজে লাগাতে পারছেন। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ আসিয়ানভুক্ত হতে পারলে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা চীন সরকারের বৃত্তির সুযোগ আরো বেশি পাবেন।

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ড. শরিফুল ইসলাম ইমশিয়াত। ২০২০ সালে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরের হুয়াজং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে পিএইচডি করেন। বাংলাদেশ ও চীনের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নানা বিষয়ে গবেষণা করছেন তিনি।

কেন বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ালেখা করতে যাওয়ার আগ্রহ বাড়ছেএমন প্রশ্নের জবাবে ড. শরিফুল ইসলাম ইমশিয়াত কালের কণ্ঠকে বলেন, কয়েক দশকের ব্যবধানে চীনের শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন ওয়ার্ল্ড র‌্যাংকিংয়ে অবস্থান করছে। ফলে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মানের পাশাপাশি দেশটির ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনায় নিচ্ছেন। এ ছাড়া যাঁরা ব্যক্তি উদ্যোগে পড়ালেখা করতে যাচ্ছেন, তাঁরা স্বল্প টিউশন ফিতে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করতে পারছেন। আর চীন সরকারের বৃত্তিও এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করছে। আবার বাংলাদেশের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। আগে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে চীনের পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের চাকরি হতো না। এখন চীনের ডিগ্রিকে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মূল্যায়ন করছে। বাংলাদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় চীনের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম চালু করছে। এর সঙ্গে বাংলাদেশে চীনা দূতাবাসের সহায়ক নীতি-সুবিধা শিক্ষার্থীদের আর্কষণ করছে। চীন ও বাংলাদেশের সেতুবন্ধ তৈরিতে ভূমিকা রাখছেন বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা।

২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরের পর থেকে চীনে শিক্ষাগ্রহণে বাংলাদেশি শিক্ষার্থী যাওয়া বাড়তে থাকে। তবে কভিড-১৯-এর আগে প্রতিবছর চীনে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী পড়ালেখা করতে যাওয়ার সুযোগ পেলেও কভিডের পর চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষাবৃত্তি কিছুটা কমিয়ে দিয়েছে। তার পরও প্রতিবছর গড়ে ১৫ থেকে ২০ হাজার শিক্ষার্থী চীনে পড়ালেখা করতে যাচ্ছেন। চীনের কেন্দ্রীয় সরকারের পাশাপাশি প্রাদেশিক সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দিচ্ছে। তবে শিক্ষাবৃত্তির ক্ষেত্রে চীন এখন আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। তাই বাংলাদেশ আসিয়ানভুক্ত হলে চীন সরকারের বৃত্তি সুবিধা আরো বাড়বে। অবশ্য বৃত্তির সংখ্যা কমলেও ব্যক্তি পর্যায়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে চীন যাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে।

বৃত্তির বাইরে ব্যক্তি পর্যায়ে সেসব শিক্ষার্থী চীনে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে যান, বিষয়ভেদে অনার্স পর্যায়ে বছরে তাঁদের টিউশন ফি দিতে হয় দেড় থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত।

চীনের বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা ভাষার কোর্স চালু করেছে। চীনের শিক্ষাব্যবস্থা দেখতে চীন সরকারের আমন্ত্রণে ২০২৩ সালে চীনের ইউনান প্রদেশের খুনমিং শহরে ইউনান বিশ্ববিদ্যালয় সফর করেন এই প্রতিবেদক। তখন বিশ্ববিদ্যালয়টির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠকে জানা যায়, ইউনান প্রদেশের বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষার প্রসার ঘটছে। পাশাপাশি বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের মধ্যে চীনা ভাষা শেখার প্রবণতাও বাড়ছে। বাংলাদেশ থেকে কম দূরত্বে হওয়ায় এই প্রদেশের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয়টিতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বাংলা ভাষার চর্চা হচ্ছে। সেখানে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা যেমন বৃত্তি নিয়ে পড়ালেখা করতে যাচ্ছেন, তেমনি চীনের তরুণ-তরুণীরাও আগ্রহ থেকে বাংলা ভাষার চর্চা করছেন।

ইউনান বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা কোর্সে অংশ নেওয়া চীনা শিক্ষার্থীদের দুটি নাম থাকে। একটি চীনা, আরেকটি বাংলা। বাংলা ভাষা শিক্ষা বিভাগে ভর্তি হওয়া চীনা শিক্ষার্থী ইয়াং মেইফেংয়ের বাংলা নাম রোমানা। আবার রোমানার আরেক সহপাঠী জাং ইউশিউয়ের বাংলা নাম সোনালি।

ইউনান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট হু জিনমিং জানান, চীনের পঞ্চম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে তাঁরা ২০২০ সাল থেকে বাংলা ভাষা শিক্ষা বিভাগ চালু করেছেন। চার বছর মেয়াদি সম্মান কোর্সে এক বছর পর পর শিক্ষার্থী ভর্তি করা হচ্ছে। বাংলা ভাষা জানা তিনজন চীনা শিক্ষকের পাশাপাশি বাংলাদেশি শিক্ষক সুবর্ণা আক্তার এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা পড়ান।

সুবর্ণা আক্তার কালের কণ্ঠকে বলেন, বাংলা ভাষা চালুর এই উদ্যোগের মাধ্যমে দুই দেশের সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানটা আরো বেড়েছে। এ ছাড়া এই উদ্যোগ ব্যাবসায়িক ও অর্থনৈতিক  কার্যক্রমে ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা দূর করতে বেশ সহায়ক হচ্ছে। চীনের বিভিন্ন প্রদেশে যেখানে বাণিজ্য বেশি হয়, সেখানে বাংলা ভাষায় দক্ষতা রয়েছে এমন মানুষের খুব প্রয়োজন। একই সঙ্গে বাংলাদেশেও চীনা ভাষার সম্প্রসারণ করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে দুই দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম আরো সম্প্রসারিত করা যাবে।